• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২১, ১২:৪৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৯, ২০২১, ০৬:৫৩ এএম

পাঠ-উপলব্ধি (শেষ পর্ব)

শোকাবহ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী

শোকাবহ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

(প্রথম প্রকাশের পর)
আট
এ রকম এক রাজনৈতিক পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু সমমনা আগের ছাত্রনেতা-কর্মীদের নিয়ে নতুন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’ ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হলে সেখানে একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যার নাম করণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হলেও বঙ্গবন্ধুই ছিলেন নতুন এ ছাত্রসংগঠনের প্রাণশক্তি। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠনের সাথে সাথেই বিরাট সাড়া পাওয়া যায়। ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠার এক মাসের মধ্যে প্রতি জেলায় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বেশকিছু জেলায় মুসলিম ছাত্রলীগের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তবে এর জন্য সহ্য করতে হয়েছিল সরকারের জুলুম, নির্যাচন ও নিপীড়ন।এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেন, ‘এই প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ। এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই। তখনকার দিনে আমরা কোনো সভা বা শোভাযাত্রা করতে গেলে একদল গুন্ডা ভাড়া করে আমাদের মারপিট করা হত এবং সভা ভাঙার চেষ্টা করা হত।..... মুসলিম লীগ নেতারা একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিল যাতে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে না পারে’ (পৃষ্ঠা ১১০)।

নয়
সে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান তৈরী তার এক বছর দশ মাসের মধ্যে একটি নতুন বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। কারণ শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা আর মুসলিম লীগকে ‘কোটারী’ করে ফেলা। পাকিস্তান সরকার কর্ডন প্রথা চালু করে দাওয়ালদের একজেলা হতে অন্য জেলায় ধান কাটা ও আনা-নেওয়া বন্ধ করে দেয়। গরিব ও দিনমজুর শ্রেনীর এই কৃষকদের দুর্দশার কথা সরকার বিবেচনা করেনি (পৃ. ১০৪)। জিন্নাহ ফান্ড গঠন করে জনগণ হতে জোর-জুলুম করে টাকা আদায় যা মহামারীর মত শুরু হয়েছিল (পৃ. ১০৫)। সরকারের এই নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সোচ্চার ছিলেন এবং এর তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতন ভোগী কর্মচারীদের ধর্মঘটে সরকারের কোন সহানুভুতি ছিলনা (পৃ. ১১২-১১৭ দ্রষ্টব্য)। এদিকে ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে টাঙ্গাইলে উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার খুররম খান পন্নী এর বিরুদ্ধে শামসুল হক এর বিজয় সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে অন্যতম মোড় এনে দেয় (পৃ. ১১৫)।

‘ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে দেশ শাসন চলল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। আজ দেখছে ঠিক তার উল্টা’ (পৃ. ১১৯)।

দশ
বিরুদ্ধবাদীদের ওপর মুসলিম লীগ সরকারের জুলুম-নির্যাতন এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তখন বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন সহজ ব্যাপার ছিল না। নতুন দল গঠনের জন্য কোন হল বা জায়গা পাওয়া যায়নি। তাই পুরানো ঢাকার কে, এম, দাস লেনের রোজ গার্ডেনে (প্রাইভেট বাড়ি) ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে গঠিত নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। নতুন এই রাজনৈতিক সংগঠনের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক এবং বঙ্গবন্ধুকে করা হয় জয়েন্ট সেক্রেটারী। বঙ্গবন্ধু সেই সময় জেলখানায়। ২৮ জুন কারামুক্তি লাভ করেন। যদিও নবগঠিত রাজনৈতিক এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অতৃপ্তি থেকে যায়। বঙ্গবন্ধু মনে প্রানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতার কথা মনে করে বঙ্গবন্ধুর সেই সময় ্উপলব্ধি ছিল হয়ত, ‘সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন’ (পৃ. ১২১)। ১৯৪৯ সালের ২৮ জুন বঙ্গবন্ধু কারামুক্তি লাভ করেন। নতুন এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে ঢাকায় দু’একটা জনসভাও হয়। বিভিন্ন জায়গায় সভা করতে গেলে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। অনেক জায়গায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বা কৌশলে সভা করেন। কয়েক মাসের মধ্যে কয়েকটি জেলায় কমিটি গঠন করা হয়। কিছু কিছু জেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রমও শুরু হয়ে যায়। জেলা পর্যায়ে যে সমস্ত নেতা কর্মী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক ছিলেন তারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে যোগদান করতে শুরু করে (পৃ ১২৮-১৩০)। ‘আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ, আমি গোপন রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, আর বিশ্বাসও করি না’ (১৩৫)।

এগারো
নতুন এই রাজনৈতিক সংগঠনকে প্রতিষ্ঠা করতে বঙ্গবন্ধুকে সহ্য করতে হয়েছে পুলিশের নিপীড়ন ও নির্যাতন। ১১ অক্টোবর আরমানিটোলায় বিরাট সভা শেষে শোভাযাত্রায় পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে ও লাঠিচার্জ করে। অন্যান্য নেতাকর্মীসহ বঙ্গবন্ধুও চরমভাবে যখম হন।পুলিশশামসুল হক সহ ত্রিশজনকে গ্রেফতার করে। পরে মওলানা ভাসানীকেও গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু যখম অবস্থায় প্রাণপন চেষ্টা করে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন গ্রেফতার এড়াতে। বঙ্গবন্ধুর কৌতুহল ছিল কেন মওলানা ভাসানী তাঁকে বিশেষ গুরুত্বদিয়ে গ্রেফতার এড়পতে বলেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার এড়াতে বলার কারণ ছিল সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করতে লাহোরে যাওয়া আর বিরোধী একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহানুভুতি কামনা করা (পৃ. ১৩৫)। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বঙ্গবন্ধু লাহোর পৌছান। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভাষাগত সীমাবন্ধতা আর সরকারের নজরদারীর কারণে লাহোরে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান খুব একটা সুখকর ছিল না। তবে লাহোরে থাকাকালীন সময়ে পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর নেতাকর্মীদের সাথে যোগসূত্র তৈরী হয়। সেখানের মিডিয়ার কাছে বাংলাকে রাষ্টভাষা করা ও পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার বিবৃতি তুলে ধরেন (পৃ ১৪০)। লাহোর ত্যাগের সময় সোহরাওয়ার্দী থেকে বঙ্গবন্ধু ভরসা পেয়েছিলেন সাংগঠনিক শক্তি ও বলিষ্ট নেতৃত্ব দানে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকার। প্লেনে দিল্লী তারপর ট্রেনে হাওড়া স্টেশন। হাওড়া স্টেশন থেকে কলকাতায় তাঁর এক বন্ধু খন্দকার নুরুল আলমের বাসায় রাত্রী যাপন করেন। পরদিন খুলনার উদ্দেশ্যে ট্রেনে যাত্রা। বেনাপোলে বঙ্গবন্ধু কৌশলে পুলিশকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার এড়াতে চেয়েছিলেন কারন তখন বঙ্গবন্ধুর মন চলে গেছে বাড়িতে (পৃ. ১৪৬)। গোপালগঞ্জে কয়েকদিন কাটিয়ে ঢাকা আসেন। ঢাকায় বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের বাড়িতে কয়েকদিন আত্মগোপন করেন। অবশেষে ২৫ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং জেলখানায় নিয়ে যায়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু কারাগার হতে মুক্তির আগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম বেশিদূর তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। তবে বঙ্গবন্ধুর ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মুক্তিলাভের পর থেকে ১৯৫৪ সালের মে মাসের শেষে পুনরায় গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়কে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিস্তার কাল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময়ে আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর যে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন তার বিস্তারিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বিভিন্ন পরতে পরতে তুলে ধরা হয়েছে (পৃ. ১৩০-১৩৪, ২১১-২২১, ২৩৬-২৩৯, ২৪৩)। এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল ১৯৫৩ সালের ১৪-১৬ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল। সম্মেলনে ভাসানী সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক ও ইয়ার মোহাম্মদ খান কোষাধাক্ষ নির্বাচিত হন (পৃ. ২৩৯)।

বারো
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা সংগ্রাম আর বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি অপরটির সাথে জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার সাথে সাথে শাসকগোষ্ঠীর যে স্বরুপ উন্মোচিত হয় তার পেক্ষিতে এ অঞ্চলের তরুণ সমাজের মাঝে যে অধিকার বোধ জন্মগ্রহণ করে তার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ৮ ফেব্রæয়ারী ১৯৪৮। করাচীতে পাকিস্তান সংবিধান সভা (কন্সটিটিউযেন্ট এ্যাসেম্বালি) তে মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অবস্থান গ্রহন করে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যের সেই মত’। একমাত্র কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করেছিলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করেছিল এবং দাবি করেছিল বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দিন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহবান করে একটা ‘রাষ্টভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। তমদ্দুন মজলিস একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষনা করা হয়। ‘১১ মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্র-কর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোষ্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনো পিকেটিং দরকার হয় নাই। সমস্ত ঢাকা শহর পোষ্টারে ভরে ফেলা হয়।’ অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিতে সেই দিনের চিত্রটি বঙ্গবন্ধুর লেখনীর মাধ্যমে পাঠক হিসেবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। যখন পুলিশের অত্যাচার ও লাঠি চার্জ ছাত্ররা আর সহ্য করতে পারছিল না সেই সময়েও বঙ্গবন্ধু ভয় পাইনি। বরং নতুন কর্মীদের নিয়ে ছুটে গেছেন। ইডেন বিল্ডিং এর দরজায় বসে যখন বঙ্গবন্ধু তার নেতা-কর্মী ও ছাত্রদের নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন তখন পুলিশ এসে লাঠি চার্জ করে এবং গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। ‘কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল।’ সাথে আরো সত্তর-পঁচাত্তরজনকে বেঁধে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে (পৃ. ৯২,৯৩)।

তেরো
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখিত ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ এর পূর্বাপর ঘটনা প্রবাহে বঙ্গবন্ধু সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভূমিকা ও সরকারের অবস্থান। ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানের  জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ‘উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ করার ঘোষণা দিলে ভাষা-আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু তখন নিরাপত্তা আইনে বন্দি। অসুস্থতার জন্য তখন হাসপাতালের কেবিনে ছিলেন। সন্ধায় ‘মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ’ দেখা করতে আসলে তাদের রাত একটার পরে আসতে বলেন এবং সঙ্গে ‘খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে’ বলেন। রাতে নেতাদের সাথে বৈঠকে আলাপ হয় এবং বঙ্গবন্ধু সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে বলেন। বঙ্গবন্ধু পর দিন আবার আসতে বলেন কারন বঙ্গবন্ধু মনে হয়েছিল তাকে হাসপাতাল থেকে ‘শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে’ যাতে ‘হাসপাতালে বসে রাজনীতি’ করতে না পারে (পৃ. ১৯৭)।মূলত ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু যেন জেল থেকে নেতৃত্ব বা দিকনির্দেশনা দিতে না পারে তাই তাঁকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে প্রেরণ করা হয়। ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরে পূর্বে ‘রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষধ’, ‘রাষ্টভাষা দিবস’ ও আমরণ অনশনের ঘোষণা ‘বাইরে সমস্ত জেলায়’ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে পাঠানো হয়েছিল।

চৌদ্দ
পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমরণ অনশন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে ফরিদপুরে আনার সময় রাতে জাহাজ ঘাটে নেতাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘জীবনে আর দেখা না হতেও পারে। সকলে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। দুঃখ আমার নাই। একদিন মরতেই হবে, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে” (পৃ. ২০০)। অনশনের দুই দিনের মধ্যে অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।চার দিন পর নল দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি হতে ২৭ ফেব্রুয়ারি সময়ের ভীষণ যন্ত্রণা আর ভয়াবহতার এক বর্ণনা।অবশেষে ২৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আদেশ আসে। মুক্তির আদেশ আসলেও বাইরে যাবার মতো শক্তি বঙ্গবন্ধুর শরীরের অবস্থা ছিল না। সারা রাত সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর বাবা আসেন তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য (পৃ. ২০১-২০৫)।

পনেরো
এ ধরনের শারীরিক অবস্থার মধ্যেও ২১শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা নিয়ে সময় কাটান। ঢাকায় গন্ডগোল আর সাধারন ছাত্র-সমাজের উপর গুলি বর্ষনের সংবাদে তিনি বিচলিত  ছিলেন। ফরিদপুরেও হরতাল ও শোভাযাত্রা হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা জেলগেট পর্যন্ত শোভাযাত্রা করে আসে। স্লোগান দিয়েছিল, ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষন করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ সহ আরো অনেক স্লোগান (পৃ. ২০৩)। বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেনি ১৪৪ ধারা লংঘনের জন্য এভাবে নির্বিচারে সাধারন ছাত্র-সমাজের উপর নির্বিচারে গুলি চালাবে। ভাষা আন্দোলনের স্ফুলিং দ্রুত ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। বঙ্গবন্ধু মনে করে মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিনামদর্শিতার কাজ করল’ (২০৩)। মূলত ভাষা আন্দোলনের মধ্যে পরবর্তী সকল আন্দোলনের শিকড় গাঁথা ছিল। আবার বলা যায়, রাষ্ট্রভাষা দাবির মধ্যেই বীজ বপন করা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও মমতাবোধ শুধু ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবন্ধ ছিল না। এ প্রসঙ্গে হারুন-অর-রশিদ স্যার তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ’ বইটিতে বলেন, ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর বিশিষ্ট ভূমিকা পালন আকস্মিক ছিল না। বাংলা, বাঙালি আর বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ নতুন নয়। বাঙালি সত্তা ছিল তাঁর রক্ত কণিকায়। ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সমস্ত ভারতবর্ষেও মুসলিম লীগপন্থি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশনে উর্দুর পরিবর্তে বাংলায় শ্লোগান দিয়েছিলেন (পৃ. ৫২)। ১৯৪৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণ কালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ কয়েকজন উর্দু ভাষাভাষী এডভোকেটের সাথে করাচীর পথে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা (পৃ. ২১৭)। ১৯৫২ সালে চীনের শান্তি সম্মেলনে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলায় (পৃ. ২২৮)। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করে নিতে ও বাংলার নাম পরিবর্তনের বিরোধীতা করে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন (পুনর্পাঠ ৪২) বঙ্গবন্ধু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ কে প্রথম সুযোগেই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীনতার পর পর ভারত থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাসের জন্য এসেছিলেন (পুনর্পাঠ ৪২)। ২৫ সেপ্টেম্বও ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। এ সবই ছিল তাঁর ভাষার প্রতি হ্রদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। তাই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। (সমাপ্ত)

লেখক  জ্যেষ্ঠ সহ সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।

আরও পড়ুন