রোহিঙ্গা প্রবেশের ২ বছর

মানবতা মানেই দুর্বলতা নয়

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০১৯, ০৯:৪১ এএম মানবতা মানেই দুর্বলতা নয়
হুমকিতে টেকনাফ কুতুপালং উখিয়ার পরিবেশ বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য 

আজ ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট। ২ বছর আগে, ২০১৭ সালের এই দিনে মিয়ানমার সেনা সদস্যদের বর্বরোচিত হামলা, নির্যাতন, ধর্ষন ও গণহত্যার কারণে প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রোহিঙ্গারা। সরকারি হিসাবে, পর্যায়ক্রমে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে এসেছে। 

মিয়ানমারের সেনা চৌকিতে হামলা ও হত্যার অভিযোগে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। এরপর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকাশে দেখা গেছে আগুনের কালো ধোঁয়া। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা। সেই দৃশ্য দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে।

এসময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের প্রবেশের আকুতি জানায়। সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে বাংলাদেশ সরকার। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোষণা আসে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ- মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হবে। সেই নির্দেশ সীমান্তে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এদেশে ঢুকতে থাকে। নৌপথে আসতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে মারা যায় প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। ওই সময় কেউ এসেছে গুলিবিদ্ধ, কেউ এসেছে ধর্ষিত হয়ে। নির্মম নির্যাতনের শিকার অনেক রোহিঙ্গাকে দেখে হতবাক হয়েছে স্থানীয়রা। তাই নিজেদের ভাত খাইয়েছেন রোহিঙ্গা মুসলিমদের। এমনকী, নিজেদের থাকার ঘরেও ভাগাভাগি করে থেকেছেন স্থানীয়রা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বড় বড় এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসে রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্প তৈরি করে। উখিয়া-টেকনাফের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একর ভূমিতে ৩২টি ক্যাম্পে ভাগ হয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস।

গত দুই বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চাপের মুখে একপর্যায়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মতি দেয়। পর পর দুবার প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করে। তবে এ আলোচনা কোনো আলোর মুখ দেখেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সব প্রস্তুতি নিয়েও তা শুরু করা যায়নি। এর পেছনে কিছু এনজিওর প্রত্যাবাসনবিরোধী প্ররোচনাকে দায়ী করছে স্থানীয়রা।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে কী পেয়েছে বাংলাদেশ? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই উঠে আসে ভয়াবহ এক চিত্র। যার মধ্যে রয়েছে, নিজেদের জমির উপর যাদের আশ্রয় দিয়েছেন সেসব রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশিদের অপহরণ ও হত্যা করছে। পাশাপাশি বেপরোয়া আচরণে এখন আতঙ্কিত উখিয়া-টেকনাফবাসী।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের সবুজ পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসবাসের ঘর তৈরির জন্য কেটে ফেলা হয়েছে পাহাড়ি ছোট-বড় অসংখ্য গাছপালা। একসময়ের সবুজ পাহাড় এখন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে সেখানে পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন করতে গিয়ে হাতির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্রও বিনষ্ট হয়েছে। প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের রান্নার কাজে ৬ হাজার ৮০০ টন জ্বালানি কাঠ প্রয়োজন। রোহিঙ্গারা স্থানীয় পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকেই এই কাঠ সংগ্রহ করে।

গত জুলাই মাসে কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, বালুখালী ঢালা, ময়নারঘোনা, থাইংখালী তাজনিমার খোলা, হাকিমপাড়া, জামতলি বাঘঘোনা, শফিউল্লাহ কাটা ও টেকনাফের চাকমারকুল, উনচিপ্রাং, লেদা, মৌচনী, জাদিমুরা ও কেরানতলী এলাকাসহ বন বিভাগের গেজেটভুক্ত প্রায় ৬ হাজার ১৬০ একর বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে। এভাবে বসতি স্থাপনের কারণে টাকার হিসাবে সৃজিত ও প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি হয়েছে ৪৫৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। একইভাবে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বনজ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ১ হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মানবতা দেখিয়ে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দরকার হলে এক প্লেট ভাত দুভাগ করে খাব। এ মানবতাকে রোহিঙ্গারা পুঁজি করে কিছু এনজিও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উস্কানি শুনছেন। তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ মানবতাকে দুর্বলতা ভাবার কোনও সুযোগ নেই। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবসনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। কূটনীতিকরাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তারা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন।  

প্রসঙ্গত, ১৯৮০ দশকে নাগরিকত্ব আইনে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেয়। গত বছরের অক্টোবরের শুরুর দিকে ধাপে ধাপে সামরিক প্রচারণা চালিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী করে তোলা হয়। এরপর ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা ও স্থানীয় মগদের নির্যাতন শুরু হয়। ওইদিন থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আসে রোহিঙ্গারা। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে যারা বাংলাদেশে আসে, তাদের কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় দুটি ক্যাম্পে রাখা হয়। সেখানে তারা এখনো রয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আবারও নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আসে প্রায় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা এখন প্রায় ১১ লাখ।

এইচ এম/ এফসি

আরও সংবাদ