বিশ্ব মানবতা ও মানবিক বাংলাদেশ

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২০, ১১:১৯ পিএম বিশ্ব মানবতা ও মানবিক বাংলাদেশ
এস এম সাব্বির খান

মানবতাবাদী গোষ্ঠী ভাসানচরে ‘অরক্ষিত’ আবাসনে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে প্রবল আপত্তি তুলেছে। উপকূলবর্তী শরণার্থী শিবিরগুলোয় সংঘাত, সহিংসতা, প্রাণহানি যত যাই ঘটুক; ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে নারাজ মানবতাবাদী গোষ্ঠী। বিশ্বের বড় বড় সব মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ইস্যুতে শতভাগ সোচ্চার। কিন্তু আমলেই নিচ্ছে না আশ্রয় প্রদানকারী বাংলাদেশের মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি। শরণার্থীদের একটি বিশাল অংশ স্বদেশের মাটিতে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটু শান্তিতে থাকতে ভাসানচরের সুপরিকল্পিত আবাসনে ঠাঁই নিতে চাইলেও মানবাধিকার সংস্থা তথা বিশ্বের মানবতাবাদী একটি বিশেষ গোষ্ঠী কোনোভাবেই তা হতে দেবে না! কারণ? ভাসানচরে মাথাগোঁজার ঠাঁই আছে কিন্তু আভিজাত্য নেই। নেই বিলাসবহুল খাস কামরা বা সুপ্রশস্ত বাথরুম। আর এসব না থাকায় মানবাধিকার ব্যাপক ঝুঁকির মুখে পড়ছে বই কি!

মানবাধিকার সংগঠন ও মানবতাবাদী গোষ্ঠী চরম নিরাপত্তা সংকটের মুখে পড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে বিচলিত নয়! আসলে এই যে মানবতার দরকষাকষি আদতে সেটি কি সত্যিই রোহিঙ্গাদের স্বার্থরক্ষার তরে?

এই যে রোহিঙ্গাদের পেটে-ভাতে পুষে যাওয়া বাংলাদেশ; এই বাংলাদেশেও কিন্তু মানুষ বাস করে, এক্ষেত্রে তাদের অধিকারটুকুই শুধু নেই। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা যাবে না, গেলে মিয়ানমার সেনা মেরে ফেলবে। আবার ভাসানচরেও পাঠানো যাবে না, সেখানে নিরাপত্তা নেই। অথচ শরণার্থী শিবিরের সার্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে সৃষ্ট আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা, পরিবেশ ধ্বংস, সীমান্তে মিয়ানমার সেনাদের হুমকি বা ভয়াবহ স্থলমাইন স্থাপনায় মানবতাবাদী গোষ্ঠী বিশেষ আগ্রহী নয়। এই মানবাধিকার সংগঠন ও মানবতাবাদী গোষ্ঠী চরম নিরাপত্তা সংকটের মুখে পড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে বিচলিত নয়! আসলে এই যে মানবতার দরকষাকষি আদতে সেটি কি সত্যিই রোহিঙ্গাদের স্বার্থরক্ষার তরে? যে মানবতাবাদের সৌজন্যে রোহিঙ্গারঙ্গ এখন বিশ্বমঞ্চে মঞ্চস্থ হচ্ছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই মানবতাবাদের সাম্প্রতিক অবস্থা এবং এর চাপে কোণঠাসা মানবিক বাংলাদেশ ঠিক কোন বাস্তবতার ফর্দ উন্মোচন করছে তা একটু দেখে নেয়া যাক। আসলে কে কাকে মানবতাবাদের দর্শন দীক্ষা দিচ্ছে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝে নেয়া এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

এখন উত্তাল নাগোরনো-কারাবাখ। বিশ্বমানবতা রুখতে পারেনি আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের প্রাণহানি। রুখতে পারেনি দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বুকে উন্নত বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে স্বীকৃত সভ্য ও আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর বোমারু বিমানের আগ্রাসন। জলবায়ু ইস্যুতে বিপন্ন রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতিপূরণও আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে শিল্পোন্নত দাতারাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে। ম্যাঁখো, পিং বা ট্রাম্প; যার কথাই বলা যাক, সুশীল মানবতা সেখানে খুব শান্ত। এই মানবতাবাদী গোষ্ঠী রাখাইনের রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পথ রুখে দাঁড়াতে পারেনি; পারেনি তাদের প্রত্যাবাসনের যৌক্তিক দাবি উত্থাপনে মিয়ানমার সরকারকে জবাবদিহি করতে। শুধু ভাসানচরের পথে নানা অজুহাতের প্রাচীর গড়ে তুলে, বেশ তৎপর এক্ষেত্রে। কেন? সে প্রশ্নের উত্তর মানবতাই জানে। বুঝেশুনে বাংলাদেশকে মানবিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এই মানবতার বাতুলতা। অথচ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া মানবিক বাংলাদেশ ও তার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে তারা বেশ পটু। অবান্তর এই মানবতার হাস্যকর রোহিঙ্গারঙ্গ বঙ্গের বেদনা বাড়াতে পারে, বর্মিদের বেয়াড়াপনার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।

বুঝেশুনে বাংলাদেশকে মানবিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এই মানবতার বাতুলতা। অথচ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া মানবিক বাংলাদেশ ও তার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে তারা বেশ পটু। অবান্তর এই মানবতার হাস্যকর রোহিঙ্গারঙ্গ বঙ্গের বেদনা বাড়াতে পারে, বর্মিদের বেয়াড়াপনার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।

রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে না এ মানবতা। সেটা হলে তো ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ছুটত তারা। মানবতা শুধু হাহাকার করে তাদের ভাসানচরে পাঠানোর কথা শুনলে। মানবতার আজ বড্ড প্রয়োজন এই রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশের মূল ভূখণ্ডে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার ‘অব্যাহত উত্থান’ নিশ্চিত করা। আজ যে মানবতা বিশেষ কারণে বাংলাদেশের কাঁধে রোহিঙ্গাদের বোঝা চিরস্থায়ী করার প্রাণন্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেÑ কোনো এক সময় এ দেশের যুদ্ধাপরাধীরা যেন ন্যায়বিচার পায় এবং আইনি অধিকার পায় আত্মরক্ষার, সে জন্যে তারা তোলপাড় করেছে। কিন্তু বধ্যভূমির কাদাজলে মুখ থুবড়ে পড়া বুদ্ধিজীবী, লাখো বাঙালি বীরের রক্তাক্ত লাশ কিংবা বীরাঙ্গনার সতীত্ব হননের পথে বিশ্বমানবতা কোনো প্রতিবন্ধকতা গড়েছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। বরং আজকের মানবতাবাদী বিশ্বের একটি বিশাল অংশ সেদিন একাট্টা হয়ে আঘাত হানতে মরিয়া হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে। আজ সেই মাটি বিশ্ব মানবতার দায় বয়ে চলে, মানবতা কৃতজ্ঞতাও জানায় না।

মানবতা সৌজন্যের বিবৃতি ছাড়া কিছুই করতে পারেনি মানবিক সত্তার তরে, বিশ্ব বিবেক তার রাজসাক্ষী। মানবিক বিশ্ব রুখতে পারেনি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দখলদার ইসরায়েলি যুদ্ধবাজের আগ্রাসন। কিংবা নিশ্চিত করতে পারেনি সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক জামাল খাশোগির গলিত লাশের প্রতি ন্যায় প্রতিষ্ঠা, যার অপরাধ ছিল মানবতাবিরোধী রাজতন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করা। যখন পুলাওমার সেনা কনভয়ে জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে ছিল ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানদের রক্তাক্ত লাশ, মানবতা তখন প্রবল আক্রোশে গর্জে উঠতে পরেনি উগ্রবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে। মানবতা সিন্ধু কিংবা বেলুচিস্তানের মুমূর্ষু মনুষ্যত্বের প্রাণপাত দেখে না। দেখে কাশ্মীরে নিহত উগ্রপন্থির লাশে সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা। মানবতার চোখে জওয়ানের লাশ উপেক্ষিত, কিন্তু জঈশ-ই-মুহম্মদ জঙ্গির লাশে মানবতা নিরীহ কাশ্মীরিদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে নেয় নিজ দায়িত্বে। এমনকি উইঘুরে উঁকিটিও দেয় না মানবিক এই মানবতাবোধ।

মানবিক বাংলাদেশের জাগ্রত প্রতিচ্ছবি দেখি নায়মা-তামান্নার উড়ন্ত কম্বেট চপারের দাপুটে ব্লেডের প্রলয় ঘূর্ণিতে। কখনো আবার সেই মানবতার অনির্বাণ শিখা জ্বলে মালির বুকে সংঘটিত ভয়াল বিস্ফোরণে ক্ষত-বিক্ষত শহীদ আলতাফ, জাকিরুল, মনোয়ার, কালাম, আখতার, রায়হান আর জামালের কফিনবদ্ধ রক্তাক্ত লাশে।

সাম্প্রতিক বিশ্ব কিন্তু নীরবে ইতিহাসের পাতায় এই অমোঘ সত্যই টুকে নিচ্ছে যে, মানবতা এখন শুধু পরিপাটি বসনে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে টিপটপ বিবৃতিতে। এই মানবতা ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য কষ্টের কথা ভাবতেই কেঁদে বুক ভাসায় আর সে কষ্ট রুখতে মরিয়া হয়ে মিথ্যাচার করে অবলীলায়। কিন্তু রাখাইনে সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসলীলা দেখে চুপ থাকে। বলে, ‘শোকে বাকরুদ্ধ’! এরপর সারাবিশ্ব সরব হয়ে উঠতেই কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায় এই মানবতাবাদ। কিন্তু খুনি-ধর্ষকদের স্বার্থরক্ষায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিঘ্নিত করে মুখ ও মুখোশের সত্যটুকুও পরে প্রকাশ করে নির্লিপ্তভাবে।

মানবতা সভ্যসমাজের মোটা কাচে মোড়া বিলাসবহুল অট্টালিকার সংলাপকক্ষে সোচ্চার প্রতিবাদে প্রতিধ্বনি তোলে বটে, কিন্তু বাইরের পরিবেশ অশান্ত করে না মানবিক দাবি আদায়ে। মানবতা মানুষের জন্যে পথে নামে না। শান্তির ঝাণ্ডা আঁকড়ে লটকে থাকে সেই সব অট্টালিকার ছাদে। অথচ শান্তির দূত হয়ে বিপন্ন মনুষ্যত্বের স্বার্থে মানবতাকে দেখি অন্য রূপে; কখনো আফ্রিকার গহীন অরণ্যে, কখনো নামিবিয়ার স্বাধীনতার রণাঙ্গনে, অথবা কঙ্গোর সন্ত্রাসবাদ দমনে ঝলসে ওঠা বঙ্গের বীরসেনানির রাইফেলের মাজলে। মানবতাবাদী বিশ্ব সম্প্রদায় যখন সংঘাতের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় বাংলার উপকূলবর্তী শরণার্থী শিবিরে তখন মানবিক বাংলাদেশের জাগ্রত প্রতিচ্ছবি দেখি নায়মা-তামান্নার উড়ন্ত কম্বেট চপারের দাপুটে ব্লেডের প্রলয় ঘূর্ণিতে। কখনো আবার সেই মানবতার অনির্বাণ শিখা জ্বলে মালির বুকে সংঘটিত ভয়াল বিস্ফোরণে ক্ষত-বিক্ষত শহীদ আলতাফ, জাকিরুল, মনোয়ার, কালাম, আখতার, রায়হান আর জামালের কফিনবদ্ধ রক্তাক্ত লাশে। আর তাদের পিতৃহারা সন্তানের প্রলয় আর্তনাদে।

আজ মানবতাবাদী প্রহসনের লাঞ্ছনা বুকে রক্তক্ষরণ ঘটায়। মেন্ডেলা, কফি আনান কিংবা মাদার তেরেসার মতো সেকেলে নয় আজকের মানবতা। এই মানবতা আধুনিক। প্রযুক্তির ইশারায় দুরন্ত গতিতে ছুটে বেড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে। তবে দিন শেষে বিশ্ব মানবতা আর মানবিক বাংলাদেশ যখন মনুষ্যত্বের নিক্তিতে তোলা হয়- দেখা যায়, যে বিশ্বমানবতা মনুষ্যত্বের দীক্ষা দেয় ভাসানচরতত্ত্বে, তাদের ব্যর্থতায় বিবর্ণ অচেতন বোধের বিপরীতে দেখি নিপীড়িত মানুষের আশ্রয় হয় এই পৃথিবীরই কোনো একটি ছোট্ট ব-দ্বীপে; বিচলিতচিত্ত হতে অপসারিত হয় অবাঞ্ছিত ক্লেশ। বিশ্বপ্রান্তর কাঁপিয়ে গর্বিত সত্তা তখন গর্জে ওঠে ‘সাবাস বাংলাদেশ’।

লেখক : সাংবাদিক