• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০১৯, ০৮:২৭ পিএম

পাটের ঐতিহ্য হারাল কেন?

পাটের ঐতিহ্য হারাল কেন?
গোলাম মোস্তফা; ফাইল ফটো


বাংলাদেশ ‘সোনালি আঁশের’ দেশ। পাট একদা আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল। বাঙালির জীবন-জীবিকা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে এ পাটের চাষ। অবিভক্ত বাংলায় পাটের বর্ণময়, উজ্জ্বল ও সোনালি অধ্যায় শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে এবং এ অঞ্চলে শিল্পযুগের সূচনা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে পাটকল স্থাপনের মধ্য দিয়ে। উর্বর গাঙ্গেয় উপত্যকা, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার কারণে বঙ্গীয় অঞ্চল পাটচাষের জন্য বিশ্বে সবচেয়ে উপযোগী জায়গা। পাটের রঙ সোনালি এবং পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয় বিধায় পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয়ে থাকে। বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশেও পাট অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। পাট বিক্রির বাড়তি অর্থ দিয়েই এ ভূখ-ে কৃষক তার সন্তানকে স্লেøট, পেন্সিলসহ শিক্ষাসামগ্রী কিনে দিতে শুরু করেন। অথচ এই পাট ও পাটশিল্পকে আজ পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পাটের এ হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৭ সাল থেকে ৬ মার্চকে জাতীয় পাট দিবস পালন করা হচ্ছে। 

পাট খাত আজ আমাদের দীর্ঘ হতাশার নাম। পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ সালে প্রথম পাটকল আদমজী জুটমিলে উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে আরও ৬টি পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাটকলের সংখ্যা হয় ৭৭টি। আদমজী হয়েছিল বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল। এ কারখানা দিয়েই আদমজী পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শীর্ষে উঠেছিল। এর মুনাফা দিয়েই আরও ১৩টি পাটকল গড়ে তুলেছিল তারা। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে অব্যাহত লুটপাটের মধ্য দিয়ে এহেন পাট খাতকে লোকসানি খাত বানানো হয়েছে। এর পর চলেছে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ।

১৯৭২ সালে সরকার দেশের বিভিন্ন খাতের সব শিল্পকারখানা জাতীয়করণের সাথে পাটশিল্পকেও জাতীয়করণ করে। পাটশিল্পকে নিয়ে চলে ছেলেখেলা। এর ফলে ১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৭৮-৭৯ সাল পর্যন্ত পাট খাতের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। পাটশিল্পের ধ্বংসলীলার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের নাম বিশেষভাবে জড়িত। ১৯৭৯-৮০ সালে তাদের পরামর্শেই বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের নামে শিল্প-কলকারখানায় বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয়। তাদের পরামর্শক্রমেই এ প্রক্রিয়া দ্রুততর হয় স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে। বন্দুকের নলকে সামনে রেখে ওই বছরের ৩০ নভেম্বর একদিনে ১০টি পাটকল বেসরকারীকরণ করা হয়। পরের মাসে আরও ১৩টি। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৬৯টি পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। সরকার এ মিলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দিয়েছিল মাত্র ১৭৫ কোটি টাকায়। আর মালিকরা ৩৪ কোটি টাকা পরিশোধ করার পর আজ পর্যন্ত বাকি টাকা পরিশোধ করেনি (যুগান্তর ৬ আগস্ট, ২০০৫)।

স্বৈরশাসকের পতনের পরও পাটশিল্প ধ্বংসে বিশ্বব্যাংকের কূটচাল অব্যাহত থাকে। ১৯৯৪ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সাথে ‘জুট সেক্টর স্ট্রাকচারাল কন্ট্রাক্ট’ স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির আওতায় আদমজীকে ডাউন সাইজ করার কাজ শুরু হয়, অর্থাৎ আদমজীর তাঁতসংখ্যা ৩২৫০ থকে কমিয়ে ১৫০০টি করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বিক্রি, বন্ধ এবং শ্রমিক ছাঁটাইসহ পাট খাতকে সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় (যদিও শেষ পর্যন্ত দিয়েছে ৫ কোটি ডলার!!)। একই সময়ে ভারতকে পাটশিল্প উন্নয়নের জন্য ইউএনডিপি (জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল) দিয়েছে ২৫ কোটি ডলার। অবশেষে ৮শ কোটি টাকা খরচ করে বিএনপি-জামায়াত সরকার চিরতরে আদমজী বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ৩০ হাজার শ্রমিক পথে বসে। অথচ ২৩০ কোটি টাকা খরচ করলেই আদমজীকে আধুনিকায়ন করা যেত। পরিকল্পিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে লোকসানি খাতে পরিণত করা হয়েছিল। পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন না করে অর্ধশতাব্দীর জীর্ণ-নড়বড়ে তাঁত দিয়েই এসব প্রতিশষ্ঠানকে উৎপাদন চালাতে হয়েছে। এসবে যদি লোকসান হয়Ñ সেটিকে কি পরিকল্পিত মনে হয় না? এ লোকসানের সমস্তটাই আরোপিত। শাসকগোষ্ঠী চেয়েছে, তাদের প্রভু দাতাগোষ্ঠী চেয়েছেÑ এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়–কÑ ধুঁকে ধুঁকে চলুক এবং সেটাই হয়েছে।

পাটশিল্প ধ্বংসে বিশ্বব্যাংক-আএমএফের কূটপরামর্শ এবং দেশের শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতার সাথে যোগ হয় ১৯৮০-এর দশকে কৃত্রিম তন্তুর আবিষ্কার। ফলে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের কদর শুধু বিশ্ববাজারে নয়, দেশের বাজারেও কমে যায়। তবে যুগের পথপরিক্রমায় পাট আবার নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রিন ইকোনমি ও সবুজ পৃথিবীর বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে পাট ও পাটপণ্যের প্রতি আগ্রহ আশাতীতভাবে বেড়ে গেছে। কার্বন নিউট্রাল সবুজ পৃথিবী এবং লাগসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক কণ্ঠ একসুরে মিলেছে। ‘সবুজ পণ্যের’ আন্দোলন বৈশ্বিক রূপ লাভ করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাটের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের ফলে বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাট বিশ্বে সবচেয়ে সস্তা, পরিবেশবান্ধব ও বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্রাকৃতিক তন্তু। প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে তুলার পরই পাটের অবস্থান। বৈশ্বিক তন্তুর ৯১ শতাংশ জোগান আসে তুলা ও সিনথেটিক তন্তু থেকে। পাট জোগান দেয় মাত্র ৬ শতাংশ। প্যারিস সম্মেলনের পর বিশ্বজুড়ে বায়ো-ডিগ্রেডেবল ও পরিবেশবান্ধব পাটের প্যাকেট ও বস্তার চাহিদা বেড়ে গেছে। পাট থেকে উন্নত মানের মিহি সুতা আবিষ্কার পাটের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বৈশ্বিক সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ২০২১ সাল নাগাদ কাঁচাপাট ও পাটপণ্যের চাহিদা ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা পাটপণ্য নিয়ে নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করছে। পাটের নতুন সম্ভাবনা উপলব্ধি করে বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি যুগান্তকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধ করা হয়েছে। সিনথেটিক বস্তা নিষিদ্ধ করে ‘প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ পাস করায় পাটের বস্তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করায় পাটচাষি ও রপ্তানিকারকরা উপকৃত হচ্ছে। বার্ষিক পাটের বস্তার চাহিদা ১০ কোটি থেকে বেড়ে ৭০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বে বর্তমানে ফুড গ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা যেখানে ৩২ মিলিয়ন, সেখানে প্রধান পাট উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ ও ভারত সরবরাহ করতে পারে মাত্র ১২ মিলিয়ন। পাটের শপিং ব্যাগের বৈশ্বিক বার্ষিক চাহিদা ৫০০ বিলিয়ন কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত রপ্তানি করতে পারছে মাত্র ৪০ মিলিয়ন। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জুট জিও টেক্সটাইলের চাহিদা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে পাটপণ্যের ব্যবহার অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

খাদ্যনিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল। ধান, সবজি, ফল ও আলুর পাশাপাশি পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ গ্লোবাল লিডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পাটের রপ্তানি আয় ২.০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। পাটের সোনালি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত ও আধুনিক ডিজাইনের পাটপণ্য উদ্ভাবন ও রপ্তানি করতে হবে। ‘জুট ডিপ্লোম্যাসি’ শক্তিশালী করতে হবে। সঠিক নীতি, যুগোপযোগী গবেষণা, উদ্ভাবন, গ্লোবাল পার্টনারশিপ, বহুমাত্রিক কূটনীতি ও সঠিক সম্প্রসারণ নীতির ফলে সোনালি আঁশের সম্ভাবনা পুনরুজ্জীবিত হবে এবং বাংলার পাটচাষি হবে ‘গোল্ডেন হিরো’Ñ এ প্রত্যাশা সবার।