• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯, ০৫:৩১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯, ০৫:৩১ পিএম

ইউএনওর প্রচেষ্টায় নাগরিকত্ব পেল শরীয়তপুরের বেদে সম্প্রদায়

ইউএনওর প্রচেষ্টায় নাগরিকত্ব পেল শরীয়তপুরের বেদে সম্প্রদায়

শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহাবুর রহমান শেখের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শরীয়তপুরের মুন্সিরহাটে বসবাসরত বেদে সম্প্রদায় পেয়েছে তাদের নাগরিকত্ব। তারা যাযাবর জীবন ছেড়ে এখন স্থায়ী বসতি গড়তে শুরু করেছে।

জানা যায়, শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের মুন্সির হাটে ১২০টি বেদে পরিবার বসবাস করে। এই ১২০ পরিবারের মধ্যে ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় আড়াই শতাধিক মানুষ তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে ভোটার হয়েছেন। আর তাদের ছেলেমেয়েরা পেয়েছে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় লেখাপড়া করার সুযোগ।

ইতোমধ্যে অনেক বেদে তাদের আদি পেশা ছেড়ে দিয়ে চাকরি করছে। অনেকে মুদি দোকান, চায়ের দোকান, মাছের ব্যবসা, কাপড়ের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। খুব দ্রুত তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটছে। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে এলাকার মানুষের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে তারা অনেক সচেতন হয়েছে।

সরেজমিনে জানা যায়, ২৫-৩০ বছর আগে বেদে সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর থেকে শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের কীর্তিনাশা নদীর তীরে অবস্থিত মুন্সিরহাট গ্রামে বসতি গড়েন। সেখান থেকে তারা এলাকার সাপধরা, সাপেকাটা রোগীর বিষ নামানো, বানর নিয়ে সাপ খেলা দেখানো, শিঙা লাগিয়ে বাত ব্যথার বিষ নামানো, দাঁতের পোকা ফেলানো, পুকুর ডোবায় হারানো সোনা-রুপার গহনা তোলাসহ তাবিজ-কবজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে তারা শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের মুন্সিরহাট গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে জমি কিনে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে।

বেদে সরদার আব্দুস ছাত্তার বলেন, এখানে আমার অধীনে ১২০টি পরিবার রয়েছে। তারা সবাই আমাকে মেনে চলে। আমাদের বড় শক্তি হচ্ছে ঐক্য। আমরা একতাবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করি। আমাদের এখানে পুরুষের তুলনায় মহিলারা বেশি পরিশ্রম করে। পুরুষরাও পরিশ্রম করে, তবে তুলনামূলক কম। অবসর সময় পুরুষেরা তাস খেলে এবং নারীরা লুডু খেলে সময় কাটায়। তিনি আরও বলেন, সাপ খেলা, ঝাড়-ফুঁক দিয়ে তাবিজ-কবজ বিক্রির ব্যবসা এখন মন্দা। মানুষ আর আগের মতো এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। তাই অনেকই বিকল্প ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তিনি বলেন, বেদে পরিবারগুলোতে আড়াই শতাধিক ভোটার রয়েছে। গত নির্বাচনের সময় তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। এ বছর ভোটার হালনাগাদের সময় অনেকেই নতুন ভোটার হওয়ার জন্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর এসব সম্ভব হয়েছে সদরের ইউএনও মাহাবুর রহমান স্যারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।

বেদে পরিবারের সন্তান অমিত হোসেন এবং জাহিদুল ইসলাম বলে, ‘আমরা ডোমসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। নদী পার হয়ে আমাদের স্কুলে যেতে হয়। তাই প্রতিদিন স্কুলে যাই না। আমাদের এপারে যদি একটি স্কুল থাকত তাহলে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম।’

বেদে পরিবারের সদস্য আরিফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাপ-চাচারা যখন নৌকায় চরে যাযাবর জীবন যাপন করতেন, তখন আমরা লেখাপড়া করার সুযোগ পাইনি। ডোমসারের স্থানীয় বাসিন্দা হয়ে আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমার এক ভাই বর্তমানে আনসারে চাকরি করছে। শিক্ষার অভাবে আমাদের সমাজ অনেক পিছিয়ে আছে। তাই আমাদের সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে শিক্ষিত করব।’

বেদে পরিবারের আরেক সদস্য আল-আমিন বলেন, ‘মানুষের সোনা-রুপার গহনা পুকুর বা ডোবায় পড়ে গেলে তা আমরা তুলে দিই। এ কাজে অনেক পরিশ্রম হয়। আমাদের সন্তানদের এ কাজ করতে দেব না। তাদের লেখাপড়া শেখাব।’

সাপুড়ে আফসার সরদার বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষের কাজ হিসেবে সাপ খেলা দেখাই। আমার কাছে কালি জাইত, খইয়া জাইত, গোখরা, অজগরসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ আছে। সাপগুলোকে দুধ, ব্যাঙ, মাছ, মুরগি ও কবুতরের বাচ্চা খাওয়াতে হয়। তাতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু সেই হিসেবে খেলা দেখিয়ে খুব বেশি আয় হয় না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। ভাবছি এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় যোগ দেব।’

এ ব্যাপারে ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. চান মিয়া মাদবর বলেন, বেদে সম্প্রদায়ের অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। মেম্বারের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা যেন সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত হতে পারে সে জন্য আমরা প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখছি। নদী পার হয়ে যেন শিক্ষার্থীরা খুব সহজে প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারে, তার জন্য তাদের নৌকার ব্যবস্থা করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। বেদেরা তাদের মূল পেশা ছেড়ে লেখাপড়া করে বিকল্প পেশার সন্ধানে ছুটছে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করছে।’

এ ব্যাপারে শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহাবুর রহমান শেখ বলেন, বেদে সম্প্রদায়দের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। তাদের স্থায়ী করার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করেছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষা উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন ও সমাজসেবার পক্ষ থেকে নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ ও পুরুষদের আইসিটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সাবলম্বী করতে বিভিন্ন ধরনের ঋণ দিচ্ছে। তাদের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সরকার কাজ করছে।

এনআই

আরও পড়ুন