ক্রিকেটের আইনি লড়াইয়েও সফল রফিক-উল হক 

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২০, ০১:৩২ পিএম ক্রিকেটের আইনি লড়াইয়েও সফল রফিক-উল হক 

সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশের কিংবদন্তি আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক দীর্ঘ ৬০ বছরের আইন পেশায় নিজের প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে দেশের উচ্চ আদালতকে সহযোগিতা করে অনেকবার হয়েছেন আদালতের বন্ধু। দেশের আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় সব সময় লড়েছেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধান ও আইনি বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। মানবিক আইনজীবী ও সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত এই মহান ব্যক্তি আয়ের প্রায় সবই তিনি ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণ ও সমাজ সেবায়।  

বর্নাঢ্য জীবনে আইন পেশায় রাজনৈতিক মামলা পরিচালনায় অসংখ্যবার রফিক-উল হক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন- এ কথা সবারই জানা। তবে নন্দিত এই আইনজীবী ক্রিকেট অঙ্গনেও একবার আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন। যথারীতি এই যাত্রায়ও তিনি ছিলেন সফল। তার সেই সফলতার ইতিহাস জানতে হলে ৮ বছর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।  

দর্শকদের রুচি পরিবর্তনে বড় একটা ভূমিকা রেখেছিল ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও পরের বছর শুরু হওয়া বিশ্বের প্রথম ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল)। সেই ধারা অনুসরণ করে ২০১২ সালে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ টুর্নামেন্ট বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের (বিপিএল) আসর প্রথমবারের মতো আয়োজন করে বিসিবি। ওই বছর ৯ ফেব্রুয়ারি জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিপিএলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে খেলা মাঠে গড়ায়। 

বিপিএলের প্রথম আসরের আয়োজনে ছিল অনেক ঘাটতি। যদিও অনিয়ম, অসংলগ্নতার পরও দর্শকদের মধ্যে এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ৬ দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সেই আসরে প্রতিটি দল দুইবার করে একে অন্যের মুখোমুখি হয়। প্রতিটি দল ১০ ম্যাচ খেলা শেষে দেখা যায় ১৪ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলে সবার উপরে থাকায় অবধারিতভাবেই সেমিফাইনালে চলে যায় দুরন্ত রাজশাহী। ১২ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে থাকা খুলনা রয়্যাল বেঙ্গলসও সেমির টিকেট কেটে ফেলে। সমান ১০ পয়েন্ট করে পায় ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, বরিশাল বার্নার্স এবং চিটাগং কিংস। রানরেটে এগিয়ে থাকায় ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের তৃতীয় দল হিসেবে সেমিতে যাওয়া নিয়ে সমস্যা হয়নি। তবে বিপত্তি বাধে বরিশাল বার্নার্স এবং চিটাগং কিংসকে নিয়ে। রানরেটে এগিয়ে থাকায় বরিশালের শেষ দল হিসেবে সেমিতে যাওয়ার কথা থাকলেও বিপিএল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান গাজী আশরাফ হোসেন লিপু জানান যে বরিশাল নয়, সেমিফাইনালে যাচ্ছে চিটাগং কিংস। এক্ষেত্রে বাইলজ অনুযায়ী হেড টু হেডে বরিশাল পিছিয়ে থাকার কথা তিনি তুলে ধরেন। 

বাইলজের একটি ধারায় ছিল, যদি তিনটি দলের পয়েন্ট সমান হয়ে যায়, তাহলে প্রথমেই বিচার্য হবে সেই তিনটি দলের মধ্যকার মুখোমুখি লড়াইয়ে জয়ের সংখ্যা, পরে নেট রান রেট। বাইলজের আরো একটি ধারায় বলা ছিল একইভাবে দু'টি দলের পয়েন্ট সমান হয়ে গেলে কী হবে-সেটা। বিপিএলে তিনটি দলের পয়েন্ট সমান হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা, চিটাগং ও বরিশালের পয়েন্ট সমান হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি বিবেচনা করা হচ্ছে, এমনটা হিসেব করেই সেদিন প্রেসবক্সে এসে পুরো বিষয় সম্পর্কে সাংবাদিকদের ধারণা দিয়েছিলেন গাজী আশরাফ হোসেন। কিন্তু দেখা গেল টেকনিক্যাল কমিটি বিবেচনা করছেন চিটাগং কিংস ও বরিশাল বার্নার্সের বিষয়টি। ঢাকাকে তারা আগেই সেমিতে তুলে দিচ্ছেন, কারণ, এই তিন দলের মধ্যে ঢাকার জয় নাকি বেশি। এরপর চট্টগ্রাম ও বরিশালের সেমিফাইনালে ওঠা নিয়ে চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। সাংবাদিকদের জানানো হয় বাইলজ অনুযায়ী বরিশাল নয়, চিটাগং কিংস চলে যাচ্ছে সেমিফাইনালে। ফলে তারা সেভাবে প্রতিবেদনও তৈরি করেন এবং পরদিন সংবাদপত্রের পাঠকরা সেটাই পড়েন। 

কিন্তু গভীর রাতে বিপিএল টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে বৈঠকের পর পরিচালনা পর্ষদ আবার সিদ্ধান্ত বদলায়। রাত ২টা ১৯ মিনিটে টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান গাজী আশরাফ হোসেন ও সদস্য দেওয়ান শফিউল আরেফীন চিটাগং কিংস কর্মকর্তাদের একটি কাগজ ধরিয়ে দেন, যাতে লেখা বিপিএলের চতুর্থ সেমিফাইনালিস্ট বরিশাল বার্নার্স, চিটাগং কিংস নয়।  সকালে পাঠকরা পত্রিকা পড়ে জানতে পারেন রাজশাহীর সাথে সেমিতে ওঠা বরিশাল বার্নার্স ম্যাচ খেলছে। দর্শকরা এ ঘটনায় বিস্মিত হয়ে যান। পরদিন এ নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট আসে। তাতে জানানো হয় গভীর রাতে মিটিং থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেমিফাইনালে উঠতে না পেরে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন চট্টগ্রামের বিভাগীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি চিটাগং কিংস। তাদের সঙ্গে অবিচার হয়েছে বলেও দাবি করেন তারা।

পরে বিপিএলের ফাইনাল খেলা স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে চিটাগং কিংস রিট আবেদন করে। রিটে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিসিবি ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলসহ ৯ জনকে বিবাদী করা হয়। আবেদনকারীর পক্ষে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। রিট আবেদনের শুনানিতে বরিশালের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। 

এমন কথন পরিস্থিতি সামলাতে বিসিবি বেশ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। কারণ ২৮ ফেব্রুয়ারি রিটের উপর শুনানি ছিল সকালে আর বিপিএলের মিরপুরে দুপুর ২টায় প্রথম সেমিফাইনালে রাজশাহীর প্রতিপক্ষ কে তা নিয়ে ছিল সংশয়। মাত্র কয়েক ঘন্টা পর ম্যাচ অথচ তার ভাগ্য নির্ধারিত হবে তখন আদালতে! সংকটময় এই পরিস্থিতিতে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিসিবির কৌশলী হন। তার সঙ্গে ছিলেন এম কে রহমান। 

রিট আবেদনকারীর আইনজীবী বিষয়টি বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের বেঞ্চে নিয়ে যান। শুনানিতে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, তিনটি দলই সমান পয়েন্ট পেয়েছে। এ অবস্থায় আইন অনুযায়ী তিনটি দলই একটি অন্যের বিরুদ্ধে খেলবে এবং এর ওপর নির্ভর করবে পরবর্তী খেলা। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। বিসিবির পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও তার সঙ্গী এম কে রহমান আদালতে বলেন, চিটাগং কিংসের রিট গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এখানে ঘটনাগত বিতর্ক রয়েছে। এ ছাড়া তারা নিম্ন আদালতে একটি মামলা করেছে। ওই মামলা বিচারাধীন। এ অবস্থায় এই রিট চলতে পারে না। এরপর ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের আবেদনে আদালত রিট আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করেন। অপরদিকে, ঢাকার প্রথম সহকারী জজ আদালতে বিপিএল ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠানে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে করা আবেদনটিও খারিজ হয়ে যায়। ফলে রানরেটে এগিয়ে থাকার বিচারে বরিশাল বার্নার্স সেমিফাইনালে খেলে। আইনি লড়াইয়ে জিতে যায় বিসিবি; যার মূল কৃতিত্বের দাবিদার ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তার সেদিনের বিচক্ষণতায় বন্ধ হয়নি চলমান টুর্নামেন্ট।  

এসইউ