• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০১৯, ১০:২০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৫, ২০১৯, ১০:৩২ এএম

গাইবান্ধা সদর হাসপাতাল এক জীবন্ত মৃত্যু কূপ

গাইবান্ধা সদর হাসপাতাল এক জীবন্ত মৃত্যু কূপ

গাইবান্ধা জেলার সদর হাসপাতাল যেন বাংলাদেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ময়লা, আবর্জনা আর রোগ জীবাণুর এক অভয়াশ্রম।

এই হাসপাতালটিতে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ছুটে আসেন ভালো সেবা পাওয়ার জন্য, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার আশায়। কিন্তু এই হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুধু রোগীই না, হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগীর স্বজন এবং দর্শনার্থীরাও অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ গাইবান্ধাবাসীর।

উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে স্থাপিত ৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয় ২০০৫ সালে। ২০০ শয্যায় উন্নীত হয় ২০১৪ সালে। ২০০ শয্যার প্রশাসনিক অনুমোদন পেলেও জনবল অনুমোদন পায়নি এখনো এই হাসপাতালটি। এখন যে অবকাঠামো রয়েছে তা মাত্র ৫০ শয্যার অবকাঠামো বিশিষ্ট।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও নেই এই হাসপাতালে। প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছর পরেও স্বাস্থ্যসেবার মান অতি নিম্নমুখী এবং হাসপাতালের পরিবেশের দিকে দৃষ্টিপাত করলে অবর্ণনীয় করুন চিত্র ফুটে ওঠে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দিন দিন ময়লা, নোংরা, দুর্গন্ধ ও আবর্জনায় অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে হাসপাতালের পরিবেশ। ইমারজেন্সি গেট পার হতে না হতেই হাসপাতালের দুর্গন্ধময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বমি আশার উপক্রম হয়ে পড়ে একজন সুস্থ সবল মানুষেরও।

সদর হাসপাতালের ভেতরে প্রায় প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের পাশেই ময়লা আবর্জনায় ভরা নোংরা পরিবেশ। ময়লা আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে রোগীর ফেলে দেয়া খাবার, মলমূত্র ও রোগীর ব্যবহার্য বর্জ্য দিয়ে ভরে গেছে  হাসপাতালের বারান্দা ও বাথরুম। 

হাসপাতালের নিচতলার ১ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডের ( বি–৮) রোগী পশ্চিম কুপতলা গ্রামের আনোয়ার মিয়া বলেন, এই হাসপাতালে যেদিন থেকে বাবাকে ভর্তি করেছি, সেবা তো দূরে থাক এখানে দুর্গন্ধের জন্য টিকে থাকাটাই বেশি কষ্টের।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের আরেক রোগী নুরুল আমিন মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণে ভর্তি আছে ১ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডের ২নং বেডে। তার স্ত্রী জোলেখা বেগম অভিযোগ করে দৈনিক জাগরণকে বলেন, যেদিন থেকে ভর্তি আছে আমার স্বামী সেদিন অনেকগুলো পরীক্ষা দিয়েছিল। সব পরীক্ষা করেছি বাহির থেকে। প্রস্রাবের জন্য ক্যাথেটারও কিনেছি টাকা দিয়ে। একদিন পার হয়ে গেলেও পরীক্ষার রিপোর্ট দেখতে কোন ডাক্তার আসেনি। 

অন্যদিকে, যেসব যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, সেগুলো পর্যন্ত অপরিচ্ছন্ন এবং অস্বাস্থ্যকর স্যাঁত স্যাঁতে পরিবেশের মধ্যে রাখা হয়। ড্রেসিং রুমের সামনেই দেখা গেল, এসব ময়লা আবর্জনার ওপর ভন ভন করে মশা, মাছি ও বিভিন্ন ধরনের পোকা মাকড়সহ ইঁদুর, কুকুর, বিড়াল ঘোরাঘুরি করছে।

বেশ কিছু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, রোগীকে যে সব ওষুধপত্র দেয়া হয় সেগুলোও ফেলে রাখা হয় নোংরা ও ময়লা জায়গায়। রোগীদের দেয়া বালিশ-কম্বল সমস্ত জিনিস চরম অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা। একজন রোগীর ব্যবহৃত মলমূত্র লাগানো অথবা বমি করা বেডে বাধ্য হয়ে অন্য রোগীকে থাকতে হয়। হাসপাতাল পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের জন্য জনবল থাকলেও, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায়কেই দায়ী করেছেন হাসপাতালে থাকা রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা। বিভিন্ন ওয়ার্ডের টয়লেটগুলো পরিদর্শন করে দেখা যায়, দুর্গন্ধময় অসহ্য নোংরা পরিবেশ। কোনো কোনো টয়লেটের প্যান ও আশপাশের কালচে পড়া দেখে মনে হয়, যুগ যুগ ধরে তাতে কোনো প্রকার হারপিক, এসিড বা ফিনাইল ব্যবহার করা হয়নি। বাথরুমের গোসলখানার ভিতরে পঁচা নোংরা ড্রামের উপর একযুগের পুরনো ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও অন্যান্য ব্যবহৃত বর্জ্য দিয়ে ভরে আছে। কমপক্ষে এক যুগের মধ্যে এখানে কেউ গোসল বা হাতমুখ ধোয়ার জন্য আসেনি একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। 

কয়েকজন রোগীর স্বজন জানান, টয়লেটের যে অবস্থা তাতে বসাই যায় না। দরজা ভাঙা, ছিটকানি নেই। বিভিন্ন ধরনের পোকা-মাকড়ে ভর্তি। দেখেই টয়লেটে যাওয়ার রুচি হয় না।

শুধু টয়লেট বা আশপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবেশই নয়, রোগীর খাবার যেখানে দেয়া হয় সেখানকার অবস্থাও শোচনীয়। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি হয় খাবার। তা ছাড়া খালি হাতেই তুলে দেয়া হয় ভাতসহ অন্যান্য সবজি।

যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবর্জনাগুলোর কারণে শুধুই রোগী বা তার স্বজনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তাদের দেখতে আসা শুভাকাঙ্ক্ষীরাও। 

বেশ কয়েকজন রোগীর দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, মাত্র কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার জন্য আমরা রোগী দেখতে আসি। কিন্তু এতেই আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। হাসপাতালে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। বমি চলে আসে, দুর্গন্ধে টেকা যায় না এমন অস্বাস্থ্যকর বাজে পরিবেশে। 

হাসপাতাল সম্পর্কে ভুক্তভোগী ব্রিজরোডের মো.আকাশ মিয়া দৈনিক জাগরণকে বলেন, এই হাসপাতালের নোংরা আবর্জনা আর মানুষের মলমূত্র পায়ে মেখে ওয়ার্ডের মধ্যে এমনকি রোগীর বিছানাতেও ঘুরে আসে ভয়ংকর সব জীবাণু। 

দুর্গন্ধময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্বরত ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের জনবল কম। তারপরও যতটুকু ন্যূনতম সেবা বা চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন তা আমরা দিতে পারছি না। আমাদের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা যদি প্রতিদিন তাদের নিয়মিত দায়িত্ব পালন করতো, তাহলেও এমন বীভৎস পরিবেশের সৃষ্টি হতো না। তাছাড়া হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ও এ ব্যাপারে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হাসপাতালের পরিচালক (তত্ত্বাবধায়ক) ডা. মাহফুজার রহমানকে বারবার ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। 

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন এবিএম হানিফ দৈনিক জাগরণকে বলেন, সদর হাসপাতাল আমার দায়িত্বের মধ্যে নেই। তবুও আমি আমার জায়গা থেকে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে কথা বলবো যাতে কিছুটা উন্নতি করা যায়।

টিএফ

আরও পড়ুন