বরগুনার রিফাত হত্যাকাণ্ড

পৈশাচিক নৃশংসতা চালানো সেই ১২ জন

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ২৮, ২০১৯, ১১:৫৭ এএম পৈশাচিক নৃশংসতা চালানো সেই ১২ জন
বাঁ থেকে উপরে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী, ডান থেকে উপরে রিসাদ ফরাজী ও চন্দন -ছবি : জাগরণ

বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে শাহনেওয়াজ রিফাতকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বরগুনা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন নিহতের বাবা মো. আ. হালিম দুলাল শরীফ।

দায়েরকৃত মামলায় হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয়া স্থানীয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী নয়ন উরফে নয়ন বন্ডসহ মোট ৪ জনকে মূল আসামি করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল হওয়া, হত্যাকাণ্ডের ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে নয়ন ও তার প্রধান সহযোগী রিফাত ফরাজীকে প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে রিফাত শরীফকে কোপাতে দেখা যায়। তবে নিহত রিফাতের বাবার দাবি, এ হত্যাকাণ্ডে আরও অনেকে অংশ নেয়। তারা ঘটনাস্থল বরগুনা কলেজের ভেতর থেকে রিফাতকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় বের করে আনে। তারপর সেখানে তার ছেলেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে নয়ন ও রিফাত ফরাজী।

মামলার তালিকার ক্রম অনুযায়ী আসামিরা হচ্ছে- 
মূল আসামি- ৪ জন; সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) (২৫), মো. রিফাত ফরাজি (২৩), মো. রিশান ফরাজি (২০) ও চন্দন (২১)।

মামলার অপর ৮ আসামি হচ্ছে- মো. মুসা (বয়স অজ্ঞাত), মো. রাব্বি আকন (১৯), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রায়হান (১৯), মো. হাসান (১৯), রিফাত-২ (২০), অলি (২২) ও টিকটক হৃদয় (২১)। এছাড়া আরও ৫ থেকে ৬ জন অজ্ঞাত আসামি হিসেবে মামলার এজহারভুক্ত হয়েছে।

এক নজরে দেখে নেয়া যাক কারা এই ১২ আসামি যারা এমন একটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটালো-

সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড
বরগুনা পৌর শহরের ডিকেপি রোড এলাকার মৃত সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড)। শহরের কলেজ পাড়ায় ছিনতাই, ছাত্রদের মুঠোফোন জিম্মি করে টাকা আদায়, ছোটখাটো মারমার, ছিচকে চুরি থেকে তার অপরাধ প্রবণতা শুরু হলেও ২০১৭ সালে পুলিশি অভিযানে নয়নের কলেজ রোডের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ তাকে আটক করে পুলিশ। এরপরই নয়ন নামটি আলোচনায় চলে আসে। ওই মামলায় জামিনে আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে নয়ন। জড়িয়ে পড়ে নিয়মিত মাদকব্যবসায়। এই সময় একটি সংঘদ্ধ অপরাধী গ্রুপ গড়ে তোলে নয়ন। সহযোগী হিসেবে বরগুনা পৌরসভার ৪নম্বর ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি সড়কের দুলাল ফরাজীর দুই ছেলে রিফাত ফরাজী ও তার ছোটভাই রিশান ফরাজী সেই দলে ঘেষে নয়নের সহকারী হিসেবে।

মূল নাম সাব্বির আহমেদ নয়ন হলেও কর্মকাণ্ডের জন্য রহস্য উপন্যাসের চরিত্র জেমস বন্ডের নাম নিজের নামে জুড়ে দেয় নয়ন। হয়ে ওঠে ‘নয়ন বন্ড’। রিফাত ফরাজী ও অন্যদের সহযোগিতায় শহরজুড়ে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল নয়ন। বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে ফের অপরাধে তৎপর হয় সে। চুরি ছিনতাই লুটপাট, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে নয়নের বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় অন্তত ৮টি মামলা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

নিহত রিফাতের আত্মীয় ও কয়েকজন বন্ধু জানান, ১ বছর আগে বাকিতে সদাই বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় বিকেবি সড়কের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নয়া মিয়ার পা ভেঙে দেয় নয়ন। এর কিছুদিন পর তার বাসা থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকার ইয়াবা এবং দেশীয় ধারালো অস্ত্র উদ্ধার ও তাকে গ্রেফতার করে বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এই মামলায় কিছুদিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে নয়ন।

কোনও রাজনৈতিক পদ-পদবি না থাকলেও তার মূল শক্তিতে পরিণত হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এবং বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে নিজেদের জাহির করে বেড়ানো রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী দুই সহদোর ভাই। নিজেদের জাহির করে বেড়ালেও মাদকাসক্ত হওয়ায় পরিবারের কারো কাছেই গ্রহণযোগ্যতা নেই রিফাত ও রিশান ফরাজীর।

রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী
রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ২ ও ৩নং আসামি। একসঙ্গেই তাদের অপরাধ জগতে পদার্পন। বরগুনা পৌরসভার ধানসিঁড়ি সড়ক এলাকার দুলাল ফরাজীর বড় ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। নয়ন বন্ডের ডান হাত বাম হাত হিসেবে কাজ করতো এরা দুই ভাই। মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসাই ছিল তাদের মূল পেশা।

এদের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাই ও ছাত্রদের মেসে ঢুকে মুঠোফোন কেড়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক যখম করেন রিফাত ফরাজী। নয়ন গ্রুপের এই দুই সক্রিয় সদস্য অল্প বয়সেই হয়ে ওঠে এলাকার ত্রাস।

এছাড়াও এই গ্রুপের নিয়মিত সদস্য ছিল আমতলার পাড় এলাকার চন্দন, বরগুনা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি রোড এলাকার মো. মুসা, কেওড়াবুনিয়া এলাকার কালাম আকনের ছেলে রাব্বি আকন, কলেজিয়েট স্কুল রোড এলাকার মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, কেজি স্কুল এলাকার রায়হান, একই এলাকার মো. হাসান, সোনালী পাড়া এলাকার রিফাত, একই এলাকার অলি ও টিকটক হৃদয়।

এলাকাবাসীর বরাতে পাওয়া তথ্যমতে, নয়ন ও রিফাত দীর্ঘদিন ধরে নানা অপরাধে জড়িত থাকলেও ভয়ে মুখ খুলতো না কেউ। বারবার আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়তো এই চক্র। গত বুধবার রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রিফাত ও নয়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করে ভুক্তভোগীরা।

এই দুই গুণধর ভাইয়ের অপরাধের জেরে তাদের বাবাকে জেলও খাটতে হয়েছে একবার।

চন্দন
এ মামলার ৪ নম্বর আসামি হিসেবে অভিযুক্ত চন্দন (২১)। মামলার এজাহারে তার বিস্তারিত পরিচয় ও বাবার নাম উল্লেখ করা হয়নি। তার বাড়ি বরগুনার আমতলা পাড়। নয়ন বন্ডের সাগরেদ হিসেবে সব সময় তার সঙ্গে ঘোরাফেরা করতো চন্দন। তার নামেও এলাকায় অনেক ধরনের অভিযোগ রয়েছে। রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগের পর, এই মামলার আসামিদের বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) তাকেই প্রথম গ্রেফতার করে বরগুনা সদর থানা পুলিশ।

রিফাতের দাফনের দৃশ্য- ফাইল ছবি

 মামলার অপর ৮ আসামির সংক্ষিপ্ত পরিচয়-

মো. মুসা- মামলার ৫ নম্বর আসামি। তার বাড়ি বরগুনা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। তবে মামলায় তার বাবার নাম উল্লেখ করা হয়নি। রিফাতকে হত্যার পর থেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে সে।
মো. রাব্বি আকন (১৯)- মামলার ৬ নম্বর আসামি। তার বাবার নাম কালাম আকন। বাড়ি বরগুনার কেওড়াবুনিয়ায়। 
মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯)- মামলার ৭ নম্বর আসামি। তার বাড়ি বরগুনার কলেজিয়েট স্কুল সড়কে। ঘটনার পর থেকেই সে পলাতক রয়েছে। নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর সঙ্গে সে এলাকায় ঘোরাফেরা করতো বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।
রায়হান (১৯)- মামলার ৮ নম্বর আসামি। বরগুনা কেজি স্কুল সড়কে তার বাসা। ঘটনার পর থেকেই সে পলাতক।
মো. হাসান (১৯)- মামলার ৯ নম্বর আসামি। শহরের কলেজ রোড এলাকায় বাসা। বাবার নাম এখনও জানা যায়নি। ঘটনার পর থেকেই সে পলাতক।
রিফাত-২ (২০)- রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় এই রিফাতও ১০ নম্বর আসামি। তার বাড়ি সোনালী পাড়ায়। তবে ঘটনার পর থেকেই সে এলাকা ছাড়া। 
অলি (২২)- সোনালী পাড়ারই আরেক যুবক অলি এই হত্যা মামলার ১১ নম্বর আসামি। হত্যাকাণ্ডের সময় রিফাত শরীফকে বরগুনা কলেজ থেকে টেনে বের করে আনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী গ্রুপের অন্যতম সদস্য ও তাদের সহযোগী। ঘটনার পর থেকেই পলাতক। 
টিকটক হৃদয় (২১)- মামলার ১২ নম্বর আসামি। তার বিষয়ে এখনও কিছু জানা সম্ভব হয়নি।

এসকে/একেএস

আরও সংবাদ