পাওনা আদায়ে ‘প্রশাসক’ গ্রামীণফোন ও রবিতে

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০১৯, ০৮:২৫ পিএম পাওনা আদায়ে ‘প্রশাসক’ গ্রামীণফোন ও রবিতে

পাওনা পরিশোধে বার বার নোটিশ দেয়া সত্ত্বেও অর্থ পরিশোধ না করার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) কর্তৃক বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবিতে প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়।

বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) এই অনুমোদন দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৮০ কোটি এবং রবির কাছে বিটিআরসির পাওনার পরিমাণ ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

প্রশাসক নিয়োগের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিটিআরসি অপারেটর দুটিতে প্রশাসক বসানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আমরা অনুমোদন দিয়েছি। এখন বিটিআরসি ঠিক করবে প্রশাসক বা রিসিভার হিসেবে কাকে নিয়োগ দেবে, কীভাবে নিয়োগ দেবে, প্রশাসকের কোনও সহযোগী থাকবে কি- না ইত্যাদি।

তিনি জানান, প্রশাসকের দায়িত্ব হবে মূলত শুধু টাকা তোলা। বিটিআরসি কমিশন বৈঠকের সিদ্ধান্ত শেষে গত মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) প্রশাসক নিয়োগের চিঠি টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠানো হয়।

জানা গেছে, পাওনাটা ১৯৯৭ সাল হতে। এ সময়ের মধ্যে নানাভাবে মামলা-মোকদ্দমা, টালবাহানা, দেন-দিচ্ছি-দেবো এইসব করতে করতে বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত এসেছে। গত জানুয়ারি হতে অপারেটর দুটির সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। সেখানে কেউ কোনওভাবে জড়িত হওয়ার আগেই আমরা বলেছি একটা টোকেন অ্যামাউন্ট দিয়ে আপনারা আলোচনায় বসেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোম্পানি দু’টি এই প্রস্তাবে কোনও ধরনের সাড়া দেয় নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এমনকি সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের উদ্যোগের বৈঠকেও চূড়ান্ত করা হয়েছিল, টোকেন মানি হিসেবে গ্রামীণফোন দেবে ২০০ কোটি আর রবি দেবে ৫০ কোটি। এটি যদি দেয়া হতো তাহলে দুই পক্ষে অডিটর ডেকে নেগোশিয়েশনে যাওয়া যেত। এটিতে তারা রাজি হয় নি।

বিটিআরসির পাওনা দাবি যত 

বছরের পর বছর ধরে অডিট করা নিয়ে নানা জটিলতা, আইন-আদালতের পর শেষ পর্যন্ত তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে করানো অডিটে বিটিআরসি গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বলে দাবি করে।

একই সঙ্গে রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা দাবি নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির।

পাওনা দাবি আদায়ে বিটিআরসির ব্যবস্থামূলক যেসব পদক্ষেপ  

২০১৯ সালের এপ্রিলের শুরুতে পাওনা দাবি পরিশোধে অপারেটর দুটিকে চিঠি দেয় বিটিআরসি। এরপর নানা দেন-দরবার, অপারেটর দুটির ব্যাখা, আলোচনার পর কোনও পথ না বের হলে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে শুরু করে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

৪ জুলাই গ্রামীণফোনের জন্য বরাদ্দ ব্যান্ডইউথ ক্যাপাসিটি ৩০ শতাংশ এবং রবির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ব্লক করে দেয় বিটিআরসি। ততদিনে অডিট চূড়ান্তের এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তবে ব্যান্ডউইথ ব্যবহার সীমিত করায় সেটি গ্রাহকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে– বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত বাতিল করে এনওসি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। ২২ জুলাই অপারেটর দুটিকে দেয়া হয় এই নির্দেশনা। আর এনওসি বন্ধের ফলে অপারেটর দুটির সব প্যাকেজ অনুমোদন বন্ধ হয়ে যায়। নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি বন্ধ, নেটওয়ার্ক বিস্তারের অনুমোদনও বন্ধ হয়ে যায় এমনকি ব্যাংক লোন বা কোনও ক্ষেত্রে অন্য কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করাও। এতেও দাবি আদায় না করতে পেরে ৫ সেপ্টেম্বর লাইসেন্স (টুজি-থ্রিজি) কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে ১ মাসের সময় দিয়ে দুই অপারেটরকে শোকজ নোটিশ দেয় বিটিআরসি।

হঠাৎ দৃশ্যপটে অর্থমন্ত্রী

অপারেটর দুটির কিছু পদক্ষেপ ও শোকজ নোটিশ পাওয়ার পর জটিলতা আরও বাড়লে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিটিআরসির এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের দিন অর্থমন্ত্রী বিষয়টি সুরাহা করতে উদ্যোগী হন। বিটিআরসিতে হতে যাওয়া ওই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ওইদিন বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান তিন সপ্তাহের মধ্যে এই পাওনা জটিলতার একটি সুরাহা হয়ে যাবে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, দুই পক্ষকেই ছাড় দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আর কোনও বিরোধ নয়। মামলা প্রত্যাহার করবে অপারেটর ‍দুটি। তারা সবকিছু ভুলে যাবেন এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন।

এসবের বিপরীতে যা করেছে দুই অপারেটর

ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ব্লকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসে জিপি। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বিটিআরসির পাওনা দাবির বিষয়টি সুরাহা করতে আরবিট্রেশন বা সালিশের প্রস্তাব রাখে। কোনও সংবাদ সম্মেলন না করলেও রবিও এই আরবিট্রেশন বা সালিশ চায় বলে জানায়। এরপর যখন এনওসি বন্ধ হলো আবারও সংবাদ সম্মেলনে আসে জিপি। এবার বিটিআরসির এই উদ্যোগকে জবরদস্তি উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানায় তারা। এখানেও রবি কোনও সংবাদ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা না করলেও বিষয়টিতে বিবৃতি দিয়ে বলে জানায় এটি সমস্যা সমাধানে সহায়ক কোনও সিদ্ধান্ত নয়। তারা বলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে না বের করে এনওসি বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত গ্রাহক-স্বার্থসহ টেলিযোগাযোগ খাতের সব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে আদালতে চলে যায় তারা। এবার লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব দেয় দুই অপারেটর। ৩ অক্টোবর বিটিআরসিকে দেয়া ওই নোটিশে তারা বলে, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন তাই এই বিষয়ে বিটিআরসি এমন কারণ দর্শানো নোটিশ দিতে পারে না আর টেলিযোগাযোগ আইনের ২৬ ধারা বাদ দিয়ে ৪৬ ধারায় চলে গেছে বিটিআরসি। ২৬ ধারা অনুযায়ী পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি (পিডিআর) অ্যাক্টে পাওনা আদায়ে মামলা করতে পারতো বিটিআরসি। সেটি না করে ৪৬ ধারায় লাইসেন্স বাতিলের মতো পদক্ষেপে চলে গেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এখানে অন্য লাইসেন্সিংয়ের মতো আচরণ তাদের সঙ্গে করা হয় নি বলে উল্লেখ করে অপারেটর দুটি।

শেষ চেষ্টাতেও কিছু না হওয়া 

অর্থমন্ত্রীর তিন সপ্তাহের উদ্যোগে দফায় দফায় দীর্ঘ সময়ের বৈঠকে শেষে সিদ্ধান্ত হয়, শুরুতে টোকেন মানি হিসেবে গ্রামীণফোন দেবে ২০০ কোটি আর রবি দেবে ৫০ কোটি। এটি তারা দিলে দুই পক্ষে অডিটর ডেকে নেগোশিয়েশনে যাওয়া হবে। কিন্তু এতে মত দেয় নি দুই অপারেটর। এর মধ্যে তিন সপ্তাহও শেষ হয়ে যায়। ফলে এই আলোচনাও ঝুলে যায়।

এইচএস/এসএমএম

আরও সংবাদ