আমদানি নির্ভরতাই পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৯, ০৬:৫৫ পিএম আমদানি নির্ভরতাই পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ

পেঁয়াজ নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় গুরুত্বপূর্ণ একটি পণ্য। এটি ছাড়া রান্নাবান্না প্রায় অচল। খাদ্যের স্বাদ বাড়াতে পেঁয়াজ অদ্বিতীয়। তাই যুগ যুগ ধরে বাঙালির রান্নাঘরে পেঁয়াজ অনন্য আসন অধিকার করে আছে। কিন্তু কিছুদিন হলো সেই পেঁয়াজের ঝাঁজে আমাদের চোখ কানা হওয়ার জোগাড়। ভারত পেঁয়াজের ন্যূনতম আমদানি মূল্য প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে নির্ধারণ করায় বাংলাদেশে কয়েকদিন ধরে পেঁয়াজের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। গত রবিবার ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধের ঘোষণায় হু হু করে বেড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারে সোমবার পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেছে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা কেজিতে। অথচ রবিবারও প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।

দেশের বাজারে চলতি মাসের মাঝামাঝি থেকেই পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানিতে ন্যূনতম মূল্য টনপ্রতি ৮৫০ ডলার বেঁধে দেয়। এর একদিন পরই বাংলাদেশের বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় প্রায় ১৫ টাকা। এরপর আরও কয়েক দফা দাম বেড়ে খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৭৫-৮০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল। এর মধ্যে গত রবিবার পেঁয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় ভারত।

হঠাৎ করে পেঁয়াজের এই দাম বৃদ্ধি কোনোভোবেই মেনে যায় না। বাজারে এমন অরাজকতা কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে দাম বাড়ানোর একটা পরিস্থিতি সব সময়ই তৈরি করে রাখেন। নতুবা পেঁয়াজের দাম এত বাড়ার কথা নয়। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) ১৭ জুলাইয়ের এক হিসাব অনুযায়ী দেশে এবার পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ ২০ হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩ লাখ টন বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আমদানি হয়েছে (ঋণপত্র নিষ্পত্তি) ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। এতে মোট সরবরাহ দাঁড়ায় প্রায় ৩৪ লাখ ২০ হাজার টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব বিবেচনায় নিলে মোট সরবরাহ দাঁড়ায় ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার টন। বিপুল পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। আমদানিও প্রচুর। দুইয়ে মিলে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ চাহিদার চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি। তবু দাম সাধারণ মানুষের নাগালে নেই। যে যার মতো ব্যবসা করছেন, দাম নিচ্ছেন। যেন কারও কিছু বলার নেই।

দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার ভারতীয় পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল। দেশে চাহিদার অনুপাতে উৎপাদন কম হওয়ায় এ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। ভারতীয় পেঁয়াজ সাইজে বড়, ফলনে বেশি, উৎপাদন খরচও কম। উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় ভারতীয় কৃষকরা স্বল্পশ্রমে কম জমিতে অধিক পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপন্ন করতে পারেন। ফলে উৎপাদন খরচ কমে যায় ও নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করতে পারেন। এ কারণে পরিবহন খরচ, বিভিন্ন ট্যাক্স ও বন্দরের ব্যয় মিটিয়ে বাংলাদেশে এনে স্থানীয় পেঁয়াজের চেয়ে কম দামে বিক্রি করা যায়। ফলে সারা বছর ভারতীয় পেঁয়াজের আধিপত্য থাকে বাংলাদেশের বাজারে।

এ দেশেও প্রচুর পরিমাণে উন্নতমানের পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। কিন্তু তা চাহিদার সীমারেখা স্পর্শ করতে পারে না বলেই মাঝে মাঝে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আমাদের দেশে কৃষিবিদরা পেঁয়াজের চাহিদা, উৎপাদন, মান- এসব নিয়ে কতটা গবেষণা করেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। পেঁয়াজের বিষয়ে যে ঘাটতি চলমান, তা নিয়ে আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, যা নেওয়া হয়নি।

কৃষিপ্রধান যে দেশ বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে, সে দেশকে কেন দিনের পর দিন কৃষিপণ্য আমদানি করতে হবে? আমাদের কি উপযোগী কৃষিজমি, প্রয়োজনীয় কৃষক, সেই সঙ্গে প্রযুক্তিজ্ঞান নেই? প্রতিবেশী দেশ যদি স্বল্পব্যয়ে পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারে, তা হলে আমরা কেন পারব না? উৎপাদনে যদি সার্বিক পরিকল্পনা থাকত, তা হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন করা কোনো বাধা নয়। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে আমরা পেঁয়াজ আমদানি করি। যে মুদ্রা দেশের কৃষকের ঘরে থাকার কথা, সে মুদ্রা আমদানি ব্যয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশি কৃষকের ঘরে।

দেশের কৃষক পেঁয়াজ চাষে প্রকৃত নিয়ম অনুসরণ করেন না। যেখানে পেঁয়াজ মৌসুমে চার থেকে পাঁচটা সেচ দরকার, সেখানে ছয়-সাতটা দেওয়া হয়। এতে আর্দ্রতা বাড়ে। ফলে সংরক্ষণে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া চাষকালে রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহারে পেঁয়াজে দ্রুত পচন ধরে। এতেও সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে পেঁয়াজ ঘরে তোলার পর ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এসব বিষয়ে নজর দেয়া দরকার, হওয়া দরকার এ নিয়ে গবেষণা।

সরকার বিভিন্ন ফসলে কৃষিঋণ দিচ্ছে। কিন্তু পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কোনো পদক্ষেপের কথা শোনা যায় না। বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে ও গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত শক্ত করতে আমাদের পেঁয়াজ চাষাবাদ নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। এক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতার গ-ি থেকে আমাদের বেরোতেই হবে। সেই সঙ্গে কৃষকের পণ্যের ন্যায্য দামও নিশ্চিত করা দরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পেঁয়াজের ঘাটতি রোধে অচিরেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে- এটা সবার প্রত্যাশা।


লেখক : সাংবাদিক 
 

আরও সংবাদ