• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২১, ০৮:০৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৭, ২০২১, ০৫:০৪ পিএম

খুব কাছে থেকে দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে : লুৎফর রহমান রিটন

খুব কাছে থেকে দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে : লুৎফর রহমান রিটন

বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন। ছড়াকার হিসেবে তিনি বিশেষভাবে জনপ্রিয়। সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী এই লেখকের ছেলাবেলাটি ছিল মধুর। দুইবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। সেই স্মৃতির কথা শুনতে চাওয়া হয় তাঁর কাছে। কথা হয় আরো নানা বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগরণের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক অঞ্জন আচার্য


জাগরণ : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা হওয়ার গল্পটি শুনতে চাই। 
লুৎফর রহমান রিটন :
আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উজ্জ্বল আর গৌরবময় স্মৃতি হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহ, সান্নিধ্য ও স্পর্শের স্মৃতি।
ওয়ারীর আকাশে বাকাট্টা হয়ে যাওয়া একটা মেজেন্টা রঙের ঘুড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে হেয়ার স্ট্রিট ও র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিট ইন্টারসেকশনের কাছে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের হাতে ধরা পড়ার পর দাদাভাই আমাকে সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ভেতরে একটা ছবি আঁকার ক্লাসে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন নতুন একজন শিক্ষার্থী হিসেবে। আমার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে ওখানে ছবি আঁকছিল। ক্লাসে শিক্ষক হিসেবে পেলাম হরিদাশ বর্মণকে। দাদাভাই বললেন—বর্মণবাবু, আপনার জন্য নতুন একটা ছাত্র নিয়ে এলাম। 
হরিদাশ বর্মণ স্যার খুব আদর করে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন কয়েকটা তুলি আর বড় একটা কার্টিজ পেপার। ক্লিপ আঁটা একটা বোর্ডও দিলেন। আর দিলেন চ্যাপ্টা একটা শুভ্র থালা। থালায় নির্দিষ্ট একটা গ্যাপে গ্যাপে প্যালিকেনের ঝকঝকে কৌটা থেকে তুলে দিলেন কিছু লাল, নীল, হলুদ, সাদা আর কালো রং। অতঃপর শুরু হলো আমার ছবি আঁকা। কচি-কাঁচার মেলার ছবি আঁকার ক্লাস ‘শিল্পবিতান’-এর নিয়মিত ছাত্র হয়ে উঠলাম আমি। সময়টা ১৯৭২। ইসলামিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র আমি তখন।
বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে দাদাভাই আমাদের ক্লাসে এসে বললেন—তোমাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকতে হবে। একাত্তরের ছবি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার ছবি। খানসেনা আর ওদের দোসরদের নির্যাতন, নিপীড়ন, অগ্নিকাণ্ড, মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই, প্রতিরোধের ছবি। 
মহা উৎসাহে আমরা লেগে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকায়। কী বিপুল উদ্যম আমাদের! কত ছবি যে আঁকলাম আমরা! হরিদাশ স্যার আমাকে উৎসাহ দেন। আমাকে শিখিয়ে দেন রঙের সঙ্গে রং মিশিয়ে নতুন একটা রং তৈরির ত্বরিত পদ্ধতি। আমার জানা হয়ে যায়—লালের সঙ্গে হলুদ মেশালেই কমলা রঙের আবির্ভাব ঘটে। নীলের সঙ্গে হলুদ মেশালে সবুজ কলাপাতা রং। লালের সঙ্গে সাদা মেশালে গোলাপি। সাদার সঙ্গে কালো মেশালে ধূসর। কালোর সঙ্গে লাল মেশালে চকলেট। এবং লাল আর নীল মেশালে বেগুনি। অপরূপ ঝলমলে বর্ণাঢ্য এক পৃথিবীর সন্ধান পেয়ে গেলাম আমি। দাদাভাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী একের পর আঁকলাম মুক্তিযুদ্ধের ছবি। 
আমাদের আঁকা ছবিগুলো বড় একটা প্যাকেটে ভর্তি করে দাদাভাই এক সন্ধ্যায় (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) আমাদের নিয়ে গেলেন গণভবনে, বঙ্গবন্ধুর কাছে। সেই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখলাম একদম কাছ থেকে, যাকে বলে ছুঁয়ে দেওয়া দূরত্বে। খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের আঁকা ছবিগুলো দেখলেন বঙ্গবন্ধু। কোন ছবিটা কে এঁকেছে, দাদাভাই সেটা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। আমার আঁকা একটি ছবি দেখে বঙ্গবন্ধু খুব অবাক হওয়ার মতো ভঙ্গি করে প্রশ্ন করলেন—ওওও এটা তুমি এঁকেছো! সগর্বে মাথা দোলালাম আমি—হ্যাঁ আমিই তো আঁকলাম। এই যে ভয়ংকর পাকিস্তানি মিলিটারিরা গ্রামের একটা বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে! পরিবারের বাবাটিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে একজন মিলিটারি। উঠোনে বাবার লাশ। যুবক ভাইটিকে একজন মিলিটারি বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে! ছোট্ট একটা কোলের শিশুকে রাইফেলের ডগায় বেয়নেটে গেঁথে আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে ধরেছে একজন মিলিটারি। একজন মিলিটারির পা জড়িয়ে মা কাঁদছে। বোনটিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একজন মিলিটারি। বোনটির গায়ের শাড়ি অর্ধেক খুলে গেছে, বাবার রক্তে বোনটির সাদা রঙের শাড়িটার কিছু অংশ লাল হয়ে গেছে...।

আমার কথাবার্তায় খুব খুশি হয়ে হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু আমার গালে আর মাথায় হাত ছুঁয়ে আদর করে দিয়েছিলেন—বাহ্‌খুব সুন্দর হয়েছে তো তোমার আঁকা ছবিটা! 
ছেলেবেলা থেকেই খুব চটপটে আর ছটফটে ছিলাম আমি। বড়দের সঙ্গে কথা বলতে একটুও ভয় পেতাম না। ভয় পাইনি বঙ্গবন্ধুকেও। আর বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে এমন আন্তরিকতা মিশিয়ে কথা বলছিলেন যে আমার মনে হচ্ছিল তিনি আমাকে চেনেন। এই প্রথম আমাদের দেখা হচ্ছে না। এর আগেও দেখা হয়েছে বহুবার, এতটাই পরিচিত আমি তাঁর কাছে। সুতরাং তাঁকে ভয় পাব কেন? 
রাতে ঘটল বিশাল ঘটনা। বিটিভির নিউজে আমাদের দেখাল! সাদা-কালো টিভি তখন। দাদাভাই ছাড়াও আমাদের সঙ্গে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী হাশেম খান এবং ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন। 
আইডিয়াটা ছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের। মাঝেমধ্যেই কচি-কাঁচার মেলার ছবি আঁকার ক্লাসে আসতেন তিনি। প্রথমে র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিট সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেনের ক্যাম্পাসে, পরে জয়কালী মন্দির রোডে কেন্দ্রীয় মেলার ছবি আঁকার ক্লাসে। ইজেলে পিসবোর্ডের ক্লিপে কার্টিজ পেপার সাঁটিয়ে ছবি আঁকতাম আমরা সারিবদ্ধ হয়ে। কত দিন শিল্পাচার্য আমার স্কেচ ঠিক করে দিয়েছেন! তো, সেই শিল্পাচার্যই চাইছিলেন আমরা শিশু-কিশোররা যেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকি। শিল্পাচার্যের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের আঁকা ছবি থেকে তিনশ ছবি বাছাই করা হলো। 
আমাদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর একটা প্রদর্শনী হয়েছিল জয়কালী মন্দির মেলা ভবনেই। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সেই প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ। (আমাদের আঁকা তিনশ ছবি থেকে সত্তরটি ছবি বাছাই করেছিলেন শিল্পাচার্য। সেই ৭০টি ছবি নিয়েই আমরা গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে।) 
শিল্পাচার্য বিদেশ সফরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় আইডিয়াটা এসেছিল। তিনি সঙ্গে করে ছোটদের আঁকা কিছু মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে যেতে চান। তিনি চান বিশ্ববাসী দেখুক শিশুদের চোখে একাত্তরের ভয়াবহতা। নৃশংসতা। বঙ্গবন্ধুকে তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথাটা বলেছিলেন। শুনে বঙ্গবন্ধুও একমত পোষণ করেছিলেন—হ্যাঁ, আমাদের শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো দেখে বিশ্ববাসী বলুক বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য ছিল কি না।
আমাদের আঁকা ছবিগুলো শিল্পাচার্য নিয়ে গেলেন লন্ডনে। লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে ছবিগুলোর প্রদর্শনী হলো ১৯৭২ সালের ২২ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত। এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। প্রদর্শনী উপলক্ষে শিল্পী হাশেম খানের তত্ত্বাবধানে দু-তিন ভাঁজের দৃষ্টিনন্দন একটা ফোল্ডার ছাপা হয়েছিল। সেই ফোল্ডারে আমার আঁকা একটা ছবিও স্থান পেয়েছিল। ছবির ক্যাপশনে খুদে হরফে ছাপা হয়েছিল আঁকিয়ের নাম—রিটন, বয়স ৯ বছর।
লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে পরবর্তী সময়ে কানাডাসহ আটটি দেশের আটটি শহরে ছবিগুলোর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিপুল দর্শক সমাগম হয়েছিল সর্বত্র, সব কটি প্রদর্শনীতেই। ওখানকার পত্রপত্রিকায় ছাপা এ-সংক্রান্ত রিপোর্ট এবং বিশেষ প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশের শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবি। খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিল বিদেশের মাটিতে। শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ছবিগুলো রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল মিডিয়াসহ নানা পেশার মানুষের হৃদয়ে। বিবিসিসহ অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল অভিনব এই বিষয়টিকে। আমাদের মতো খুদে শিল্পীদের তুলিতে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করে হতভম্ব হয়েছিলেন ভিনদেশিরা। আর সেটা অবহিত হয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই কাহিনি আমাদের বলেছিলেন দাদাভাই ও হাশেম খান। 
পরে দাদাভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, আমাদের আঁকা কয়েকটা ছবি মস্কোতে পাঠানো হয়েছিল উপহার হিসেবে। রাষ্ট্রীয় উপহার।
শিল্পাচার্যের পরিকল্পনা অনুযায়ী রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের নেতৃত্বে যেদিন সন্ধ্যায় আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম, সেদিন রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবরে আমাদের দেখিয়েছিল। সাদা-কালো টিভিতে বঙ্গবন্ধুর পাশে নিজেকে অবলোকন করে ছোট্ট আমার কী যে আনন্দ, কী যে আনন্দ! 
তখন তো আর এখনকার মতো এতগুলো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিল না। ছিল শুধু একটাই, সবেধন নীলমণি ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’। কোটি কোটি দর্শক ছিল বিটিভির। ন্যাশনাল নিউজের কয়েক সেকেন্ডের ফুটেজ রীতিমতো ‘বিখ্যাত’ বানিয়ে দিয়েছিল আমাকে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য আমাকে প্রায় তারকার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। 
স্কুলে, রাস্তায় চেনা-অচেনা মানুষগুলো আমাকে আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়—আরে! এই ছেলেটাকেই না দেখলাম টিভিতে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে!
গর্বে আমার পা পড়ে না মাটিতে। সেই রাতের টেলিভিশন ছাড়াও পরের দিন সকালে প্রায় সব কটা দৈনিক পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে (কোনোটায় শেষের পাতায়) ছাপা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একদল শিশুর একটি ছবি। বঙ্গবন্ধুর পাশে তাঁর কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি আমি! দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া তিন কলাম সাত ইঞ্চি মাপের ছবিটা কেটে রেখে দিয়েছিলাম, অনেক যত্ন করে। ইত্তেফাক, অবজারভার, টাইমস-এও ছাপা হয়েছিল ছবিটা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। কয়েক বছর পর ‘সাপ্তাহিক খবর’ প্রকাশিত সৈয়দ আলী নওয়াব রচিত ‘আমি রাসেল বলছি’ নামের বইতেও সেই ছবিটা মুদ্রিত হতে দেখেছি। (বইটির পরবর্তী সংস্করণে লেখক হিসেবে মিজানুর রহমান মিজানের নাম ছাপা হয়েছে। প্রকাশক নভেল পাবলিশার্স) 
এরপরও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁকে।

জাগরণ : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার দ্বিতীয় সাক্ষাতের গল্পটা কেমন ছিল?
লুৎফর রহমান রিটন :
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কচি-কাঁচার মেলার জাতীয় শিক্ষাশিবির বা ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়েছিল গুলিস্তানের পাশে, বঙ্গভবনের উল্টো দিকে, শহীদ মতিউর শিশুপার্কে। সারা দেশ থেকে কচি-কাঁচার মেলার বিভিন্ন শাখার হাজারখানেক কিশোর-কিশোরী সেই ক্যাম্পে অংশ নিয়েছিল। আমিও অংশ নিয়েছিলাম সেই ক্যাম্পে কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে। মতিউর শিশুপার্কে আমরা থাকতাম তাঁবু খাটিয়ে। এই শিবির বা ক্যাম্পে কঠোর অনুশাসনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলত আমাদের নানা রকম কর্মকাণ্ড। শরীরচর্চা, প্যারেড-পিটি, ব্রতচারী, বাঁশনৃত্য, লাঠিখেলা, উপস্থিত বক্তৃতা, গান, আবৃত্তি কত কিছু! এই ক্যাম্পে ব্রতচারী শিক্ষক হিসেবে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত ‘ওস্তাদ ভাই’কে পেয়েছিলাম আমরা। বয়সে প্রবীণ কিন্তু শারীরিকভাবে শক্তিমান নবীন ছিলেন তিনি। ধনুকের ছিলার মতো টানটান শরীরের ওস্তাদ ভাই শেখাতেন লাঠি খেলা। ডানে-বাঁয়ে-সামনে-পেছনে বিদ্যুৎ গতিতে লাঠি চালিয়ে শত্রুকে কুপোকাৎ করার কৌশল শিখেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। কী বিস্ময়কর দ্রুততায়ই না লাঠি চালাতেন সেই বৃদ্ধ! একাই লড়তেন চার-চারজন লাঠিধারীর সঙ্গে! ওস্তাদ ভাইয়ের কাছেই শিখেছিলাম ব্রতচারী নৃত্য এবং সেই ‘নৃত্যের সঙ্গে গীত’ অনবদ্য কিছু গান—ইয়া জসোবা-ইয়া জসোবা গুরুজী ইয়া জসোবা/অবাক করে গুরুজী তব মানবসেবা/রায়বেশে কাঠি সারি ঢালি ঝুমুর ঝারি/তাই গেয়ে প্রণাম জানাই যতো ব্রতচারী/...(‘ইয়া’ একটি রিদমসমৃদ্ধ ধ্বনি, এবং জসোবা হচ্ছে ‘জয় সোনার বাংলা’র সংক্ষিপ্ত রূপ।)। শিখেছিলাম—মায়ের জাতের মুক্তি দে রে/যাত্রাপথের বিজয়রথে চক্র তোদের ঠেলবে কে রে?/মায়ের জাতের মুক্ত প্রভাব/গড়বে তোদের বীরের স্বভাব/বিশ্ব সভার উচ্চাসনে চড়বে না কেউ তোদের ছেড়ে/...।

ক্যাম্পে আমাদের প্রত্যেকের বুকে একটা ব্যাজ ও সংখ্যা লেখা একটা স্টিকার সাঁটানো থাকত। আমার সংখ্যাটি ছিল সম্ভবত ৩৮০। এই সংখ্যার মাধ্যমেই আমাদের আইডেন্টিফাই করা হতো। আমাদের সারা দিনের কর্মকাণ্ড আচরণ ইত্যাদি গোপনে লক্ষ রাখতেন সিনিয়ররা অর্থাৎ সাথিভাইয়েরা। সাথিভাইয়েরা আমাদের কীভাবে খেয়াল রাখতেন, সেটা আমরা টেরও পেতাম না। প্রতিদিন আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আচরণ ও সাফল্য ব্যর্থতা অনুযায়ী তাঁরা নম্বর দিতেন (তাঁদের নোট বইয়ে টুকে রাখতেন।)। সেই নম্বরগুলো যোগ করে মেলার সমাপ্তিতে তিনটি ক্যাটাগরিতে আমাদের কয়েকজনকে খেতাবে ভূষিত করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। সেই ক্যাম্পের সর্বোচ্চ খেতাব ‘দলমণি’ অর্জন করেছিলাম আমি। দাদাভাই বলেছিলেন, ক্যাম্পের সমাপ্তিপূর্ব কোনো একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে অথবা দাদাভাই আমাদের নিয়ে যাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করেছি—কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! কখন দেখব তাঁকে সামনাসামনি! 
তো আমাদের ক্যাম্পের তাঁবুবাসের শেষ দিকে, এক মনোরম বিকেলে অনেকগুলো বাস বোঝাই হয়ে আমরা গিয়েছিলাম গণভবনে, বঙ্গবন্ধুর কাছে। ১৯৭২-এর পর সেটা ছিল আমার ছুঁয়ে দেওয়া দূরত্ব থেকে দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধু-দর্শন।
সেদিনের সেই বিকেলটা খুবই মনোরম ছিল। উজ্জ্বল সোনালি রোদের আভায় ভীষণ চকচকে ছিল। আমাদের পেয়ে কী রকম উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু! সহসা বঙ্গবন্ধু দাদাভাইকে বললেন, আসেন দাদাভাই আপনার সঙ্গে একটু ব্রতচারী হয়ে যাক। তারপর ঝাউর গিজার গিজঘিনিতা/ঝাউর গিজার গিজঘিনিতা/এক ধামা চাল একটা পটল/এক ধামা চাল একটা পটল—বলতে বলতে বঙ্গবন্ধু নির্দিষ্ট একটা রিদমে ব্রতচারীর একটা মুদ্রা এমন চমৎকার নিখুঁত দেহভঙ্গিতে আমাদের দেখালেন যে হাততালিতে মুখর হয়ে উঠলাম আমরা। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য! বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্রতচারী নৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন দাদাভাইও। দাদাভাই আর বঙ্গবন্ধুর যৌথ ব্রতচারী নৃত্যের অবিস্মরণীয় সেই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন কোনো আলোকচিত্রী। যদিও সেই আলোকচিত্র আমার দেখা হয়নি।
সেই বিকেলে আমাদের নিজস্ব কিছু আনুষ্ঠানিকতাও ছিল। আমার নেতৃত্বে মার্চপাস্ট হলো। মার্চপাস্টে ছেলেমেয়েদের স্যালুট গ্রহণ করলেন বঙ্গবন্ধু। মার্চপাস্টের শুরুতে ছোট্ট এইটুকুন আমি বিশাল দেহের বঙ্গবন্ধুর মাথায় পরিয়ে দিলাম কচি-কাঁচার মেলার ক্যাপ। খুব নিচু হয়ে মাথাটা আমার নাগালের কাছে নামিয়ে এনে বিরাট-বিশাল বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলেন আমার মতো একজন খুদে বন্ধুর স্মারক উপহার। বঙ্গবন্ধুর মাথা এবং মাথার চুল স্পর্শ করতে হলো আমাকে, ক্যাপটা তাঁকে পরাতে গিয়ে। তাঁর শক্ত এবং ঘন কালো চুলগুলো ভীষণ ঠান্ডা ছিল। আমাদের কাছে আসার আগপর্যন্ত সারাটা দিন একটানা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ছিলেন বলেই কি তাঁর সতেজ ঘন চুলগুলো এত শীতল লাগছিল আমার কাছে! কী জানি! 
ক্যাপটা পরানোর পর বঙ্গবন্ধু হ্যান্ডশেক করলেন আমার সঙ্গে। আহা কী নরম তাঁর হাতটা! তারপর তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত তর্জনীটি, একাত্তরের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অবিস্মরণীয় সেই আঙুলটি আমার দিকে তাক করে খুবই হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বললেন—আরে এই ছেলেটাকে তো মনে হয় চিনি আমি!
আমি আমার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে তাঁর হাতটা জড়িয়ে ধরলাম—হ্যাঁ চেনেন তো! আমি রিটন। ছবি আঁকি। আমাদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম তো!
বঙ্গবন্ধু বললেন—আরে তাই তো এইটাই তো সেই আর্টিস্ট ছেলেটা। খুব সুন্দর ছবি আঁকে! বড় হয়ে কী হবা তুমি?
—আর্টিস্ট হব।
—কত বড় আর্টিস্ট হবা?
—জয়নুল আবেদিনের মতো বড় আর্টিস্ট হব বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু বললেন—বাহ্‌আমাদের তাহলে দুইটা জয়নুল আবেদিন হবে! 
আমাদের কথোপকথনের সময় পাশে থাকা কবি সুফিয়া কামাল আর রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই খুব হাসছিলেন। আসলে ছেলেবেলা থেকেই খুব চটপটে আর ছটফটে ছিলাম আমি। বড়দের সঙ্গে কথা বলতে একটুও ভয় পেতাম না। ভয় পাইনি বঙ্গবন্ধুকেও। আর বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছিলেন যে আমাকে তিনি অনেক আগে থেকেই চেনেন! এই প্রথম আমাদের দেখা হচ্ছে না। এর আগেও দেখা হয়েছে বহুবার, এতটাই পরিচিত আমি তাঁর কাছে। 
আমার মাথায় কাঁধে গালে আর চিবুকে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে আদর করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। 
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাতের এই ঘটনার একটাই স্টিল ছবি পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু স্যালুট নিচ্ছেন কচি-কাঁচার মেলার ভাইবোনদের। তাঁর বাঁ পাশে কবি বেগম সুফিয়া কামাল আর দাদাভাইয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি আমি সেদিনের ছোট্ট বালক লুৎফর রহমান রিটন।
অতি সম্প্রতি একটা ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেই ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে বিশাল দেহের বঙ্গবন্ধু মাথাটা নিচু করে আমার নাগালের মধ্যে এনে দিচ্ছেন আর আমি তাঁর মাথায় পরিয়ে দিচ্ছি ক্যাপ। তিনি আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। তাঁর বিখ্যাত তর্জনীটি আমার দিকে তাক করে কথা বলছেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে। ছোট্ট বালক আমি একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে খুব হাসিখুশি ভঙ্গিতে কথা বলছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। আমাদের কথোপকথন শুনে হাসছেন দাদাভাই ও সুফিয়া কামালও। অপরূপ হাসিমুখে সুফিয়া কামাল হাততালি দিচ্ছেন। একটা অসাধারণ ফ্রেম। সেই ফ্রেমে বঙ্গবন্ধুসহ আমরা সবাই হাস্যোজ্জ্বল। আহা কী গৌরবসঞ্চারী একটা দৃশ্য। আমার সারা জীবনের এক অনন্য প্রাপ্তি এই ভিডিও ফুটেজটি। কুমার বিশ্বজিতের একটি গানে এই ফুটেজটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রচারিত হয়েছে চ্যানেল আইয়ে। 
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার এই দ্বিতীয় সাক্ষাতের ঘটনাটা বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবর ছাড়াও সিনেমা হলগুলোতে দেখানো হয়েছিল। সে আরেক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা ছিল আমার জীবনে।
তখন বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে সিনেমা শুরু হওয়ার আগে ‘চিত্রে বাংলাদেশের খবর’ নামে একটা সেগমেন্ট প্রচারিত হতো। বঙ্গবন্ধুর মাথায় আমি কচি-কাঁচার মেলার ক্যাপ পরিয়ে দিচ্ছি, তিনি নিচু হয়ে ঝুঁকে আমাকে সহায়তা করছেন, ক্লোজ শটে এই দৃশ্যটি ‘চিত্রে বাংলাদেশের খবরে’ বহুদিন দেখানো হয়েছিল। গমগমে ভরাট হিরণ্ময় কণ্ঠে এই খবর পাঠ করেছিলেন বিখ্যাত সংবাদ পাঠক সরকার কবির উদ্দিন। মধুমিতা সিনেমা হলের বিরাট পর্দায় সেই দৃশ্য আমাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন অগ্রজ এ টি এম মিজানুর রহমান। আহা কী মধুর সেই দৃশ্য! কয়েক সেকেন্ডের সেই দৃশ্যটা দেখার জন্য সিনেমার দুটি টিকিট কিনতে হয়েছিল আমার অগ্রজকে। বাড়তি পাওনা হিসেবে সেদিন কোন সিনেমাটা দেখেছিলাম, সেটা আজ মনে নেই। তবে সিনেমার বড় পর্দায় সাদা-কালো ঝকঝকে চলমান ছবিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিজেকে অবলোকনের সেই স্মৃতিটা আমার মস্তিষ্কে মুদ্রিত হয়ে থাকল স্থায়ীভাবে।

জাগরণ : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনি বেশ কিছু বই লিখেছেন, সম্পাদনা করেছেন। সেগুলো সম্পর্কে কিছু বলবেন।
লুৎফর রহমান রিটন :
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর ভয়াবহ একটা গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সারা দেশে। সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড এতটাই নৃশংস ছিল যে হতবিহ্বল বিমূঢ় মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক শোক প্রকাশও ছিল তখন রীতিমতো দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। ঘাতক সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের দুঃশাসন এবং পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি হয়েছিল নৈরাশ্যের দমবন্ধ এক গুমোট পরিস্থিতির। সামরিক শাসকের লিখিত ও অলিখিত ভীতি আর বাধ্যবাধকতার ভেতরে আমরা পার করছিলাম এক পাথারচাপা সময়। মানুষের ভেতরের জমাটবাঁধা ক্ষোভ-ঘৃণা আর প্রতিরোধের নিভু নিভু চেতনাকে উসকে দিতে তখন প্রয়োজন ছিল এক বা একাধিক বাঁশিওয়ালার। যিনি বা যাঁরা বাঁশিতে সম্মোহনী সুর তুলে পাথরচাপা সময়ের আগলটিকে ভেঙে দেবেন। রাজনীতিবিদরা যখন প্রলোভনের যৌনতায় কাতর হয়ে আপসের মখমলে নিদ্রামগ্ন তখন বিপন্ন ও বিষণ্ণ জাতির সামনে আশা আর স্বপ্নের প্রদীপ হাতে এগিয়ে এসেছিলেন কিছু দুঃসাহসী কবি-ছড়াকার-লেখক-সংস্কৃতিকর্মী। পাথরচাপা সেই অন্ধকার সময়ে ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা পাঠের আসরে প্রথম দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। বঙ্গবন্ধুকে বিষয় করে লেখা একটা কবিতা সেই প্রথম প্রকাশ্যে পাঠ করেছিলেন তিনি। 
পরের বছর, ১৯৭৮ সালের একুশের স্নিগ্ধ সকালে জাতির মননের প্রতীক সেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই ঘটল অবিস্মরণীয় আরেকটি ঘটনা। হঠাৎ করেই দু-তিনজন সাহসী মানুষ উদিত হলেন বইমেলার মাঠে, কবিতা পাঠের আসরের শামিয়ানার আশপাশে। তাঁদের হাতে বঙ্গবন্ধুকে বিষয় করে রচিত একগুচ্ছ ছড়া আর কবিতার অনন্যসাধারণ সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’। খুব দ্রুত, বলতে গেলে চোখের পলকে সেই সংকলনের সব কপি নিঃশেষ হয়ে গেল। এই রকম একটি সংকলন হাতে পেয়ে মানুষের সে কী আবেগ! সে কী প্রতিক্রিয়া! খুব কাছে থেকে সেই প্রতিক্রিয়া অবলোকন করছিলাম বালক আমি, কিশোর আমি, অশ্রুসজল চোখে। কারণ, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ নামের সেই বিস্ময়কর সংকলনের লেখক তালিকায় কিংবদন্তি ছড়ালেখক অন্নদাশঙ্কর রায় থেকে শুরু করে সেদিনের নবীন কিশোর ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন পর্যন্ত মুদ্রিত ছিল! 
বিপদের ঝুঁকি নিয়েই সেই সংকলন বিক্রি করছিলেন দুঃসাহসী কয়েকজন মুজিবপ্রেমী। একটি ঐতিহাসিক ঘটনাই ছিল ১৯৭৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলায় প্রকাশিত ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ সংকলনটি। এখনকার প্রজন্ম হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না, সংকলনটি প্রকাশকালে, তেতাল্লিশ বছর আগে কী ভয়ংকর দমবন্ধ একটা অন্ধকার পাথর সময় বিরাজ করছিল বাংলাদেশে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণও একটা দুঃসাহসের ব্যাপার ছিল তখন।
এরপর দীর্ঘ একটা সময় ধরে চলেছে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে ইতিহাস থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলে ইতিহাস বিকৃতির এক ঘৃণ্য উৎসব। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। রেডিও-টেলিভিশন-সংবাদপত্র থেকেও নির্বাসিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই গ্রহণকালের দমবন্ধ গুমোট পরিবেশে কবি-লেখক-শিল্পীরাই ছিলেন দুঃসময়ের অর্গল ভাঙার লড়াকু সৈনিক। বর্তমান প্রজন্ম কোনো দিন উপলব্ধিই করতে পারবে না কী এক ক্রান্তিকাল আমরা অতিক্রম করেছিলাম। 
পঁচাত্তরের পর, স্বাধীন দেশে পরাধীন সময়ে প্রকাশিত আমাদের রচনাগুলো, সংকলনগুলো, বইগুলো ইতিহাসের অন্ধকারকে ধারণ করে আছে। 
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার প্রথম ছড়ার বই ‘শেখ মুজিবের ছড়া’ যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বইটা বেরিয়েছিল ১৯৯৩ সালে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল স্বাধীনতার একুশ বছর পর, ১৯৯৬ সালে। 
আমি অপেক্ষা করিনি সুযোগসন্ধানীদের মতো যারা আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবার পর পরিস্থিতি অনুকূলে বুঝে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থ রচনায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন! 
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার লেখা কয়েকটা বইয়ের নাম বলি এবার—শেখ মুজিবের ছড়া (১৯৯৩), সোনার ছেলে খোকা (২০০১), একটি মুজিবরের থেকে (২০০৮), জয় বাংলার ছড়া জয় মুজিবের ছড়া (২০১৪), শেখ রাসেলকে লেখা চিঠি (২০১৫), বঙ্গবন্ধু সমগ্র (২০১৬), ছোটদের বঙ্গবন্ধুর ছড়া (২০২০), আমার শৈশব আমার বঙ্গবন্ধু (২০২১), আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু (২০২১)। 
মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু বুকশেলফে সাজিয়ে রাখার কোনো শোপিস নয়। 
বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হয় চিন্তায়-চেতনায়-মননে ও মেধায়।

জাগরণ : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি ছড়া আপনি লিখেছেন। আপনার চোখে ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ কেমন?
লুৎফর রহমান রিটন :
ছেলেবেলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন আমার দেখা হয় তখন তো আমার স্বপ্ন ছিল চিত্রশিল্পী হওয়ার। কিন্তু নিয়তি বা প্রকৃতি চাইছিল ভিন্ন কিছু। তিনি যখন আমার মাথায় চুলে কপালে কাঁধে চিবুকে স্পর্শ করে করে আদর করে দিচ্ছিলেন, তখনই আসলে ঘটে যাচ্ছে অদ্ভুত একটা শিহরণ। বিপুল একটা আলোড়ন। বঙ্গবন্ধুর মতো বিরাট বিশাল হিমালয়সম মানুষটার অলৌকিক সান্নিধ্য আমার ভেতরে কিছু একটা ওলটপালট তো ঘটিয়েই থাকবে। কিন্তু সেটা বোঝার মতো বয়স তখন আমার ছিল না। আমি বুঝিওনি। কিন্তু তিনি তো পরশ পাথরের মতো! তাঁর অবিনাশী স্পর্শের জাদুতে নিয়তি তখনই সিদ্ধান্তটা পাকাপাকি করে ফেলেছিল যে—বড় হয়ে আমাকে হতে হবে লেখক। কবি। এবং আমার লেখার বিষয় হবেন বঙ্গবন্ধু। এবং পরবর্তী সারাটা জীবন আমাকে লিখে যেতে হবে ছড়া একের পর এক, তাঁকে নিয়ে। ধারাবাহিকভাবে আমাকে লিখতে হবে বই, বন্ধুকে নিয়ে। একের পর এক। একটা বই দুটো বই। সাতটা আটটা দশটা বই। 
আমি যখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখি তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। কেমন একটা স্বপ্ন-বাস্তবতার মাঝামাঝি জায়গায়। যেন আমি লিখি না। আমি লিখছি না। প্রকৃতিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে যেন-বা! 
শৈশবে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যস্মৃতি আমার মনোজগতে চিরস্থায়ী একটা ছাপ ফেলে দিয়েছিল। তাঁর স্পর্শের সৌরভ আর সান্নিধ্যের গৌরব দীপান্বিত করেছিল আমাকে। সেই বৈভব আমি বহন করে চলেছি আজও। আমার করোটির চিরহরিৎ অলিন্দে থাকা, হৃদয়ের গভীর গোপন কুঠুরিতে থাকা একজন মুজিব প্রায়শই ছন্দ হয়ে হাসেন এবং ছড়া হয়ে আসেন। প্রকৃতি এক অদ্ভুত খেলা খেলে আমার সঙ্গে। একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে যেন-বা প্রকৃতিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় শেখ মুজিবের ছড়া। একের পর এক। আর সেটা মুদ্রিত হয় আমার নামে—“কান পেতে শোনো এই বাংলার মাটি বায়ু নদী সরোবর/জপিতেছে নাম করিয়া প্রণাম মুজিবর আহা মুজিবর...।”
কবি সুনীল গঙ্গোপধ্যায় তাঁর একটি প্রেমের কবিতায় বলেছিলেন— 
“এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ 
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?” 
সুনীলের সেই কবিতার পঙ্‌ক্তির মতো আমিও বলতে পারি দ্বিধাহীন চিত্তে—
“বঙ্গবন্ধুর হাত ছুঁয়েছে আমার চিবুক, 
স্পর্শ করেছে আমার কাঁধ, 
তাঁর জাদুককি আশীর্বাদের হাতটি তিনি রেখেছিলেন অপাপবিদ্ধ বালক আমার ছোট্ট এইটুকুন মাথায়, 
বঙ্গবন্ধুর অলৌকিক স্পর্শ লাগা আমার শরীর-মন-মেধা-মনন কি কোনো পাপ করতে পারে?” 

আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের জবাবে বলি— 
আমার চোখে ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ হচ্ছেন অনুপ্রেরণার হিমালয় পর্বত। 
ছোটদের সত্যিকারের বন্ধু ছিলেন তিনি। ছোটদের সত্যিকারের বন্ধু হতেন তিনি। কিন্তু সেই সময় তো তাঁকে দেওয়াই হলো না! তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের শিশুরা নিরাপদ একটা জীবন পেত নিশ্চয়ই। যে জীবনে শিশুদের আনন্দময় শৈশব আর সুখী সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা থাকত। মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের সব কটাই তাদের অধিকারে থাকত। অনাহারে থাকতে হতো না একটি শিশুকেও। ফুটপাতে ঘুমুতে হতো না একটি শিশুকেও। প্রতিটি শিশুর পরনে থাকত ঝলমলে পোশাক। ইশকুলে যেত প্রতিটা শিশু। বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেতে হতো না একটি শিশুকেও। বাংলাদেশটা হয়ে উঠত শিশুদের স্বর্গ। 

জাগরণ : বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, চেতনা কতখানি ধারণ করতে পারছে এ প্রজন্মের মানুষ?
লুৎফর রহমান রিটন :
খুব একটা পারছে না। কারণ, এই প্রজন্ম তো সময় কিংবা সুযোগই পেল না বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, চেতনা ধারণ করার। কয়েক যুগ ধরে ইতিহাসের যে বিকৃতি চলমান ছিল, সেই বিকৃতির প্রভাব তো এই প্রজন্মের ওপর থাকবেই। আছেও। তবে আমি হতাশ নই। আমরা, মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর চেতন-আদর্শ ধারণকারী লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক-কবি-সাংস্কৃতিকযোদ্ধারা বিরুদ্ধ স্রোতের মুখেও দায়িত্বে অটল ছিলাম। এখনো আছি। অন্ধকার ঘুচে যাবে। যাবেই। 

জাগরণ : বঙ্গবন্ধুর গড়া আওয়ামী লীগ ও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো তফাত দেখতে পান কি? পেলে সেটি কেমন?
লুৎফর রহমান রিটন :
তফাত তো থাকবেই। সময় পাল্টেছে, প্রেক্ষিত পাল্টেছে, পাল্টেছে বাঙালির যাপিত জীবনের অনুষঙ্গসমূহ। পাল্টেছে ইতিহাসের প্রেক্ষাপট এবং দায়ও। বঙ্গবন্ধুর গড়া আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাতে নতুন মাত্রা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতেই হইবে’ বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তো বেঁচে থাকতেই পারলেন না। পাকিস্তানপন্থী ঘাতকরা তাঁকে হত্যা করল সপরিবার। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ জাতির জনকের হত্যাকারীদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করেছেন। এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত সেই কাজটা—যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তাদের মূল হোতাদের ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর করেছেন তিনি। এভাবেই বাংলার ইতিহাসের কলঙ্কমোচনের কাজটা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই তো সংগঠিত হতে পারল! দলটির নেতৃত্ব অন্য কারও হাতে থাকলে এমনটা হতো না আমি নিশ্চিত। সাম্প্রতিককালে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বলে প্রচুর সুযোগসন্ধানী এবং সংঘবদ্ধ লুটেরা চক্র এসে ভিড়েছে দলে। ব্যাপক লুটপাটে অংশ নিচ্ছে তারা। শেখ হাসিনা প্রতিহত করতে চাইছেন তাদের, কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রায়শ তাঁকে একাই মনে হয়। তিনি একা লড়ছেন। আর একা লড়তে গেলে কিছু অসংগতি ঘটবেই। সেটা ঘটছেও। তবে আমি হতাশ নই। শেষমেশ আমি আস্থা রাখি মুজিবকন্যার ওপরেই। 
ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে সারা দেশে জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ অর্থাৎ মুজিব বর্ষ এবং আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরপূর্তি উৎসব উদযাপিত হচ্ছে এমন একটা সময়ে যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্র ও সরকারের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকলে দৃশ্যপট কী হতো, সেটা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়! এই প্রজন্ম অনুমানও করতে পারবে না—কী ভয়ংকর দুঃসময়ই না পেরিয়ে এসেছি আমরা!