কাঁচা চামড়া রপ্তানি

চোর পালালে আমাদের বুদ্ধি বাড়ে!

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০১৯, ০৬:০৩ পিএম চোর পালালে আমাদের বুদ্ধি বাড়ে!

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! সমাজে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো কিছু হাতছাড়া হয়ে গেলে কথাটি বলা হয়। কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার সমাধান চিন্তা করা আর চোর পালালে বুদ্ধি বাড়া-  দুটোই সমান। তাৎক্ষণিক তৎপর না হওয়ায় যে ক্ষতি হওয়ার নয়, তা হয়ে যায়। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলেছে। কাঁচা চামড়ার দাম একেবারে তলানিতে পৌঁছায় হঠাৎ করে রপ্তানির ঘোষণা এ রকমই একটি ঘটনা। ঈদের পরদিন মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চামড়ার দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অনুমান।

এবার কোরবানির পশুর চামড়া গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে বিক্রি হয়েছে। দাম কমে যাওয়ায় অবিক্রীত অনেক চামড়া পচে গেছে। অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। কাঁচা চামড়ার দাম কমে নিয়ে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন। তাদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে লোকসানের মুখে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকারভোগী মাদ্রাসা-এতিমখানার শিক্ষার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় আড়তদাররা। অন্যদিকে ট্যানারি মালিকরা এ সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কাঁচা চামড়া রপ্তানি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে তাদের অভিযোগ।

এখন প্রশ্ন-  যে উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি এই রপ্তানির ঘোষণা, তা কি আদৌ অর্জিত হবে? ভুক্তভোগীরা কি এর সফল ভোগ করতে পারবেন? সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দিলেও তা রপ্তানি কিন্তু এত সহজ নয়। শুধু অনুমতি দিলেই তো আর রপ্তানি করা যায় না। কাঁচা চামড়া রপ্তানি করতে হলে যে ধরনের লজেস্টিক সাপোর্ট লাগে, তা এ মুহূর্তে প্রস্তুত নেই। অর্থাৎ এ মুহূর্তে কাঁচা চামড়া রপ্তানি করার তেমন সুযোগ নেই। তাই এ ঘোষণায় গরিব-মিসকিন, এতিম ও দুস্থরা এর বেনিফিট পাবে বলে মনে হয় না। এ ঘোষণা যে দেশের মানুষকে শুধু আইওয়াশ, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনা করে সরকার যদি দু-তিন মাস আগে এ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে গরিব-মিসকিন, এতিম ও দুস্থরা কিছুটা হলেও উপকৃত হতো। তাই সঙ্গত কারণে বলতে হয়, চোর পালিয়ে যাওয়ার পর আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বুঝি বুদ্ধি বেড়েছে! রোগী আমার যখন-তখন, ওজা ছয় মাসের পথে হলে তো চলে না।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার ঘটনা আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমরা অহরহ দেখতে পাই। দেশের মানুষ যখন মশার রাজা এডিসের হানায় আক্রান্ত, কেউ মরছে, কেউ মরার পথে। তখন ঢাকার দুই মেয়র এডিস মশার প্রজনন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তো পারেনইনি; উপরন্তু পরিস্থিতি তারা আরও ঘোলাটে করে তোলেন। আইসিডিডিআরবি মার্চ মাসে এডিসের প্রজননস্থল দেখিয়ে পদক্ষেপ নিতে বললেও তারা তাতে কর্ণপাত করেননি। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা মারার নামে তারা করেছেন লোকদেখানো তামাশা। হাইকোর্টের তিরস্কারের পরও মশা মারার নামে ভেজাল ওষুধ ছিটিয়ে নাটক করেছেন। প্রথমে একে ছেলেধরার মতো গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্যকর্মীদের ছুটি বাতিল করে নিজে ছুটিতে মালয়েশিয়া গেছেন। আবার সমালোচনার মুখে ফিরেও এসেছেন। মশা মারার নামে সংশ্লিষ্ট কর্ণধারদের এসব তামাশাই দেশবাসী অবলোকন করেছেন। 

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ যে বাড়তে পারে, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে আগাম হুঁশিয়ারিও দেয়া ছিল। জাতিসংঘ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা সেই কবে থেকে বলে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলে আক্রান্ত হবে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চল। এতে ছড়িয়ে পড়বে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ নানা ধরনের ভাইরাসজনিত রোগবালাই। এ দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে রক্ষায় কী করতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, খাওয়া-দাওয়াইবা কেমন হওয়া উচিত- সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত পরামর্শও দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির প্রতি তেমন গুরুত্ব দেননি। মশা নিধনে প্রথম দিকে তারা কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি। তাদের অবহেলা-অবজ্ঞার কারণেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে আজ লেজেগোবরে অবস্থা।

শুধু কাঁচা চামড়া রপ্তানি বা ডেঙ্গু প্রতিরোধেই সংশ্লিষ্টদের লেজেগোবরে অবস্থা নয়, কিছুদিন আগে ধানের উৎপাদন খরচ উঠছে না দেখে কৃষক ক্ষোভে-দুঃখে নিজের পাকা ধান ক্ষেতেই জ্বালিয়ে দিয়ে যখন ক্ষোভ প্রকাশ করেন; তখন এটাকে খাদ্যমন্ত্রী সরকারকে বিব্রত করার একটি মহলের পরিকল্পিত ঘটনা বলে অভিহিত করেন। সে সময়ও জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য সরকার চাল রপ্তানির ঘোষণা দেয়। চাল আমদানির শুল্ক ২৮ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ শতাংশ করে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ায় মানুষ ভিতরে ভিতরে বেজায় নাখোশ হয়। কৃষকের সঙ্গে এটাকে তারা মশকরা করার সঙ্গে তুলনা করেন। তাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে, দেশের মূল জনগোষ্ঠী কৃষক সমাজের সমস্যা সমাধানে সরকার বড়ই বেখেয়াল।

কাঁচা চামড়া রপ্তানি করতে হলে যে ধরনের লজেস্টিক সাপোর্ট লাগে, তা এ মুহূর্তে প্রস্তুত নেই। অর্থাৎ এ মুহূর্তে কাঁচা চামড়া রপ্তানি করার তেমন সুযোগ নেই। তাই এ ঘোষণায় গরিব-মিসকিন, এতিম ও দুস্থরা এর বেনিফিট পাবে বলে মনে হয় না। এ ঘোষণা যে দেশের মানুষকে শুধু আইওয়াশ, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার।

তারা এতটাই বেখেয়াল যে, এক্ষেত্রে একটি পরিসংখ্যান উল্লেখের দরকার। ২০১৭ সালের বন্যায় ফসলহানির পর ৮২ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়। সরকারি হিসাবমতে, সে বছরের বন্যায় ১০ লাখ টনের মতো চাল উৎপাদন কমে যায়। সরকার তখন বলেছিল, চাল আমদানি ১০ লাখ টনের চেয়েও কম করা হবে। কিন্তু চাল আমদানি করা হয় ৮২ লাখ টন। এ অযৌক্তিক কাজের খেসারত দিতে হয় দেশের চাষিদের। মাত্রাতিরিক্ত চাল আমদানির কারণে উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা। কেন এই অতিরিক্ত চাল আমদানি, এর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? এর ব্যাখ্যা কি চাল রপ্তানির নামে বাহবা কুড়ানো! নাকি অন্য কিছু!! সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনে যা-ই থাকুক, ধান-চালের দাম ওঠানামার সঙ্গে দেশের সবার স্বার্থ জড়িত বলে আগে থেকেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চিন্তা করে রাখাই শ্রেয়।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনাতেও। সে ঘটনায় ২৬ জন অকালে প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক। বনানীর এফআর টাওয়ারের অনুমোদন ছিল ১৮ তলার; করা হয় ২৩ তলা। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা না ঘটলে এ তথ্য প্রকাশই হতো না। এ অনিয়ম কি শুধু এফআর টাওয়ারই করেছে? ঢাকার ৯০% ভবনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। ভবন বানাতে মানা হয় না ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। নির্মাণের অনুমোদন দিয়েই দায় সারে রাজউক। ঝুঁকি সামলানোর সক্ষমতা মনিটর করে না ফায়ার সার্ভিস। নিজস্ব উদ্যোগে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রশিক্ষণ নেই কারো। এফআর টাওয়ারেও সমন্বিত কোনো সিঁড়ি ছিল না। কেন নেই? সমন্বিত সিঁড়ি কেন ছিল না সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে? শতাধিক মানুষ হতাহতের পর অনেক কমিটি গঠন করা হয়েছে, অনেকে অনেক কথা বলেছেন- তাতেও কি আমরা দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি? নাকি আবার কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার মতো কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে দায় সারবে?

মানুষ চিন্তা করতে পারে বলেই তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তন করে সে এতদূর এগিয়েছে। অন্য কোনো প্রাণী চিন্তা করতে পারে না বলে তারা বেশিদূর এগোতে পারেনি। সভ্য মানুষ হিসেবে আমাদের এর পরিচয় দিতে হবে। কিন্তু আমরা সব ক্ষেত্রে কি সভ্য মানুষের পরিচয়ের স্বাক্ষর রাখতে পারছি?

একদা পাট ছিল আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল। এ পাট আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই পাটশিল্প ধ্বংসে শাসকগোষ্ঠীর একাংশ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের নীলনকশার খেলায় যখন মত্ত, তখন আরেক অংশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে। অথচ মাত্র ২৩০ কোটি টাকা ব্যয় করলেই আদমজীকে আধুনিকায়ন করা যেত; রক্ষা করা যেত এশিয়ার গর্বকে। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে পরিকল্পিতভাবে পাটশিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছে। পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন না করে অর্ধশতাব্দীর জীর্ণ-নড়বড়ে তাঁত দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদন চালাতে হয়েছে। এ লোকসানের সমস্তটাই ছিল আরোপিত। শাসকগোষ্ঠী চেয়েছে, তাদের প্রভু দাতাগোষ্ঠী চেয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ুক- ধুঁকে ধুঁকে চলুক। এ চক্রান্তের পরিণতিতে পাটের যা হবার, আমাদের চোখের সামনে তা-ই হয়েছে।

অথচ পাট বিশ্বে সবচেয়ে সস্তা, পরিবেশবান্ধব ও বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্রাকৃতিক তন্তু। প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে তুলার পরই পাটের অবস্থান। পাট থেকে উন্নত মানের মিহি সুতা আবিষ্কার পাটের সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেছে। পাটের নতুন সম্ভাবনা উপলব্ধি করে বাংলাদেশ সরকার ইদানীং যুগান্তকরী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সিনথেটিক বস্তা নিষিদ্ধ করে ‘প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ পাস করেছে। নেয়া হয়েছে আরও অনেক পদক্ষেপ। কিন্তু ততদিনে মেঘনা যমুনা পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। পাটের যে ক্ষতি তা হয়ে গেছে। ধূলায় মিশমার হয়ে গেছে এশিয়ার গর্ব আদমজী জুট মিল।

আজ বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করেছে। এক সময় বাংলাদেশকে নিয়ে যারা উপহাস করত; তারা এখন বাংলাদেশকে সমীহ করতে শুরু করেছে। এ সমীহ ধরে রাখতে এবং একে আরও দৃঢ় করতে তাই ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার’ প্রবণতা বাদ দিতে হবে। জনগণের স্বার্থে যা ভাবার, তা আগেই ভেবে রাখতে হবে। এখানে করিয়া ভাবার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : সাংবাদিক
 

আরও সংবাদ