• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২১, ০৪:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২১, ২০২১, ০৭:৪২ পিএম

অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

আকস্মিক উদ্ভাস থেকেও ভালো কবিতার জন্ম হতে পারে : শঙ্খ ঘোষ

আকস্মিক উদ্ভাস থেকেও ভালো কবিতার জন্ম হতে পারে : শঙ্খ ঘোষ

বাঙালি কবি ও সাহিত্য সমালোচক শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১)। তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। তাঁর প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পিতা মনীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মাতা অমলা ঘোষ। ১৯৩২ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। মৃত্যু : ২১ এপ্রিল, ২০২১ কলকাতা। বংশানুক্রমিকভাবে পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায়। পিতার কর্মস্থল হওয়ায় তিনি বেশ কয়েক বছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, শিমলাতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ আডভান্স স্টাডিজ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা সাহিত্যে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে অবসর নেন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো—মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, এ আমির আবরণ, উর্বশীর হাসি, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি। পুরস্কার : ১৯৭৭ সালে নরসিংহ দাস পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার সরস্বতী পুরস্কার ১৯৯৯ সালে অনুবাদের জন্য সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতীর দ্বারা দেশিকোত্তম পুরস্কার, ২০১১ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার, ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক রোববার কলকাতার বিধাননগর তাঁর বাড়িতে কবির লেখালেখির জীবন ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে বিভিন্ন কথা হয়। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন তরুণ কবি ও সাংবাদিক রনি অধিকারী


রনি অধিকারী : একজন সৃষ্টিশীল কবি-লেখক হিসেবে জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। নিজেকে এখন কেন লাগে?
শঙ্খ ঘোষ :
কবিতায় প্রসন্ন যে মানসিক জগতের আভাস বলা হয়, তাতে একজন কবি-লেখক হিসেবে নিজেকে চরিতার্থ মনে হচ্ছে। মনোজগতের কম্পনটা অন্তত কিছু পাঠকের কাছে ঠিকভাবেই পৌঁছেছে। এটা ভালোই লাগে।

রনি অধিকারী : ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ আপনার একটি দীর্ঘ কবিতা। আপনার আরও কিছু দীর্ঘ কবিতা আছে। এরকম দীর্ঘ কবিতা কেন লিখলেন?
শঙ্খ ঘোষ :
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’কে আমি একইসঙ্গে একটি দীর্ঘ কবিতা আর চৌষট্টিটি হ্রস্ব কবিতার সমাহার হিসেবে দেখতে পাই, দেখতে চাই। লেখাগুলি যখন শুরু হয়েছিল, তখন টুকরো টুকরো চার লাইনের স্বয়ংসম্পূর্ণ লেখা হিসেবেই আসছিল। কিন্তু পারম্পর্যে গ্রন্থিত হতে হতে যখন একদিন ‘এ আমার আলস্যপুরাণ’ কথাটিতে (৬৪-সংখ্যক) পৌঁছলাম, মনে  হলো কোনো সমে পৌঁছেছি। আশ্চর্য যে এরপর ওই পর্বে ঠিক এ-রকমভাবে আর আসেনি কোনো লেখা। কিন্তু এখানে বড় প্রশ্নটা হলো আমি-তুমির অবস্থান নিয়ে। এটা ঠিকই যে, সে-অবস্থান এখানে চতুষ্কে চতুষ্কে বদলে গেছে। সেখানে কোনো ধারাবাহিকতায় নয়, প্রতিটি চতুষ্ক তার নিজের দাবিমতো তৈরি করে তুলেছে আমি-তুমির চরিত্র। তুমি-কে এই যে কোথাও সদর্থক কোথাও নঞর্থক লাগে, কোথাও মহাজাগতিক কোথাও মানবিক, কোথাও মৃত্যু কোথাও জীবন, তা যে আমার এই বইটিতেই কেবল আছে তা নয়, হয়তো আমার সব বইতেই আছে। এমনকি, আমার ধারণা, অনেক কবিরই লেখায় এই সঞ্চরণশীলতা আছে। চার দশকেরও বেশি আগে ‘কবিতার তুমি’ নামে ছোট একটি লেখায় এ-নিয়ে কিছু কথাও একবার বলেছিলাম।

রনি অধিকারী : ‘শবের উপরে শামিয়ানা’ কাব্যগ্রন্থে ‘জলেভাসা খড়কুটো’ কবিতা নিয়ে কিছু বলুন।
শঙ্খ ঘোষ : ‘জলেভাসা খড়কুটো’র সবকটা গুচ্ছেই ‘তুমি’র একটা সমতা আছে। মোটের ওপর, নিজে একে আমি প্রেমের কবিতা হিসেবেই জানি। তবে, সেই প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশকাল ইতিহাস ভূগোল। তাই সেখানে নানারকমের হৃদয়ভাবের ওঠাপড়া যাওয়া-আসা আছে, কোনো সরলরেখায় বা একক শব্দে তাকে পাওয়া যাবে না।

রনি অধিকারী :‘হাজার স্লিপিং পিল মাথার ভিতরে আত্মহারা’ —এই পঙক্তি থেকে কবিতায় কী  আভাস পাওয়া যায়?
শঙ্খ ঘোষ : ওই কবিতায়, ঠিক স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা না হলেও, একটা মৃত্যুজপের কথা আছে। আছে এমনকি স্লিপিং পিলের কথাও, কিন্তু তাহলেও এ-প্রশ্নে উল্লিখিত ওই টুকরোগুলিতে যা আছে তা মূলত এক অবসাদভার, হৃৎপিণ্ডে অন্ধকারের বোধ, শাপগ্রস্ত দিনের ব্যর্থতার বোধ। সে-বোধ তো মনে হয় আমার লেখায় আগাগোড়াই ছড়ানো আছে। জীবনের খুব কাছে যেতে গেলে এ-বোধ তো প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। অন্তত আমার কাছে।

রনি অধিকারী : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা, শহীদদের নিয়ে আপনি কিছু কবিতা লিখেছেন। 
শঙ্খ ঘোষ : এটা ঠিক যে, কোনো কোনো নিকটজনের বা শহীদের মৃত্যু-অভিঘাত আমার কবিতায় আছে, খুব প্রত্যক্ষ না হলেও, পরোক্ষভাবে। বিশেষ যে-দুটি কবিতার কথা এখানে উঠে এলো, তারও মধ্যে পরোক্ষ তেমন কোনো ছায়া থাকা সম্ভব। যদিও তেমন কোনো সচেতনতায় আমি লিখিনি। কবিতাগুলি লেখা শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। তার ঠিক আগের বছরে আমার কিশোর বয়সের ফেলে-আসা জায়গা পাকশীতে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ হবার পর সেই প্রথম। গিয়ে শুনছিলাম রাজাকার আর পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার আর হত্যাকাণ্ডের কিছু মর্মান্তিক বিবরণ। 

রনি অধিকারী : ‘জলেভাসা খড়কুটো’ কবিতাটিতে কি অবিভক্ত বাংলাদেশের কোনো ইঙ্গিত আছে?
শঙ্খ ঘোষ : ইঙ্গিতটা বিভক্ত বাংলাদেশেরই। তবে সেই সূচনাসময়টার কথা যখন আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম যে এই বিভাজন স্থায়ী হবে না, হতে পারে না, অচিরেই দূর হবে বিভেদ। কিন্তু এই কথাগুলির ঠিক আগেই আছে ঘোর বর্তমানের কথা, ‘জলেরও কোনো ভাগবাটোয়ারা নেই’ ধরনের আকস্মিক উচ্চারণ। বস্তুত, পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ হয়ে উঠবার পরে আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো মিলন-বিচ্ছেদ-পুনর্মিলন একাকার হয়ে গেছে।

কবি শঙ্খ ঘোষের বিধাননগর বাড়িতে সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী 

রনি অধিকারী : ‘একদিন ছিল, আজ সে-জলের তল থেকে দেখি/ মাটির উপরে সেই স্থলপদ্ম পরিত্যক্ত বাড়ি’ —এ কি আপনার ছোটবেলার স্মৃতিজড়িত বসতবাড়ি?
শঙ্খ ঘোষ : একেবারেই তাই। দেশ ছাড়বার ঠিক পঞ্চাশ বছর পর সেই বাড়ির কাছে একবার যেতে পেরেছিলাম। ফিরে আসার পর বেশ কয়েকটা লেখাতেই ঘুরে ঘুরে এসেছে সেই বাড়ির ভিতর-বাহিরের পরিব্যাপ্ত ছায়া।
কবিতাটির প্রথমাংশে যে ছবিগুলি আছে তার পুরোটাই ফেলে আসা দেশের, তারপর সেটা স্মৃতি হয়ে জড়াতে চায় যে-শহরে, সে তো আমার ছিন্নমূল অবস্থান। আর, একেবারে শেষ লাইনটায় সেসব ছাড়িয়ে এটা চলে যেতে চায় অপূর্ণতার সংশয়ে আতুর এক প্রেমানুভবে।


দেশ ছাড়বার ঠিক পঞ্চাশ বছর পর সেই বাড়ির কাছে একবার যেতে পেরেছিলাম। ফিরে আসার পর বেশ কয়েকটা লেখাতেই ঘুরে ঘুরে এসেছে সেই বাড়ির ভিতর-বাহিরের পরিব্যাপ্ত ছায়া।

রনি অধিকারী : ইদানীং পাঠকরা কবিতা বুঝতে চান তার অর্থ দিয়ে। মূলত আমি বলতে চাচ্ছি- কবিতার ‘অর্থ’ বলতে কী বোঝায়?
শঙ্খ ঘোষ : অনেক সময়ে কবিতার ‘অর্থ’ বলতে কী বোঝায়, কতদূর বোঝায়, এ নিয়ে দেশে-বিদেশে কথার কোনো অন্ত নেই। এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ‘অর্থ’ বা ‘অর্থহীনতা’ নিয়ে তর্কবিবাদ হয়েছে বিস্তর, অনেক বিশিষ্টজনই সন্দেহ করেছেন সেসব কবিতার কবিত্বে। অস্পষ্টতার অভিযোগে আক্রমণাত্মক প্রবন্ধ লিখেছেন দ্বিজেন্দ্রলালের মতো লেখকেরা। উলটোদিকে প্রথম যৌবনে আমরা প্রায়ই আওড়াতাম ‘Ars Poetica’ নামে আর্চিবল্ড্ ম্যাকলিসের একটি কবিতার শেষ দুটি লাইন। ‘A poem should not mean/ But be.’ সরলার্থের বাইরে চলে-যাওয়া এই প্রবণতার ফলে হয়তো একরকম দুরূহতার সঞ্চার হয় কবিতায়। দুরূহতাই কবিতা নয়, কিন্তু কবিতা অনেক সময়েই গূঢ়ার্থে দুরূহ। এমনও ঘটতে পারে যে, স্বয়ং কবিকে তা ব্যাখ্যা করতে বললে তিনিও হয়তো অপারগ হবেন। 

রনি অধিকারী : কবিতার জন্ম বিষয়ে কোনো মত ও পথ কি আপনার জানা আছে?
শঙ্খ ঘোষ : কবিতার জন্ম-বিষয়ে কোনো একক পথ বা পদ্ধতির কথা আমি মানি না। নানা স্তরের কবিতার নানা রকম জন্মমুহূর্ত। যা সহজেই দেখতে পাওয়া যায়, অথচ যার বিষয়ে সবসময়ে আমি তত সচেতন থাকি না, তেমন কোনো দেখার আকস্মিক উদ্ভাস থেকেও ভালো কবিতার জন্ম হতে পারে অনেক সময়েই।

রনি অধিকারী : কবিতা লিখবার জন্য কোন বিষয়গুলো ভাবতে হবে?
শঙ্খ ঘোষ : কবিতা লিখবার জন্য বিশেষ কোনো দেশীয় প্রেক্ষিত ভাবতে হবে, এটা আমি মনে করি না। সে-প্রেক্ষিত তো আপনিই এসে যাবার কথা তার ভাষাগুণে, তার অভিজ্ঞতাসূত্রে। সমসাময়িক হবার জন্য কোনো স্বতন্ত্র চেষ্টার বা স্বতন্ত্র রূপের দরকার আছে বলে মনে হয় না। যে-কোনো সত্যাশ্রয়ই কবিতাকে সমসাময়িকতা দেয় চিরন্তনের অভিমুখে।

রনি অধিকারী : কবিতার ছন্দ ও ছন্দহীনতা সম্পর্কে বলুন।
শঙ্খ ঘোষ : কোনোভাবেই পাঠকের কাছে পৌঁছবার কথা ভেবে কবিতার রূপ তৈরি হয় না। অন্তত আমার তা হয়নি কখনো। এমনকি, মনোভঙ্গি বা বিষয়ের প্রয়োজনটাও সচেতন কোনো কাজ করে না। কবিতা লেখার সময়ে প্রাথমিক যে ধাক্কাটা আসে, সেটা কোনো ভাবনায় নয়, অনুভবে। আর সেই অনুভব আচমকা একটা লাইন তুলে আনে, কোনো বিশেষ ছন্দে বা ছন্দহীনতায়। তারপর সেই চালেই চলতে থাকে একটি কবিতা। অর্থাৎ রচনাক্রমটা এ-রকম নয় যে, এবার একটু শেষ করা যাক কিংবা অনেক পাঠকের বা বিশেষ ধরনের পাঠকদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করা যাক, আর সেইজন্য এবার ছড়ার ছন্দ ধরা যাক কিংবা লোকসংগীত বা পৌরাণিক আখ্যান। এখানে উদাহরণস্বরূপ একটা কবিতার কথা বলা হলো— ‘ভিখিরির আবার পছন্দ’ কিন্তু ছ-মাত্রার চালে লেখা, ছড়ার ছন্দে নয়। ‘থাক সে পুরনো কাসুন্দি/ যুক্তিতর্ক চুলোয় যাক/ যেতে বলছ তো যাচ্ছি চলে/ ভাববার শুধু সময় চাই।’ এভাবে  এগোতে এগোতে ‘ভিখিরির আবার পছন্দ’ লাইনটা পড়ার টানে কথ্য চালে স্বভাবতই হয়ে যায় ‘ভিখিরিরাবার পছন্দ’। এইভাবে এখানে প্রতিটি লাইনেই প্রথম পর্বটি ছ-মাত্রার, শেষটি অপূর্ণ, চার কিংবা পাঁচ।

রনি অধিকারী : তরুণ কবিদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
শঙ্খ ঘোষ : তরুণরা ইদানীং ভালো লিখছে। তবে ওরা প্রতিনিয়ত ছন্দহীনতায় ভুগছে বলে মনে হয়।