• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৯:৪৪ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৯, ২০২১, ০৩:৪৫ পিএম

শতবর্ষী রাই-শশী নিবাসে একদিন

শতবর্ষী রাই-শশী নিবাসে একদিন

রাই-শশী নিবাস নির্মাণের ১২০ পেরিয়ে গেল। কোথায় এই রাই-শশী নিবাস?

আমাদের জাদুর শহর থেকে খুব কাছে রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানী বলে খ্যাত সাভার অঞ্চলে এই রাই-শশী নিবাস। রাই-শশী নিবাসের কথা বলার আগে, ঐতিহাসিক অঞ্চল সাভারের কথা একটু বলে নিই। যুগে যুগে এই অঞ্চলে ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজা, মুসলিম শাসক ও জমিদারদের বসবাস।  

কাঠের দরজা গলে মন্দির দেখা যাচ্ছে

আসলে সাভার একটি প্রাচীন স্থান। ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে বংশাই নদীর  বাঁ তীরে এর অবস্থান । ড. নলিনী কান্ত ভট্টশালী এখানে জরিপকাজ চালিয়েছিলেন ১৯২১ সালে, সেই সময় প্রাচীন কিছু ধ্বংসাবশেষ খনন করে দেখা মেলে বিভিন্ন বিষ্ণুমূর্তি, মুদ্রা আর পাত্রের ভগ্নাংশের। সেই থেকে ধারণা করা হয় সাভার জনপদ ১২০০ বছরের পুরোনো। যদিও সেই সব ধ্বংসাবশেষের খুব অল্পই বর্তমান, এমনকি আঠারো ও ঊনবিংশ শতকের বাড়িঘর হাতে গোনা দু-চারটি টিকে রয়েছে।  

তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক সম্ভার নাম থেকে সাভার নামের উৎপত্তির কথা বলেছেন। সভর, সেউরা বা সুরা নামে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাসের আলামতের সঙ্গেও যুক্ত করা হয় এই অঞ্চলের ইতিহাসকে। সেখান থেকেও অনুমান করা হয় এই জনপদ হাজার বছরের পুরোনো। তবে এর সপক্ষে নৃতাত্ত্বিক কোনো সূত্র পাওয়া যায় না।

মূল প্রসঙ্গে আসি, রাই-শশী নিবাস সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আড়াপাড়া এলাকায় এই বাড়িটির অবস্থান হওয়ার কারণে স্থানীয় লোকজন একে আড়াপাড়া  জমিদারবাড়ি  বলে চেনে। প্রায় ১২০ বছর আগে সাভার উপজেলায় আড়াপাড়া নামক জায়গায় এই জমিদারবাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে দুটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। একটি করা হয়েছিল ১৯০০ সালে। পরে আবার আরেকটি করা হয়, ১৯৩৭ সালে। মূল প্রাসাদে লেখা রয়েছে রাই-শশী নিবাস।  আর দ্বিতীয় প্রাসাদে লেখা রয়েছে রাই নিকেতন। রাই নিকেতনের একদম ওপরে লেখা রয়েছে ইংরেজিতে RM House। শুনেছিলাম দ্বিতীয় বাড়িটিতে সরকারি একটি হোল্ডিং নম্বর দেওয়া আছে। পেলামও সেটা, সেই হোল্ডিং নম্বর অনুসারে এই এলাকার নাম ‘সুতার নোয়াদ্দা’। তবে স্থানীয় কিছু দোকানের সাইনবোর্ড, ব্যানারে আড়াপাড়া লিখে বন্ধনীতে সুতার নোয়াদ্দা নামটি লেখা দেখলাম।

জীর্ণ রোমান স্টাইলে করা নারী মূর্তি

খুব কম তথ্যই পাওয়া গেছে রাই-শশী নিবাস সম্পর্কে। রাস্তা থেকে প্রথমে চোখে পড়বে একটি মন্দির। যেটি এই বাড়ির রাধা-গোবিন্দ মন্দির। মন্দিরের প্রবেশদ্বারটি কাঠের এবং কারুকাজ করা। যদিও কিছুটা জৌলুশহীন যত্নের অভাবে। সামনে একটি রাস্তা চলে গেছে, যেটি মূল বাড়ির দিকে গেছে। মন্দিরের সামনের পুকুরটিও তার নিজস্ব কোমনীয়তা হারিয়েছে ।  

মন্দিরের সেই ফটক থেকে বেশ বড় মূল মন্দিরটি চোখে পড়ে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম দুজন বয়স্ক নারী মন্দিরের সিঁড়িতে বসে কাজ করছেন। কাছাকাছি গিয়ে কথা বলতে চাইলাম। তাদের মধ্যে একজন কথা বলে উঠলেন। পরিচয় দিলেন লক্ষ্মী রানী বলে, তিনি এই মন্দির দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন প্রায় ৫০ বছর। আরও জানালেন তাঁর মা, ঠাকুরমাও এই মন্দিরে কাজ করেছেন। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই বাড়ির মন্দিরের দেখভাল করছেন। লক্ষ্মী রানীর বয়স এখন ৮৫, জানালেন তিনি। কিন্তু উনি বেশ শুদ্ধ ও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেন, যা দেখে মনে হয় না তাঁর বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে। আমি সেই কথা জানালামও তাকে। খুব সুন্দর একগাল হাসি উপহার পেলাম বিনিময়ে।

অল্প কিছু তথ্য লক্ষ্মী রানী দিলেন এই রাই-শশী নিবাস সম্পর্কে: রাইমোহন সাহা ও শশীমোহন সাহা দুই ভাই। শশীমোহনের ঘরে ছিল তিন ছেলে  এবং রাইমোহনের ঘরে ছিল চার ছেলে। বর্তমানে জমিদার বংশের কে বা কারা আছে জানতে চাইলাম। লক্ষ্মী রানী বললেন, এখন বংশের তৃতীয় পুরুষ বসবাস করছে। রাইমোহন ও শশীমোহনের নাতির ঘরের পুতিরা আছেন। উনি আমাদের ভেতরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বললেন, ভেতরে গেলে আরও কিছু জানতে পারবেন। লক্ষ্মী রানীর কথামতোই কাজ করলাম।

রাধা গোবিন্দ মন্দিরের প্রবেশদ্বার

মূল ভবনের দিকে আগ্রসর হলাম, মূল ফটকের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। বাঁ দিকের গেটের পুরোনো লোহার কবজা আছে আর ডান দিকে ভাঙাচোরা এক সিংহমূর্তি অভিবাদন জানাল। তারপর গেটের দুপাশের রাস্তার রোমান স্টাইলের দণ্ডায়মান নারী মূর্তিগুলো খুবই নান্দনিক। যদিও তাদের কারও হাত, কারও নাক, কারও থুতনি বিলুপ্ত। তারপর একটি ফটক, মূল প্রবেশদ্বারের পর আরও একটি প্রবেশদ্বার। সেখানে দেখলাম দু-চারজন নারী আর একজন পুরুষ কথা বলছেন। নিজের পরিচয় দিলাম, তারা বললেন আমরা এখানে ভাড়া থাকি। আপনি ভেতরে গিয়ে কথা বলুন , ভেতরে মালিক আছে।  

ভেতরে যেতে থাকলাম। অল্প দূর গিয়েই দেখলাম আর একজন নারী বসে আছেন মূল ভবনের বারান্দায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার জমিদারবাড়িতে ঢোকার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আগেভাগেই বললাম, ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছি , বাড়িটা দেখে ভালো লাগল তাই ঢুকলাম। অনুমতি নিলাম ছবি তোলার জন্য। তিনি সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলেন। বললেন, অনেক মানুষই দেখতে আসে, ছবি তোলে। মূল ভবনের সিঁড়ির দুপাশেও দুটি নারী মূর্তি, একেবারে জীর্ণ।

সবুজ শাড়ি পরিহিত লক্ষ্মী রানী, ৫০ বছর থেকে মন্দির দেখভাল করছেন

বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ঘুরবার সময় স্বল্পসংখ্যক জমিদারবাড়িতে আমি দেখেছি রোমান স্টাইলের নারীমূর্তি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ময়মনসিংহ জেলার শশী লজ আর নাটোর জেলার উত্তরা গণবভনের নারীমূর্তি দুটির কথা।   

আমি যখন বাড়িটা ঘুরে দেখছিলাম সে সময় বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক ছিলেন না কথা বলার জন্য। অগত্যা বারান্দায় বসে থাকা নারী অল্পবিস্তর যা জানালেন সেটাই সম্বল করতে হলো। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন এ বাড়ির নাতবউ হিসেবে। ওনার স্বামী, উনি আর ছেলে এবং ছেলের বউ এই ভবনে থাকেন। রাইমোহন সাহা ও শশীমোহন সাহা কোথা হতে এখানে এসেছিলেন, এই ভবন তৈরি হওয়ার আগে এই পরিবার কোন পেশায় যুক্ত ছিলেন ইত্যাদি কোনো তথ্যই ভদ্রমহিলা দিতে পারেননি ।

তারপর এগিয়ে গেলাম পরের ভবনটির দিকে। নাম আগেই বলেছি রাই নিকেতন। ভবনটির ওপরে লেখা রয়েছে ইংরেজিতে RM House। সেখানে পাওয়া গেল ৩০-৩৫ বছরের এক যুবককে, তিনি জানালেন, এই জমিদারবাড়ির পূর্বপুরুষ এসেছিলেন বংশাই নদীর ওপাশ থেকে। নিজেদের তারা জমিদারের বংশধর বলে পরিচয় দেন আজ অবধি। সময়টা সন্ধ্যা হবে হবে করছিল, যুবকটি বললেন এখন পুজোর সময়, আর সন্ধ্যা হয়ে গেছে , তাই ভেতরে প্রবেশ না করা ভালো।

কী আর করা, ভেতরে প্রবেশ না করে, বারান্দা থেকে রাই নিকেতনের কিছু ছবি তুলে ফেরার পথ ধরলাম।

মূল ভবনে নামফলক

যেভাবে যাবেন রাই-শশী নিবাসে

সাভার বাসস্ট্যান্ডের ফুটওভারব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে হেঁটে অথবা ব্যাটারিচালিত অটোতে সাভার বাজার যেতে হবে। সাভার বাজার থেকে আবার অটোতে আড়াপাড়া নেমে একটু হেঁটে পৌঁছানো যাবে আড়াপাড়া জমিদারবাড়ি বা রাই-শশী নিকেতন। অথবা রিকশায় সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি যেতে পারেন একবারে আড়াপাড়ায়।