সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা 

আ.লীগে আলোচনায় আগামী সম্মেলন  

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০১৯, ০৯:৫৬ পিএম আ.লীগে আলোচনায় আগামী সম্মেলন  

দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন আর কয়েক মাস পর। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী অক্টোবরেই হবে ক্ষমতাসীন দলটির জাতীয় সম্মেলন। আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছে, সম্মেলনকে ঘিরে দলের মধ্যে এরইমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। আগামী জাতীয় সম্মেলনে কারা দলের নেতৃত্বে আসবেন আর কারা বাদ পড়বেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। অপরদিকে আগামী সম্মেলনে ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব আনতে কাজ শুরু করেছে দলটি। সারা দেশে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। এ লক্ষ্যে সাংগঠনিক সফর, সভা ও জেলা সফর শুরু হয়ে গিয়েছে। জেলা পর্যায়ের সম্মেলনগুলোও শুরু হয়েছে।    

দলের জাতীয় সম্মেলন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত শনিবার (১৫ জুন) দলের এক সভায় বলেন, আমাদের জাতীয় সম্মেলন করতে হবে। আমাদের নেত্রী এবং আমারও ইচ্ছা যথাযথ সময়ে সম্মেলনের কাজ সমাপ্ত করা। আওয়ামী লীগ কোনো বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া কখনও সম্মেলন করতে গিয়ে নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করেনি। আমরা এখন জাতীয় সম্মেলনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। উল্লেখ্য, প্রায় ৩ বছর পূর্বে আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিলে সভাপতি হন শেখ হাসিনা। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের।

জানা গেছে, দলের জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে একযোগে ৮ বিভাগে সাংগঠনিক সফর শুরু করেছে দলটি। ওই ৮টি সাংগঠনিক টিম সারা দেশে আওয়ামী লীগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলন করবে। সারা দেশে সাংগঠনিক সফর ও জেলা পর্যায়ের সম্মেলন শেষে জাতীয় সম্মেলনের দিকে ধাবিত হবে আওয়ামী লীগ। দলীয় হাইকমান্ড চায়, জাতীয় সম্মেলনের আগেই সব জেলার সম্মেলন শেষ করতে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। আগামী ওই সম্মেলনে দলের যারা ক্লিন ইমেজের পরীক্ষিত নেতা রয়েছেন তারা নেতৃত্বে জায়গা করে নেবেন বলে দলীয় তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করে। দলীয় হাইকমান্ডের সুনজরে রয়েছেন তৃণমূলের একঝাঁক পরীক্ষিত নেতা। 
 
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, এবার দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় যেমন ক্লিন ইমেজ নেতৃত্বে আনতে চায় তেমনি নেতৃত্ব চয়নের বিষয়েও বেশ তৎপর থাকবে দলটি। জাতীয় সম্মেলনকে ঘিরে যারা কাউন্সিলর তাদের নির্ধারণেও এবার বেশ সচেতন হবে আওয়ামী লীগ। দলে যারা বিতর্কিত তাদের এড়িয়ে ও অনুপ্রবেশকারী নিশ্চিত করার পরই কাউন্সিল নিশ্চিত করতে চায় দলটি। কাউন্সিলর নির্বাচনের শর্তের মধ্যে থাকছে, ২০০৮ সাল বা এর আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে হবে। বিএনপি এবং জামায়াত থেকে বিএনপিতে আসা কেউ ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা বা অন্য কোনো জনপ্রতিনিধি হলেও কাউন্সিলর হতে পারবেন না। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির মামলায় অভিযুক্ত কেউ কাউন্সিলর হতে পারবেন না। জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্টতায় অভিযুক্ত কাউকে কাউন্সিলর করা যাবে না। মাদক ব্যবসায়ে জড়িত তালিকাভুক্ত কেউ কাউন্সিলর হতে পারবেন না। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত, নারী নির্যাতন বা যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত, দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারী, নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছেন- এমন কেউ কাউন্সিলর হতে পারবেন না। জেলা ও মহানগর পর্যায়ে নেতাদের ব্যক্তিগত কর্মচারীদের কাউন্সিলর করা যাবে না। মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের পিএস, এপিএস বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা কাউন্সিলর হতে পারবেন না। এ নির্দেশনা মেনে জেলা ও মহানগরীগুলোতেও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।  

দলীয় সূত্রগুলো মনে করে, আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বেশ কিছু চমক থাকতে পারে। তবে শীর্ষ নীতি-নির্ধারণী পদে বয়সের ভারে ন্যুব্জ কেউ ছাড়া কারও বাদ পড়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না। 

সূত্রগুলো বলছে, দলের আগামী সম্মেলনে প্রত্যাশিত পদ পেতে এরইমধ্যে সক্রিয় হয়েছে আওয়ামী লীগের অন্তত এক ডজন কেন্দ্রীয় নেতা। গত রোজার আগে থেকেই দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরই থাকছেন, না কি অন্য কেউ আসছেন এ বিষয়টি নিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, ওবাদুল কাদের সিঙ্গাপুর থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর যেভাবে ফের দলের হাল ধরেছেন তাতে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি আবারও আসতে পারেন। দলের সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ওবায়দুল কাদেরকেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে ওবায়দুল কাদের অসুস্থতা কাটিয়ে উঠলেও আগামী সম্মেলনে তিনি আর থাকছেন না বলেও মনে করেন দলের কেউ কেউ।
 
জানা গেছে, আগামী সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের এমন বার্তা জানান দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাদের নিজ নিজ এলাকাতেও এ নিয়ে আলোচনার দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ওই সূত্রগুলো বলছে, দলের সাধারণ সম্পাদক পদে আগামী সম্মেলনে যারা আলোচনায় রয়েছেন তারা হলেন- দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, দলের যুগ্ম-সাধারণ ডা. দীপু মনি, আব্দুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।  

তবে দলের বিভিন্ন সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বয়সের কথা বলে বেশ কয়েকবার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির কথা বলেছেন। দলটির ২১তম জাতীয় সম্মেলনে একই কথা উঠে এলেও পুনরায় তিনিই সভাপতি থাকছেন। দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা এমনটাই মনে করেন।  

উল্লেখ্য, ২০টি কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ ৬ জনকে সভাপতি পদে আর সাধারণ সম্পাদক পদে পেয়েছে ৯ জনকে। বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ষষ্ঠ সভাপতি আর ওবায়দুল কাদের দলটির নবম সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন। এর পরের বছর ১৯৭৭ সালে দলের ১১তম কাউন্সিলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করা হয়।

আওয়ামী লীগের সভাপতিরা : 
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সেল (সিআরআই) সূত্রে জানা গেছে, দলের প্রথম সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত চারটি কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ওই বছর একটি বিশেষ কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৪ সালে দলের পঞ্চম কাউন্সিলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি পদে ছিলেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। ওই বছর ষষ্ঠ কাউন্সিলে দলের সভাপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সভাপতি পদে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে দশম কাউন্সিলে সভাপতি হন এ এইচ এম কামরুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঘাতকের গুলিতে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হন তিনি। এরপর ১৯৭৮ সালে কাউন্সিলে সভাপতি হন আবদুল মালেক। তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে দলের সভাপতি পদে আছেন শেখ হাসিনা। দলের ১৩তম কাউন্সিলে তিনি প্রথম সভাপতি হন। সর্বশেষ ২০তম কাউন্সিলেও তিনি একই পদে নির্বাচিত হয়েছেন।

৯ জন হয়েছেন সাধারণ সম্পাদক :
সিআরআই সূত্রে আরো জানা গেছে, আওয়ামী লীগ গঠনের পর ১৯৪৯ সালে দলের প্রথম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। এরপর ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দলের দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। এরপর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৮৭ সালে সাধারণ সম্পাদক হন  সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ছিলেন ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। এরপর জিল্লুর রহমান আবারও দুই মেয়াদে ২০০২ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০২ সালের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হন আবদুল জলিল, ছিলেন ২০০৯ সাল পর্যন্ত। ওই বছর দলের ১৮তম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। সর্বশেষ কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়ে নবম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ওবায়দুল কাদের। 

এএইচএস/ এফসি