• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯, ১১:২১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯, ১১:২১ এএম

ঐতিহ্য সংকটে গাইবান্ধার তবলা-ডুগডুগি 

ঐতিহ্য সংকটে গাইবান্ধার তবলা-ডুগডুগি 

আগের মত আর দেশীয় সংস্কৃতি বাদ্যযন্ত্রের তেমন চাহিদা নেই। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় সংস্কৃতি বাদ্যযন্ত্র ঢাক, ঢোল, কর তাল, তবলা, বেহালা, ডুগডুগি।

গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাড়া পুরাতন লোন অফিস এলাকায় বংশ পরম্পরায় বসবাস করছেন সন্তোষ কুমার দাস, পরিতোষ কুমার দাস, মন্টু কুমার দাস ও তার বড় বোন বেদানা। চার বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন তিনজন। 
তাদের আদি বাড়ি টাঙ্গাইল জেলা। বাপ দাদার এই ঢোল তবলার ব্যবসা প্রায় শত বছরের। বড় ভাই পরিতোষ কুমার বেশিরভাগ সময়ই অসুস্থ থাকে। তাই বাধ্য হয়ে বর্তমানে ৫০ বছরের মন্টু কুমার একাই ব্যবসা দেখাশুনা করছেন। 

মন্টু কুমার দাস বলেন, অনেক কষ্ট করে বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছি। জন্মের পর থেকে বাবা ঠাকুর দাস এর কাছ থেকে এই বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতে শিখেছি। পরে আস্তে আস্তে এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে শিখেছি। এক সময় দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা অনেক বেশি ছিল। তখন ভালো ভাবেই বেঁচে থাকা যেত।

মন্টু কুমার দাসের ধারণা, ঢোলের শব্দ শুনে গ্রামের কিংবা শহরের মানুষ এখন আর আগের মতো ভিড় করে না। সে জায়গায় এখন  মাইক এসেছে। এছাড়া ড্রাম, গিটার, পিয়ানো, উচ্চ শব্দের সাউন্ড বক্সের শব্দের ঝনঝনানি ছাড়া আজকাল কোন অনুষ্ঠানও জমে না।

রাস্তার ধারে ছোট্ট একটি ছাপড়া ঘরে বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও বিক্রি করেন মন্টু কুমার দাস। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ঢাক-ঢোল, করকা, খোল, তবলা, ডুগডুগি, একতারা, খমর, দো-তারা, ঢোলোকসহ সাইড ড্রাম তৈরি ও মেরামতের কাজও করেন এই খুপরি ঘরটিতেই। চুপচাপ বসে আছেন হাতে কোন কাজ নেই? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে সময় ও আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল দিতে না পেরে তাদের মূল ব্যবসাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রতি বছর আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এই তিন মাস কাজের চাপ থাকে কিন্তু  পরের মাসগুলোতে তেমন কোন ব্যবসা হয় না।

এই তিন মাসেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন স্থানে অষ্টপ্রহরসহ প্রতি বাড়িতে ও মন্দিরে হরিনাম কীর্তন করে বেড়ান। এরাই মূলত দেশীয় সংস্কৃতি ও বাদ্যযন্ত্রের ক্রেতা। এ ছাড়াও নিজস্ব বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের লোকজন এই ড্রাম তবলা  এখনো ব্যবহার করে থাকেন।

বর্তমানে প্রতিটি খোল নতুন করে তৈরি করে ক্রেতার কাছে বিক্রি করেন ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। তবলা বিক্রি করেন ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। আবার সাইডড্রাম তৈরিতে ৪ হাজার টাকা, দো-তারা তৈরিতে ৪ হাজার টাকা, জিপাসি তৈরিতে প্রায় ৮শ টাকা খরচ হয়। তাই এই ব্যবসায় লাভ খুব কম। খোল, সাইড ড্রাম, দো-তারা তৈরিতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ দিন। অন্যন্যা বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন।

মন্টু কুমার দাস জানান, তবলা (ডান হাতে যেটা বাজানো হয়) তৈরির জন্য সাধারণত নিম কাঠের খোল (বডি), আর ডুগির (যেটা বাঁ হাতে বাজানো হয়) জন্য পিতল বা তামার খোল ব্যবহৃত হয়। এসব কাঁচামাল তিনি ঢাকা, বগুড়া কিংবা মেলা থেকেও কেনেন। এ ছাড়া তবলার ছাউনির জন্য পাঁঠা বা ছাগলের চামড়া আর বেণি হিসেবে মোষ বা গরুর চামড়া উত্তম।
এসব বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে যে  মালামাল লাগে তা বর্তমানে অনেক দামে কিনতে হয়। যার ফলে পুষিয়ে উঠা সম্ভব হয় না। খুব নিখুঁত কাজ হওয়ায় সময়ও লাগে অনেক বেশি।

এবার তিনি আক্ষেপ ও হতাশার করুন সুরে বলেন,  গেল জন্মাষ্টমী উপলক্ষে প্রতিবার ১০টি থেকে ১৫টি তবলা বা ঢোল বিক্রি করি কিন্ত এবার অনেকেই ঢাকা কিংবা বগুড়া থেকে কেনার কারণে একটিও বিক্রি কর‍তে পারিনি। বিগত ৯ মাস ধরে কষ্ট করে এর ওর কাছে থেকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা লোন করেছি। এই লোন করেই এতগুলো উপকরণ (ঢোল–তবলা ) তৈরি করেছি (ঢোল,তবলা গুলোর দিকে দেখিয়ে)। এখন পর্যন্ত  একটাও বিক্রি করতে পারিনি। এভাবে কি এই পেশা ধরে রাখা সম্ভব?

জেলা শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠ শিল্পী ও প্রশিক্ষক জাহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, গিটার, প্যাড ড্রাম, কি-বোর্ড দিয়ে আগের গানগুলোর সঙ্গে তাল মিলে না। তাই প্রকৃত সুর থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে দর্শক। আমরাও হয়তো যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করছি। সে কারণে অনেকটায় দেশিয় বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা কমে গেছে।

গাইবান্ধার বিশিষ্ট তবলাবাদক আসাদ জানান, ২৫ বছর ধরে এ পেশায় রয়েছি। বর্তমানে পশ্চিমা সাংস্কৃতির ছোয়া এবং তাদের গান গুলি দর্শক বেশি পছন্দ করে। সে কারণে দর্শকের মন যোগাতে পশ্চিমাদের এই গানগুলো আমাদেরকেও গাইতে হয়। বর্তমান গানগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে তেমন আর দেশিয় বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না, ফলে তা আর তৈরি ও ব্যবহারে তেমন কোন আগ্রহ দেখা যায় না। দেশীয় বাদ্যযন্ত্রকে লালন পালন করতে আমাদের মনমানষিকতার পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে একদিন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢাক-ঢোল, তবলা, একতারা, দো-তারা, বিলীন হয়ে যাবে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার  ইউএনও উত্তম কুমার রায় জাগরণকে বলেন, এখন ছেলে-মেয়েরা হয়ে গেছে ইউটিউবার। গান কিংবা সংস্কৃতি নিয়ে স্কুলগুলোতে নিয়মিত চর্চারও অভাব রয়েছে। অন্যদিকে, আজকের ছেলেমেয়েরা সংস্কৃতি শুরুই করে গিটার দিয়ে। এখন তারা দোকানে যায় গিটার, কি-বোর্ড কিংবা অন্যান্য আধুনিক বাদ্যযন্ত্র কেনার জন্যই। তবে তিনি এই প্রতিবেদককে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় পৃষ্টপোষকতা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন।

কেএসটি

আরও পড়ুন