• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মে ১০, ২০২১, ০৮:২০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১০, ২০২১, ০৮:২০ পিএম

‘বিধিনিষেধের ঈদ’ ঘিরে বেপরোয়া ছিনতাইচক্র

‘বিধিনিষেধের ঈদ’ ঘিরে বেপরোয়া ছিনতাইচক্র

প্রতি বছর ঈদ এলেই রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারী চক্র। গত বছর থেকে করোনার কারণে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি বিধিনিষেধ। ফলে ঈদের আগ মুহূর্তে ফাঁকা রাস্তায় সাধারণ মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা।

কখনো ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান, কখনো-বা অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে লুটে নেওয়া হচ্ছে সঙ্গে থাকা সবকিছু। দিন কিংবা রাত—যখন তখন ফাঁকা রাস্তায় ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। স্বেচ্ছায় টাকা-পয়সা না দিলে প্রাণও হারাতে হচ্ছে অনেককে।

গত ৫ মে ভোরে রাজধানীর মতিঝিল বাস ডিপোর সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন সুনিতা রানী দাস (৫০) নামের এক নারী। বোনের ছেলেকে নিয়ে রিকশায় করে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীরা প্রাইভেটকারে করে এসে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তার ব্যাগ নিয়ে যায়। এ সময় রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান সুনিতা। পরে সকাল ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারান তিনি।

এর ঠিক একদিন পর ৬ মে খিলক্ষেত এলাকার কুড়িল ফ্লাইওভারে গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় সুভাষ চন্দ্র সূত্রধর (৩২) নামের এক প্রবাসীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ছুটি শেষে ৯ মে কর্মস্থল দুবাইয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল সুভাষের। এর জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। পুলিশের ধারণা, ছিনতাইকারীরা টাকা-পয়সা লুট করার পর তাকে হত্যা করে ওই ফ্লাইওভারের ওপর ফেলে গেছে।

শুধু সুনিতা বা সুভাষ নয়, রাজধানীতে হরহামেশাই ঘটছে এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা। তবে হত্যার মতো বড় ঘটনা না-ঘটলে বেশির ভাগ সময়ই থানায় কোনো মামলা করেন না ভুক্তভোগীরা। অনেকে আবার ঝামেলা এড়াতে শুধু মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ বা আইডি কার্ড হারানোর বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। যার কারণে সহজে ছিনতাইকারীদের ধরতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীতে এমন তিন শতাধিক স্থান রয়েছে যেখানে ঈদ এলেই বেড়ে যায় ছিনতাইয়ের ঘটনা। চলতি মাসে সেসব স্থানে অন্তত ৫০টি মতো ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। তবে এগুলোর বেশির ভাগই পুলিশের খাতায় আসেনি। এছাড়া বর্তমানে রাজধানীতে সক্রিয় ছিনতাইচক্র রয়েছে ১০টির ওপর। যেগুলোর প্রতিটিতে ১২ থেকে ১৫ জন করে সদস্য রয়েছে। এসব চক্রের মধ্যে রয়েছে গামছা পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, প্রাইভেটকার চক্র।

বিশ্লেষকদের মতে, ঈদে মানুষের হাতে কমবেশি টাকা থাকায় ছিনতাইকারীরা প্রতি বছর এই সময়টায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়া এবার চলমান ‘লকডাউনে’ রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা থাকায় ছিনতাইচক্র বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে এবার দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ ও ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় টার্মিনাল ও স্টেশনগুলোতে অন্যবারের মতো অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টি দৌরাত্ম্য তেমন নেই। এর বদলে এখন রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গামছা পার্টি, মটরসাইকেলচক্র ও প্রাইভেটকারচক্র।

এদিকে ছিনতাইয়ের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে মাঠে সক্রিয় রয়েছে র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সুভাষ ও সুনিতার ঘটনার ঠিক একদিন পরেই ৭ মে দুপুরে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় ছিনতাইয়ের সময় দুই ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই সময় তাদের কাছ থেকে একটি মোটরসাইকেল, একটি ছুরি ও ছিনতাইয়ের ৫০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম জাগরণ অনলাইনকে বলেন, “আমাদের প্রতিটি থানা ছিনতাই রোধে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বের কোনো কমতি নেই। ছিনতাইয়ের কোনো মামলা হলে সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীকে শনাক্তসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি আমাদের টহল পুলিশ, মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) বিভিন্ন ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে। বিগত বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এই বছর ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেক কম।”

ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (অপরাধ) শাহ আবিদ হোসেন জাগরণকে বলেন, “সম্প্রতি মতিঝিল ও গুলশানে দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ কাজ করছে। ইতোমধ্যে ছিনতাইকারীদের শনাক্তও করা হয়েছে। ছিনতাই রোধে পুলিশের সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি করোনার কারণে আলাদা করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”

শাহ আবিদ আরো বলেন, “যারা এই কাজগুলো করে তাদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। মাদক গ্রহণের কারণে এদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এর সঙ্গে আরো অনেক বিষয় জড়িত আছে। যেমন : কাজ হারানো। তবে আমাদের দিক থেকে পুলিশ ছিনতাই দমনে সম্পূর্ণ সক্রিয় রয়েছে। যখনই এই ধরনের ঘটনা সামনে আসে, সঙ্গে সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।”

এদিকে প্রতিবার ঈদ এলেই রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ে বলে স্বীকার করেছেন র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, “এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে। ঈদের আগে মানুষ কেনাকাটা করতে মার্কেটে যায়। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা বাড়ে। ছিনতাইকারীরা চায়, যাকে তারা ধরবে তার কাছে যেন টাকা-পয়সা থাকে। ঈদের সময় যেহেতু মানুষ টাকা-পয়সা একটু বেশি লেনদেন করে, তাই ছিনতাইকারীরা এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।”

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরো বলেন, “বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, ইফতারের পর পর যখন রাস্তাঘাট অনেকটা খালি থাকে তখন ছিনতাইকারীরা সক্রিয় হয়। আবার কিছু চক্র সেহেরির সময় ছিনতাই কার্যক্রম শুরু করে। এই সময়ও রাস্তাঘাট পুরো খালি থাকায় ছিনতাইকারীদের কার্যক্রম বেড়ে যায়।”

ঈদ ছাড়াও ‘লকডাউনে’ কারণে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে বলে জানিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘লকডাউনের সময় হাইওয়েতে যানবাহনের চলাচল কম ছিল। এই সময় ব্যক্তিগত যানবহনের চলাচলকারীরা ছিনতাইয়ে শিকার হয়েছেন বেশি। তবে গত বছরের রোজার তুলনায় এবার ছিনতাইয়ের সংখ্যা কম।”

ছিনতাইকারী চক্রগুলোকে ধরতে র্যাব প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “আমরা নিয়মিত টহলের বাইরেও ইফতারের পরবর্তী সময়ে বা সেহেরির সময়ে আলাদাভাবে টহলের ব্যবস্থা করেছি। ঈদের মানুষ বাড়ি গেলে বিভিন্ন এলাকাও একটু খালি থাকে। তাই আমরা বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি বাড়িয়েছি।” 

তবে সাধারণ মানুষকেও আরেকটু সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, “একই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সব জায়গায় থাকা সম্ভব না। তাই সাধারণ মানুষকেও চলাচলের ক্ষেত্রে একটু সতর্ক হতে হবে।”