• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯, ০৩:৪৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৮:৫৩ পিএম

বিশেষ সাক্ষাৎকার

রাজনীতি আর উন্নয়ন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ : আরমা দত্ত

রাজনীতি আর উন্নয়ন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ : আরমা দত্ত

 

[আরমা দত্ত একজন সমাজ এবং মানবাধিকার কর্মী। এ বছর একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। ২০১৬ সালে নারী উন্নয়ন ও নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় তিনি রোকেয়া পদকও পেয়েছেন। আরমা দত্ত প্রাইভেট রুর‌্যাল ইনিশিয়েটিভস প্রোগ্রাম (প্রিপ) ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক। তার আরকেটি বিশেষ পরিচয় হলো তিনি প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত কার্যাবলী বাংলা করার এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ারও দাবি জানান। যা ছিল তার পরিচয় এবং অপরাধ। যে কারণে তাকে এবং তার পুত্রকে ৭১ সালে পাকবাহিনী নিয়ে যায়; তারপরে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।] সাক্ষাৎকার : নুসরাত অদিতি 
 

দৈনিক জাগরণ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আপনি আপনার দাদা এবং কাকাকে হারিয়েছেন। পরবর্তীতে আপনি রাজনীতি করলেন না কেন?  

আরমা দত্ত : আমরা রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছি। রাজনীতির সঙ্গে সব সময় যুক্ত ছিলাম। ১৯৭৪ সালে পাস করলাম এবং সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশিওলজিতে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি। আমি এ সময় বাকশালে যোগদান করেছিলাম। ১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে, তখন একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খাই। আমার বাবা তখন বাংলাদেশ অবজারভারে জয়েন্ট এডিটর। সেই সময় আমার বাবাসহ আরও কয়েকজন খন্দকার মোশতাকের রোষানলে নিপতিত হন। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসেবে আমার বাবাকে এবং আরও কয়েকজন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে তারা নানাভাবে আঘাত করার চেষ্টা করে। তারমধ্যে প্রখ্যাত শওকত ওসমানও ছিলেন। জেলহত্যার পরে তারা এখানে থাকাটা কোনো অবস্থাতেই নিরাপদ বোধ করলেন না। নানাভাবে চেষ্টা করা হলো কিন্তু আমার বাবা যেতে পারলেন না। এরমধ্যে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম তখন ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন আফসার উদ্দিন আহমেদ। তিনি কোলাবরেটর ছিলেন এবং কথিত আছে তিনি ’৭১ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকদের হত্যার ব্যাপারে বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। সে সময় যখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হয়, তখন ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামালের হাতে পায়ে ধরে তিনি তার জীবন রক্ষা করেন। এভাবে তিনি সুকৌশলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা বহাল রাখেন। তাই কোনো অবস্থাতেই তিনি আমাকে সুযোগ দিতে চাননি। তারপরে যখন উপায় ছিল না, আমি আমার প্রাক্তন স্বামীর কাছে কানাডায় যাওয়ার চেষ্টা করলাম। তার কাছে যাবার জন্য আমি ৬ মাসের ছুটি নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ছুটি আমাকে দেয়া হলো না। তখন আমি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। অনেক কষ্টে সে সময় দেশের বাইরে যাই এবং আমার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন দেশে ফিরলাম, তখন আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার (ইউএসএআইডি) সঙ্গে কাজ শুরু করি। তখন আমার বেতনই ছিল ৭৩ হাজার টাকা। কিন্তু সেখানে আমার কাজ করতে মোটেও ভালো লাগছিল না। কারণ আমেরিকানরা যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল; তাদের সঙ্গে কাজ করতে আমার বিবেকে দংশন করছিল। তখন আমি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম এবং ৬ হাজার টাকায় ন্যুরাডে জয়েন করলাম। ওখানে কোনো পলিটিক্যাল বিষয়ে কিছু বলার স্বাধীনতা ছিল না এবং গভর্ণমেন্টের সঙ্গেই কাজ করতে হতো। আর তখন তো আমার গভর্ণমেন্টকে পছন্দ না; তখনও তো বিএনপি ছিল। কিন্তু এখানে এসে আমার ফ্রিডম আমি ফ্রি হ্যান্ডে কাজ করতে পারলাম। তো সেক্ষেত্রে আমি বুঝলাম যে, আসলে রাজনীতি আর উন্নয়ন মানে কয়েনের এপিঠ ওপিঠ। 
  
দৈনিক জাগরণ : আপনি বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন। এবার সংসদ সদস্য হলেন। আপনি কি মনে করেন যে এসব আপনার পরিবারে যে অবদান তার খানিকটা স্বীকৃতি জানানোর প্রয়াস?

আরমা দত্ত : রোকেয়া পদকটা সম্পূর্ণই আমার কাজের জন্য আমাকে রিকগনাইজ করা। পরিবারের সঙ্গে এটা যুক্ত না। এটা সম্পূর্ণ আমার কাজের ওপরে মূল্যায়ণ করা। কারণ নারী জাগরণ, নারী ক্ষমতায়ণ, নারীর অধিকার, নারীর প্রতি সহিংসতার এ কাজগুলো আমি এতো বছর টেনে করে এসেছি। সে জায়গাটায় আমি একেবারে মাঠ পর্যায় থেকে কাজ করছি। এটা সম্পূর্ণই আমার কাজের অবদান। আর বর্তমানে যেখানে আছি সেটার একটা বড় জায়গা হলো আমার কাজের মূল্যায়ণ এবং অবশ্যই এখানে আমার পরিবারের, আমরা শহীদ পরিবার এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের যে অবদান সেটার একটা রিকগনিশন তো অবশ্যই। 

দৈনিক জাগরণ : আপনি প্রিপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে কীভাবে সমাজসেবা করছেন? 

আরমা দত্ত : সমাজ সেবা তো এটাই। আমি গ্রামে গ্রামে যে উন্নয়ন করছি, প্রিপের মাধ্যমেই তো করছি। প্রিপ হলো আমার সব থেকে বড় একটা প্লাটফর্ম। আর এখানে আমার নিজের একটা আদর্শ এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমি মাইক্রোক্রেডিট করি না। আমার কাছে এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি মনে করি যে, মানুষের কাছে যখন টাকা আসে তখন তার ক্ষমতায়ণ হয়, এটা ভালো দিক। কিন্তু তাদের থেকে যখন সুদ নিয়ে এক্সপ্লয়েট করা হয়, সেটা ঠিক না। সুদের ব্যবসা আমি কখনো করি নাই। 

দৈনিক জাগরণ : এনজিও করতে গিয়ে আপনি কোন ধরনের সমস্যা, জটিলতা বা হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন?

আরমা দত্ত : এনজিও করতে গিয়ে এক নম্বর সমস্যা হলো যেহেতু আমি মাইক্রোক্রেডিট করি না, সেহেতু আমার অনেক ভালো ভালো কর্মী চলে যায়। যেহেতু আমি মাইনে দিতে পারতাম না। যদিও এ প্রজেক্ট থেকে কোনো দিন আমি এক আনাও তুলে রাখিনি। প্রতি মুহূর্তে আমি ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। যেহেতু আমি বাকশালে জয়েন করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ছিলাম এবং মাইনোরিটি কমিউনিটির লোকদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনেক রিপোর্ট লিখেছিলাম সেহেতু খালেদা জিয়া এবং আগের সামরিক সরকারগুলোর সময়েও আমি বারবার নিগৃহীত হয়েছি। খালেদা জিয়ার আমলে প্রিপ বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর ময়মনসিংহে বোমা হামলার আসামি করে দেয়া হয় আমাকে।  
    
{আরমা দত্ত আরো বলেন, আজকে আমি যে সুযোগটা পেয়েছি, সেখানে জনসেবামূলক কাজগুলো আরও সহজে করতে পারব বলে আমি মনে করি। আমার  স্বপ্ন আছে এই জায়গাটায় অর্থাৎ সরকারের যে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে আমি একটা বিশেষ অবদান রাখতে পারব। তার কারণ আমার সব চাইতে বড় বিশ্বাসের জায়গাটি হচ্ছে জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি নারী স্বাধীনতা, নারী মুক্তি, নারীর অবস্থানের জন্য নিজেই অত্যন্ত সক্রিয়। সে জায়গায় আমি মনে করি আমার অবদানগুলো রাখতে পারব।}      

দৈনিক জাগরণ : সমাজে বিশেষ করে নারীদের কোন বিষয়গুলোর দিকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন? নারীরা কতটা এগিয়েছে এবং তারা তাদের অধিকারগুলো কতটুকু পাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

আরমা দত্ত : নারীর প্রতি যে বিভিন্ন সময় অন্যায় হয়েছে, সেটা দূর হওয়ার একটা সুযোগ রয়েছে। এই জায়গায় আমরা কাজ করতে পারব। আগে বলতে পারতাম না আজকে বলতে পারছি। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে পারছি, বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে পারছি, শহীদদের কথা বলতে পারছি। মেয়েরা তাদের অধিকার সম্পর্কে এখন অনেক সোচ্চার।  
এখন যেমন একটা মেয়ে, পারিবারিক ভাবে অন্যায় হলে সেটা জানাতে পারে। মিডিয়ার মাধ্যমে বা যেকোন ভাবে সে সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এ ক্ষেত্রটাকে গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র প্রসারিত করতে চাই। নারী নির্যাতন এবং সামাজিক যে বিভিন্ন বৈষম্য আছে, সে বৈষম্যগুলো কীভাবে দূর করা যায় সেটাই হলো এখন আমাদের মূল দায়িত্ব। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগটা সৃষ্টি করে দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা, তিনি যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন। তখন তিনি বাধ্যতামূলক ১৩ জন মেম্বারের মধ্যে ৩ জনকে অবশ্যই নারী হতে হবে এই  নীতি চালু করেছিলেন। এটা  নারী ক্ষমতায়ণের একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।  

{আরমা দত্ত বলেছেন, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে দেশটাকে একটা ট্র্যাকে উঠিয়ে দিয়েছেন। এটাকে চলার ব্যবস্থা করেছেন। কাজেই অবশ্যই এখন দেশকে কিছু দেয়ার আছে। এ জন্যই আমার এ রাজনীতিতে আসা। সরাসরি ভাবে গণপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করা এ জন্যেই।}   

দৈনিক জাগরণ : গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বিএনপিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আরমা দত্ত : গণতন্ত্র হচ্ছে একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল শর্ত। গণতন্ত্র একটা চর্চা। এই চর্চার মধ্যে গণমানুষকে ইনভলভ করাটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অভাব আমরা কিন্তু বিএনপির রাজনীতিতে লক্ষ্য করেছি। যদিও বিএনপি কখনো গ্রাস রুট লেবেলের কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ের কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। একটা বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির দ্বারা তারা রাজনীতি করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ গণমানুষের রাজনীতির ভেতর দিয়ে সংগঠনটাকে প্রসারিত করেছে। 

দৈনিক জাগরণ : স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৫০ বছর পার হতে চলল। আমরা কতটা স্বাধীনতার সুফল পেয়েছি বলে আপনি মনে করেন?

আরমা দত্ত : মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্ব, বিশ্বাস এবং মূল ভিত। মুক্তিযুদ্ধটা ছিল গণমানুষের যুদ্ধ। পৃথিবীতে ভাষা ভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হতে পারে, এই দেশের মানুষেরা সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু এমন একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন যার ডাকে লাখ লাখ লোক জীবন দিতে ঝাপিয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি বারবারই অগণতান্ত্রিক পার্টিগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগের মূল ভিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং গণমানুষ। সামগ্রিক জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আমাদের দেশ সত্যিই তার সঠিক মূল্যায়ণ করতে পেরেছে এবং জনগণ সেটারই ম্যান্ডেট দিয়েছে। 

{আরমা দত্ত আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, আমার তো বাঁচার কথা ছিল না। ’৭১ সালে যখন আমার দাদু কাকুকে পাকিস্তানি আর্মিরা নিতে আসল আমি তখন উপস্থিত ছিলাম। সাত ট্রাক আর্মি, আমি কীভাবে আনটাচ থাকলাম এটাও তো এখন কোনো দুঃস্বপ্ন বা স্বপ্নের মধ্যে ফেলতে পারি না। উনি আমাকে সেভাবেই রেখে গেছেন, যেভাবে হাসিনা আপাকে বঙ্গবন্ধু রেখে গেছেন। অসমাপ্ত কাজগুলো করার জন্যে। উনি বৃহৎ আকারে করছেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, আমি ছোট আকারে করছি সামাজিক পর্যায়ে। কিন্তু এটা আমার একটা ঐশ্বরিক জায়গা, সেখানে যে আনফিনিশ টাচটা করার জন্যে সুযোগ দিয়েছে; সেটা আমি বলি- আমি যখন মেম্বার অফ দ্যা পার্লামেন্ট হলাম, আমি যেন এর মর্যাদা রাখতে পারি এবং বড় করে যেন আমি অবদান রাখতে পারি। আর হাসিনা আপার মতো একজন ওয়ার্ড ক্লাস লিডারের সঙ্গে যে আমি কাজ করব, সেটাও কিন্তু আমার জীবনের একটা বড় পাওয়া।}