• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০১৯, ১১:২৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১৯, ২০১৯, ০৩:৪১ পিএম

ডেঙ্গুসহ অন্যান্য পরীক্ষায় ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের গলাকাটা ব্যবসা

ডেঙ্গুসহ অন্যান্য পরীক্ষায় ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের গলাকাটা ব্যবসা

রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয়ে রক্ত পরীক্ষায় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। এসকল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা দেশে ডেঙ্গুর মহামারীর সুযোগে অসহায় সাধারণ রোগীদের কাছে থেকে দ্বিগুনেরও বেশি টাকা নিচ্ছেন।  এসব রোগী ও তাদের বেশিরভাগ অভিভাবক অসচেতন। অভাবগ্রস্ত রোগীর কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। এ সকল পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে হচ্ছে না। নেই চিকিৎসা উপকরণ ও চিকিৎসক সঙ্কট। একারণে যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। চটকদার বিজ্ঞাপন আর নামকরা চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা। প্রকাশ্যে গলাকাটা বাণিজ্য চললেও স্বাস্থ্য প্রশাসন নির্বিকার। 

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সরকারি চিকিৎসক এবং সিভিল সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই সংশ্লিষ্টরা ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক ব্যবসা নিয়ে বসেছেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে লাইসেন্স নেয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৬৮টি। বাস্তবে কার্যক্রম চলছে ৫০ হাজারটি। রাজধানীতে লাইসেন্স করা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪০৫টি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৬৬০টি। কিন্তু ব্যবসা করছে পাঁচ হাজারের মতো। লাইসেন্স না করা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বেশিরভাগই নিয়ম-নীতি ও বিধি-বিধানকে অনুসরণ করে পরিচালিত হচ্ছে না। হাতুড়ে টেকনেশিয়ান দিয়ে চলছে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ। আয়া দায়িত্ব পালন করছে নার্সের। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের অভাব।

এদিকে রক্তসহ বিভিন্ন উপাদান পরিক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গলাকাটা ফি গুনতে হচ্ছে রোগীদের। একই রোগ সনাক্ত করার পরীক্ষার ফি ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ভেদে ভিন্ন। অথচ সরকারীভাবে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ফি সর্বনিম্ম ৮০ ও সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজিতে এই হার সর্বনিম্ম ১৫০ ও সর্বোচ্চ এক হাজার ৩০০ টাকা। বায়োকেমিস্ট্রিতে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, হিষ্ট্রোপ্যাথলজিতে সর্বনিম্ম ৫০০ ও সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা, ড্রাগ এবিউজে সব ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে ফি সাড়ে ৫০০ টাকা। থেরাপিউটিক ড্রাগের জন্য ৫০০ টাকা ও ভাইরোলজির সর্বনিম্ম ২০০ ও সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। শুধু ফি’র গড়মিল নয়, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ভেদে পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্যেরও গড়মিল হচ্ছে। একই রোগ সনাক্ত করার পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। এতে বিপাকে পড়ছেন রোগী ও অভিভাবকরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সুত্র বলছে, ক্লিনিকে সার্বক্ষণিক একজন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকার বিধান রয়েছে। নিয়োগ করতে হবে প্রশিক্ষিত টেকনেশিয়ান ও নার্স। কিন্তু বেশিরভাগ ক্লিনিকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকার বিষয়টি কাগুজে কলমে সীমাবদ্ধ। অনেক ক্লিনিকে পল্লী চিকিৎসক সার্বক্ষণিক চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্যাথলজি বিভাগে কর্মরতদের বেশিরভাগই প্যারামেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। এরা খন্ডকালীন চাকরি করছেন। ওস্তাদ ধরে কাজ শেখা অনেক কর্মী পুরো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। সরকারী অনুমোদন প্রাপ্ত সার্টিফিকেটধারী দক্ষ টেকনিশিয়ানের সংখ্যা নগন্য। স্বল্প শিক্ষিত মেয়েদের আয়া কাম নার্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সুত্রমতে, এর প্রধান কারণ কম টাকায় জনবল খাটানো। ডায়গনষ্টিক ও ক্লিনিক মালিকদের এই মন-মানসিকতার কারণে এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবার মান নগণ্য। সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করা হচ্ছে চিকিৎসকদের নাম ব্যবহারে। প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে বিশেষজ্ঞ ও রকম রকম ডিগ্রীধারী চিকিৎসকদের নাম রয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপালন করছে অন্য চিকিৎসক। এসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাম ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে মালিকদের কাছে থেকে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে। এসব কারণে ইতোমধ্যেই মরণফাঁদ হিসেবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি পেয়েছে একাধিক ক্লিনিক।

অভিযোগ রয়েছে, বেশির ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরতদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে সিভিল সার্জন থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা- কর্মচারীদের। প্যাথলজিক্যাল বিভাগকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দিচ্ছে না সরকারী হাসপাতালে কর্মরত কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। কারণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে কৌশলে অকোজে ঘোষনা করা হচ্ছে। অথচ এসব যন্ত্রপাতি লাখ লাখ টাকায় কিনেছে সরকার। বছর পর বছর কথিত অকেজো হয়ে পড়ে থাকলেও সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। সুত্রমতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক থেকে বিশেষ সুবিধা পায় সরকারি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। এজন্য নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য রোগীকে নির্দেশ দেন। এর বাইরে অন্য কোন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে করা পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট গ্রহণ করেন না চিকিৎসক। চিকিৎসকের সুনাম ভেদে এই কমিশনের হার হেরফের হয়। এজন্য একই ধরনের পরীক্ষার জন্য একেক সেন্টারে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি।

এদিকে গলাকাটা ফি গুনতে হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের। এ ধরনের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিষয়ে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত এবং যথাযথ তদারকির অভাবে এদের দৌড়াত্ম্য কমছে না। মাঝে-মধ্যে  প্রশাসন ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) অভিযান পরিচালনা করছে, তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। জরিমানা গুনে অভিযানের পরের মূহর্তেই আগের চেহারায় ফিরছে এসব ব্যবসায়ীরা। দেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এ কথা জানান মন্ত্রী।

অপরদিকে সম্প্রতি বর্ষা মৌসুমে রাজধানীসহ বন্যা আক্রান্ত প্রায় ১৭ জেলায় ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চিকিৎসকের মতে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরে অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে দেহে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আর এ পানিশূন্যতায় কোষের ভেতরের তরল পদার্থ কমে যায়, কোষের চারপাশের রক্তনালিতে চাপ পড়ে। ফলে রক্তনালিতে চাপে দেহের ভেতর শুরু হয় ইন্টারনাল ব্লিডিং বা রক্তক্ষরণ। আর এ জন্য রক্তের প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা কমতে
থাকে। এই প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা কমার কারণে দেহে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। ফলে রক্তক্ষরণ আরও বাড়তে থাকে ও রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। আর দেহে এভাবে প্লেটলেট কমতে থাকলে একসময় শক সিনড্রোমের কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটে। তাই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তকে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের প্লেটলেটের মাত্রা জানতে হবে ও প্রয়োজনে বাইরে থেকে রোগীর দেহে প্লেটলেট সরবরাহ করতে হবে।

এইচ এম/বিএস 

আরও পড়ুন