আজ ঐতিহাসিক ২৩ জুন

পলাশীর প্রান্তরে অস্তমিত রবি রোজ গার্ডেনে উদিত

জাগরণ প্রতিবেদক প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২১, ১২:০৫ এএম পলাশীর প্রান্তরে অস্তমিত রবি রোজ গার্ডেনে উদিত

আজ ঐতিহাসিক ২৩ জুন। ৭২ বছর আগে এই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা আজকের ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। যার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট আইনজ্ঞ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শামসুল হক সাহেবের মতো বিচক্ষণ নেতারা। আর ছিলেন দেশের এই বর্ষীয়ান রাজনেতাদের নয়নের মণি, তৎকালীন প্রগতিশীল তরুণ ছাত্রনেতা ও বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বর্তমানে দেশে অনেক রাজনৈতিক দলই আছে, কিন্তু আওয়ামী লীগকে সেই গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একই কাতারে বিবেচনা করার কোনও অবকাশ নেই। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের বীরোচিত সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস। অর্থাৎ আজ কেবল একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নয় কিংবা শুধু একটি নির্দিষ্ট দিনের উদযাপনেই এ দিনটির যথার্থ তাৎপর্য মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এর কারণ জানতে ফিরে যেতে হবে সুদূর অতীতে, ইতিহাসের পাতায়। এর আগে যে সত্যটি অবধারিত বলে মানতে হবে, তা হলো এই আওয়ামী লীগই হচ্ছে স্বাধীনতাকামী নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির মোর্চা। এই ২৩ জুনই গোড়াপত্তন হয় একটি অবশ্যম্ভাবী ১৬ ডিসেম্বরের।

ফিরে দেখা ২৩ জুন—

বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন ২৩ জুন। এই ২৩ জুন একই সাথে বাঙালি জাতির পতন থেকে উত্থান, অবলুণ্ঠন থেকে অর্জন, পরাজয় থেকে বিজয় এবং পরাধীনতার গোধূলি লগ্ন থেকে স্বাধীনতার প্রথম সূর্যোদয়ের মত অনিবার্য বহু ইতিহাসের এক অবিসংবাদিত উপাখ্যান। এই লগ্ন সময়ের স্রোতে বিলীন হয়নি। বরং সুদীর্ঘ দুইশত বছরের কালচক্র প্রদক্ষিণ শেষে এ জাতির জীবনে ফিরে এসেছিলো। ফিরে এসেছিল, পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতন আর বাংলার স্বাধীনতার সূর্যাস্তের দুঃস্মৃতি ভুলে, এক অবিসংবাদিত মহানায়কের উত্থান আর বাংলার সেই লুণ্ঠিত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের পটভূমি রচনা করে শাপমোচন হতে।

২৩ জুন ১৭৫৭, পলাশীর প্রান্তর। মীরজাফর আর তার অনুসারীদের বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সেদিন পরাজিত হয়েছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলা। আর নবাবের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সেদিন পলাশী প্রান্তরে অস্তমিত হয় স্বাধীন বাংলার শেষ সূর্য। সে থেকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে সুদীর্ঘ দুইশত বছরের ঘোর অমানিশা। 

এরপর হঠাৎই একদিন এ জাতির পরাধীনতার ইতিহাস বদলের মহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে আবির্ভূত হয় আবারও সেই দিন। ২৩ জুন। তখনও পরাধীনতার শৃঙ্খল খোলেনি, বিলেতি শোষকের হাত থকে মুক্ত হয়ে বাঙালি তখন ‘স্বজাতি’র স্বৈরাচারিতা আর বর্বরতার কষাঘাতে জর্জরিত। ১৯৪৯ সালের এই দিনে রচিত হয়, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ এবং একটি স্বাধীন-স্বকীয় জাতি হিসেবে বাঙালি জাতিসত্ত্বার উৎসরণের পটভূমি। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ও বাঙালির মুক্তির মোর্চা, এদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা আজকের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। 

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত লাভ করে আজকের বাংলাদেশ। ভাষা, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বা ইতিহাস- কোনদিক থেকেই পশ্চিমাদের সাথে পূর্ব ভূখণ্ডের নূন্যতম সাদৃশ্য না থাকলেও শুধু সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশে পরিণত এই ভুখণ্ডটি। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সৃষ্টি হতে শুরু করে বৈরিতা। বাড়তে থাকে দূরত্ব। 

এমনই এক আবহে ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয়া ঐতিহ্যবাহী এ রাজনৈতিক দলটি। যা বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল। ‘রোজ গার্ডেন থেকে বর্তমান ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের (আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যালয়) সুরম্য ভবন’ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ উত্থান-পতনের ধারাবাহিতার ঘটনাবহুল ইতিহাস। 

প্রতিষ্ঠার পর পরই বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠে দলটি। সেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তান হতে বর্তমানের আধুনিক বাংলাদেশ; এই প্রতিচ্ছবিতে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগের সাফল্য ঈর্ষনীয়। 

বাঙালি জাতির স্বাধীনতাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও রাজনৈতিক অর্জন এসেছে এই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন, ’৬৪ -এর দাঙ্গার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আওয়ামী লীগ।

সুদীর্ঘ এই ৭০ বছরের পথচলায় আওয়ামী লীগকে কখনও সহ্য করতে হয়েছে শাসকের রক্তচক্ষু, কখনও আবার দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর এসেছে নির্মম নির্যাতন। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের কাণ্ডারি এই রাজনৈতিক দলটি কখনও মাথা নামিয়ে হার মানেনি। বাংলাদেশের মানুষের মানস-চিন্তাকে ধারণ করেই আওয়ামী লীগ যুগ-যুগান্তরে হয়ে ওঠে বাঙালি জাতিসত্ত্বার উদযাপনের মহামঞ্চ।

ইতিহাস বলছে, যতকাল এ দেশ রবে তত কাল তার সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধিকে লুটে নিতে জাতির সামনে বহিঃশত্রুর দোসর হয়ে মীরজাফর, মীর কাশেম, মুস্তাক আর জিয়ার মতো স্বার্থান্বেষীরা ফিরে ফিরে আসবে। তবে ভয় নেই। আজও এই দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন স্বাধীনতা সপক্ষের সেই ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক শক্তি, আওয়ামী লীগ। আজও যার কাণ্ডারি হয়ে জাতিকে এক উদ্ভাসিত আগামীর পথে এগিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই কিংবদন্তি মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা।

আজও বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠে বার বার প্রতিধ্বনিত হয় সেই জ্বালাময়ী স্লোগান ‘জয় বাংলা’।

যতবার এদেশের স্বাধীনতা হরণের ষড়যন্ত্রে সাজানো হবে পলাশীর পটভূমি, ততবারই সেখানে রচিত হবে শত্রুর বধ্যভূমি। যখনই আঘাত আসবে, ওই রেসকোর্স হতে হুঙ্কার ওঠবে। আর মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ক্রান্তিবীরের মতো রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়বে বাংলা মায়ের মুক্তবুদ্ধির মুক্তিযোদ্ধারা। অসিতে বা মসিতে গড়ে তোলা হবে দুর্বার প্রতিরোধ। আর বক্ষে প্রজ্বলিত রবে অমোঘ বাণীর সেই অনির্বাণ দীক্ষা—

“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই,
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”  

জাগরণ/এসকে