করোনায় ঈদ

সংকটকালে অমানবিক ঈদযাত্রা

কবির য়াহমদ প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২১, ০২:০৬ পিএম সংকটকালে অমানবিক ঈদযাত্রা

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চলাকালে এটা সংকটকালীন তৃতীয় ঈদ আমাদের। ঈদের যে উৎসব, উল্লাস, উচ্ছ্বাস—সেসবে ঘাটতি পড়েছে এবারও। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এবারও নানা বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধির আড়ালে রয়েছে এবারের ঈদের আয়োজনও। এই বিধিনিষেধ, এই স্বাস্থ্যবিধি, যা অবশ্য পালনীয়, তার কিছুটা হলেও উপেক্ষিত হচ্ছে এবারের ঈদের আয়োজনে। ঈদযাত্রায় ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তবু এই ভোগান্তি শেষে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ উদযাপনে যেভাবে মানুষ পড়িমরি করে ছুটছে তাতে করে আরও ঝুঁকি বাড়ছে।

আমাদের জীবনে খুব বেশি আনন্দের উপলক্ষ নেই। ধর্মীয় নানা উৎসবে মানুষ প্রাণ খুলে আনন্দে ভাসতে চায়। গত বছর থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এই আনন্দেও বাদ সেধেছে করোনার হানা। গতবার না হয় মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও সচেতনতা ছিল, কিন্তু এবার সেই সচেতনতা উড়ে গেছে হাওয়ায়। এই অসচেতনতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয়তো নেই, কিন্তু মানুষের জীবনাচরণের যে ধারাবাহিকতা, সেখানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, সরকারি বিধিনিষেধের কোনো কিছুই পাত্তা পায়নি। মানুষ ছুটছে নীড়ের পানে, স্বজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনে।

এবার ঈদযাত্রায় যে ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ, সেখানে দায় আমাদের নীতিনির্ধারকদের। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ যে যুক্তিতে সেই যুক্তি অসার প্রমাণিত হয়েছে। স্রেফ কাগজে-কলমে কঠোর বিধিনিষেধের নামে যে ‘লকডাউন’ দিয়েছে সরকার, সেটা সফল হয়নি। এই সফল না হওয়ার পেছনে মানুষের হাত আছে সত্য, কিন্তু যে দায়, সেটা একান্তই নীতিনির্ধারকদের। কঠোর বিধিনিষেধের নামে যে লকডাউন চলছে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে, সেই বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য করার মতো কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি সরকারের পক্ষ থেকে। প্রচারমাধ্যমে এর জোর প্রচারণাও চালানো হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করেই দায় এড়িয়েছে সরকার। করোনা যেন এক প্রজ্ঞাপনের খেলা; প্রজ্ঞাপনে বিধিনিষেধ, প্রজ্ঞাপনেই সংক্রমণের গতি-দুর্গতি!

ঈদযাত্রা শুরুর সময় থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে ছবিগুলো প্রচার হয়ে আসছে, তাতে করে সবাই একবাক্যে ফেরি পারাপারে ইচ্ছুক হাজারও মানুষের ছবি দেখিয়ে তাদের দোষারোপ করছেন। এই ছবিগুলোর মধ্যে থাকা অধিকাংশ মানুষই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির, যাদের নিজস্ব কোনো পরিবহন নেই। তারা ভুগতে-ভুগতে, ধুঁকতে-ধুঁকতে ফেরি পর্যন্ত হাজির হয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তারা দেখে ফেরি বন্ধ, অথবা আগে থেকেই জানত ফেরি বন্ধ। এই বন্ধ ফেরি পারাপারও সম্ভব ভেবেই তারা এত দূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। বাড়ি পৌঁছাতে নানা বিপত্তির মুখে পড়তে হবে জেনেও অনেকেই ঢাকা ছেড়েছে। এখানে তারাও হয়তো ভেবেছে অসম্ভবের মাঝেও আছে সম্ভবের সম্ভাবনা। যদিও সেটা সঠিক পন্থার নয়। এই বেঠিক পন্থার আশা করে যে ঘর ছেড়েছিল স্বজনের টানে, সেটাও কি আমাদের প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়! গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, ঈদযাত্রায় ফেরি পারাপারে পদদলিত হয়েছে পাঁচজন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন অনেকেই। এই প্রাণের অপচয়ের কোনো খেদ নেই আমাদের কারও। দোষ দেওয়া হচ্ছে তাদের। অথচ এই পরিবেশ যারা তৈরি করেছে, তারা কি দায় এড়াতে পারে? পারে না!

একদিকে কঠোর বিধিনিষেধের নামে ‘লকডাউন’, অন্যদিকে বিপণিবিতানসহ সবকিছুই খোলা। বন্ধ কেবল দূরপাল্লার যানবাহন। এটা কী ধরনের বিধিনিষেধ, কী ধরনের লকডাউন—এই প্রশ্ন কেউ করার সাহস পাচ্ছে না। ক্ষীণ স্বরে এই প্রশ্ন কেউ করলেও সেটা নীতিনির্ধারক পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। পৌঁছালেও আবার সেটা আমলে নেওয়া হয়নি, হচ্ছে না। ফলে এই ঈদযাত্রায় মানুষ যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাল, সেটার জন্য কেউ অনুশোচিত হচ্ছে না। উল্টো দায় চাপাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষদের ওপর। যেন স্বজনের সাহচর্যের আকাঙ্ক্ষাই তাদের অপরাধ, স্বজন থাকাটাই অপরাধ! অথচ দেখুন, যাদের সামর্থ্য আছে, নিজস্ব পরিবহন আছে, তাদের জন্য এমন দুর্ভোগ ছিল না, যতটা ছিল নিম্ন আয়ের মানুষদের। স্বজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগির আকাঙ্ক্ষাগুলো মানুষের হাসিঠাট্টার উপকরণ হয়েছে। অমানবিক সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

পরিবারের সঙ্গ পেতে ফেরিগুলোতে যখন উপচে পড়া ভিড়, তখন ফেসবুক সূত্রে জানা গেল চলনবিলের এক প্রতিমন্ত্রী পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে নিজের এলাকায় গেছেন। সেই ছবিও দিয়েছেন তিনি ফেসবুকে। করোনাকালে তার ঢাকা ছাড়ার সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি নাটোর-০৩ সিংড়া আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। আমার নির্বাচনী এলাকাও আমার কর্মস্থল।’’ তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের এই বক্তব্য সত্য, কিন্তু ছবি শেয়ারে তিনি যে ক্যাপশনে লিখেছেন ‘‘মায়ের কাছে’’ সেটাই হলো তার উদ্দেশ্য। মায়ের কাছে কোনো সন্তান যাওয়ার সমালোচনা কেউ করবে না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী তার নির্বাচনী এলাকা তার ভাষায় ‘কর্মস্থলে’ যাননি, গেছেন পরিবারের সদস্য হিসেবে তার পরিবারের কাছেই। কী অমানবিক সিস্টেম! ক্ষমতা আছে, সামর্থ্য আছে, গাড়ি আছে প্রতিমন্ত্রীর, তাই তিনি নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে পেরেছেন, আনন্দ করতে পারছেন। কেন ভাই, যার গাড়ি নেই তার কি পরিবারের সঙ্গ পাওয়ার অধিকার নেই? দূরপাল্লার যান যখন বন্ধ, তখন কি প্রতিমন্ত্রী পারতেন না সাধারণ মানুষের আবেগের প্রতি সম্মান জানাতে? আবার ক্ষমতাসীন আর সামর্থ্যবান বলে যখন গেলেনই, তখন কী দরকার ছিল সাধারণ আর প্রতিমন্ত্রীর মধ্যকার ফারাকটা এভাবে স্পষ্ট করতে! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা বাড়ি ছুটছে তাদের প্রতি এ কি নির্মম রসিকতা নয়?

করোনার শুরুতে নানা সীমাবদ্ধতা ও সমন্বয়হীনতা সত্ত্বেও এবারের মতো এত গুবলেট পাকানো হয়নি। তখন কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকারের। এবার তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আগে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করার মতো নানা পদক্ষেপ ছিল প্রশাসনের, আর এবার সব বিধিনিষেধ কাগজে-কলমে রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন তারা। এটাই কাল হতে যাচ্ছে আমাদের। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে ঈদের ফিরতি যাত্রায় একই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। গত কয়েক সপ্তাহে করোনার সংক্রমণের যে নিম্নগামী ধারা, সেটা ফের ঊর্ধ্বমুখী যে হবে না—সেটা কেউ বলতে পারে না। ঈদযাত্রায় যত মানুষ গ্রামে গেছে তারা গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মিশবে-ঘুরবে; তাদের কারও শরীরে করোনার উপস্থিতি থাকলে সেটাও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে যে শঙ্কার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

করোনা বৈশ্বিক সংকট। বৈশ্বিক এই সংকটে আমাদের অবস্থাও ভালো নয়, আমাদের দেশও আক্রান্ত। করোনার বহুল সংক্রমণ রোধে সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনই দায়িত্ব রয়েছে নাগরিকেরও। করোনার সংকটকালে ঈদ যখন এসেছে তখন সংকটকালীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছিল সরকারের। কিন্তু সেটা তারা নেয়নি। ফলে সাধারণ মানুষেরা যে ভোগান্তির মুখে পড়েছে, সেটা কেবল ওই নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষেরই সমস্যা নয়, এটা পুরো দেশের সমস্যাও। কারণ এরাই পরিবারের সঙ্গে মিশে তাদের পরিবারকে এবং নিজেদের ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

মায়ের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে, স্বজনদের ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করতে যাওয়া মানুষদের তাই একপাক্ষিক সমালোচনা করতে আমি রাজি নই। তাদের অনেকেই হয়তো গরিব-অসচেতন-অজ্ঞ কিংবা এমনই বিশেষণের যোগ্য, কিন্তু তারাও তো কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। তাদের অসচেতনতাকে জায়েজিকরণের তত্ত্বে না ফেলে তবু বলি উৎসবযাত্রাকে নিষ্কণ্টক রাখার চেষ্টার দরকার ছিল নীতিনির্ধারকদের। তারা এই বিষয়টি পাত্তা না দেওয়ায় যে ঝুঁকির মুখে আমরা, তার খেসারত হয়তো দিতে হবে। প্রার্থনা করি, তেমন কিছু যেন না ঘটে। যদিও জানি, প্রার্থনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দুর্বল, খুবই দুর্বল! তবু এ যে সান্ত্বনা বিশেষ!

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক