• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২১, ০৬:৪৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৬, ২০২১, ০৯:৩৯ এএম

ধনীরা এমন নীতি নেয় যেন অসমতা অব্যাহত থাকে : এম এম আকাশ

ধনীরা এমন নীতি নেয় যেন অসমতা অব্যাহত থাকে : এম এম আকাশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। তাঁর মূল আগ্রহের বিষয় গ্রামীণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, দারিদ্র্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং একবিংশ শতকের সমাজতন্ত্র। বাংলা একাডেমি ও অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য তিনি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলেন জাগরণ অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানজিদা আক্তার শম্পা


জাগরণ : বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২/১৩৮। এবং এ সূচকে ১০০ নম্বরের মধ্যে আমাদের ৩৫ দশমিক ৯, যা প্রায় পাকিস্তানের সমান। এবং আমরা যদি দেখি শিক্ষা খাতের মতো স্বাস্থ্য খাত, মানব উন্নয়ন সূচকগুলোতেও উন্নয়ন ঘটছে না। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে, ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট থেকে এখন তা ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট। স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাওয়ার পরও এ খাতগুলোতে বরাদ্দ কম কেন?

এম এম আকাশ : আমাদের দেশের যারা নীতি নির্ধারণ করেন, তারা শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতকে অন্য দেশের সরকারের তুলনায় কম অগ্রাধিকার দেন। এ অগ্রাধিকারটা কম দিয়ে তারা বস্তুগত অবকাঠামো নির্মাণের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। আমরা দেখি, নানা রকম বড় বড় প্রকল্প। যেমন : মেট্রোরেল প্রকল্প থেকে শুরু করে টানেল প্রকল্প। তবে পদ্মা সেতু ঠিক আছে। কারণ এই সেতুটি সত্যিই প্রয়োজনীয়। কিন্তু বাকি অনেক প্রকল্প আছে, যেমন : বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। এখানে দুটো অসুবিধা আছে। একটা হলো, যা টাকা দেওয়া হয় তার চেয়ে অনেক কম টাকায় বা ২০-৩০ শতাংশ কম খরচে তা করা যেত। সুতরাং কিছু বাড়তি টাকা তারা অপচয় করে। আর সমগ্র মিলিয়ে এই বৃহৎ প্রকল্পের প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে। কারণ ওখান থেকে টাকা পাওয়া যায় বেশি। সুতরাং লবিং করে ওই দিকে টাকাটা চলে যায়। তবে সামাজিক যে নিরাপত্তা, সে খাতের জন্য—যেমন বয়স্ক ভাতা বা অন্যান্য তৃণমূল থেকে প্রাপ্ত হয়। তবু একটা লবিং থাকে, যাতে তাদের জেলায় এ জিনিসটা আসে। এই জায়গাতে কিছুটা অর্থ চলে যায়। কিন্তু বেচারা স্বাস্থ্য খাত বা শিক্ষা খাতের জন্য ছাত্ররাও তেমন আন্দোলন করে না। যারা অর্থের অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না, যাদের আয়ু কমে যাচ্ছে, সেটার তথ্য বা এর কোনো তীব্র প্রভাব নেই, যেটা থেকে মানুষ প্রতিবাদ করে রাস্তায় নেমে পড়বে। আর সরকার দেখে যে একটা বড় সেতু তৈরি করলে, বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে, আর একটা বড় রাস্তা তৈরি করলে বহু বাহবা পাওয়া যায়। আর এর সঙ্গে জড়িত কন্ট্রাক্টররা, দলের লোকেরা খুশি থাকে। সে জন্যই আমার ধারণা, এখানে টাকাটা কম আসে। আরেকটা কারণ হলো, টাকা বেশি যদি তুলতে পারত, ট্যাক্স করে তাহলে পরে দিতে পারত। কিন্তু ধনিক শ্রেণির ওপর সরকার ওতটা ট্যাক্সের বোঝা চাপাচ্ছে না। বেশি চাপাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর। এবং সেটা চাপাচ্ছে দ্রব্য করের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন করে। ওই সব দিয়ে যে টাকাটা ওঠানো হয়, ওই টাকাটা ওঠে অনেক। কিন্তু আরও বেশি ওঠাতে গেলে মুদ্রাস্ফীতি হবে, বিক্ষোভ হবে। সুতরাং অপ্রত্যক্ষ করই সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। সেখান থেকে একটা সীমাবদ্ধ আয় হয়। প্রত্যক্ষ কর খুব বেশি একটা বাড়াতে পারে না। সেখান থেকেও খুবই সীমাবদ্ধ আয় হয়। সব মিলিয়ে মোট ব্যয়যোগ্য আয় কমে যায়। এবং সেই কম ব্যয়যোগ্য আয়ের অধিকাংশ চলে যায় অবকাঠামো খাতে এবং নানা ধরনের লুটপাটের মধ্যে। সুতরাং শিক্ষা খাত ও স্বাস্থ্য খাত অবহেলিত হয়।

জাগরণ: বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম যে গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স প্রকাশ করে, সেখানে আমাদের অবনতি ঘটছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার পরে আমাদের অবস্থান। আমরা যদি দেখি তাহলে অবকাঠামোর জায়গা থেকে আমাদের উন্নয়ন ঘটছে। কিন্তু সুশাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সূচকগুলোতে আমাদের অবস্থান সম্মানজনক নয়। কীভাবে দেখছেন বিষয়টি?

এম এম আকাশ : গ্লোবাল কম্পিটিটিভ ইনডেক্স তৈরি হয় কস্ট অব বিজনেস দিয়ে। মানে ব্যবসা করতে কত খরচ হয় এবং এটা সাধারণত ব্যবসায়ীরা বলে। ব্যবসায়ীরা সাধারণভাবে তাদের অভিজ্ঞতা হলো ওয়ান্টস অব সার্ভিস বলে যে সার্ভিসটা তাদের পাওয়ার কথা ছিল, এক জায়গায় সমস্ত বিদ্যুৎ কানেকশন, পানির কানেকশন, জমি পাওয়া যাবে, এক জায়গায় সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে এবং কোনো একটা দলিল কোনো একটা পারমিট কোনো একটা রেজিস্ট্রেশন করতে উত্তর দিতে হবে না। সেগুলো আমরা দূর করতে পারিনি। কারণ, আমাদের প্রশাসন বিকেন্দ্রীভূত হয়নি এবং সেবামুখী হয়নি বা আপনি যেটা বললেন সুশাসন হয়নি। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি সার্ভিসের জন্য অবৈধ আয়ের ব্যবস্থা আছে। এই কারণেই কম্পিটিটিভ ইনডেক্সে আমাদের মান কম। 

জাগরণ : প্রবৃদ্ধির কথা যদি বলি, মুক্তবাজার অর্থনীতি। বাংলাদেশ এই ৫০ বছরে কতটুকু সমতাপূর্ণ প্রবৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করতে পেরেছে?

এম এম আকাশ : সমতা তো হয়নি। সমতা মাপি আমরা সাধারণত আমাদের যারা মূল জনসংখ্যা তাদের সবচেয়ে বেশি আয়ের যারা, তাদের শতকরা উঁচুর দিকে ১০ শতাংশ আর নিচের দিকে ৪০ শতাংশ। তাদের গড় আয়ের অনুপাত যদি দেখি তাহলে সেটাকে বলে পালমা রেশিও। পালমা রেশিও দিয়ে আমরা সাধারণত অসমতা মেপে থাকি। বাংলাদেশের এই পালমা রেশিও ক্রমাগত বাড়ছে। সুতরাং সরকারি ট্যাকটিকস অনুযায়ী তা বেড়ে বেড়ে ১.৩৮-এ আছে। তার মানে সবচেয়ে ওপরের লোকেরা সবচেয়ে নিচের লোকের চেয়ে ৩৮ গুণ বেশি আয় করছে। এটা ২০১৬ সালের রিপোর্ট। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, আগে ব্যবধানটা অনেক কম ছিল। আমরা যদি গিনি কোইফিশিয়েন্ট দিয়ে মাপি তাহলে আমরা প্রায়  দশমিক ৫০-এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। দশমিক ৫০ এখনো হয়নি। দশমিক ৫০ ইনডেক্স হলে পরে আমরা বলব যে আমরা ডেঞ্জার লিমিট ক্রস করেছি। কিন্তু যে টেন্ডেনসিটা এখন দেখা যাচ্ছে এটাই যদি সক্রিয় থাকে তাহলে সেটা আমরা অতিক্রম করব। করলে পরেও মধ্যম আয়ের দেশ হলেও সেখানে একটা মধ্যম আয়ের ফাঁদ আছে, সে ফাঁদের মধ্যে আমরা পরে যাব। উন্নত দেশ আর হতে পারব না। 

জাগরণ : বাংলাদেশে কি গেম থিউরি ব্যবহার হচ্ছে না। বাধা কোথায়? নীতিনির্ধারকরা সমস্যাগুলো তুলে ধরছেন কি? আর যদি তুলে ধরেন তারা তাহলে সমাধান কেন হচ্ছে না এবং এর পেছনে রাজনৈতিক আগ্রহ কেমন?

এম এম আকাশ : নীতি নির্ধারকেরা কাজ করছেন না তার কারণ হলো তারা দুই রকম। একটা হলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরেকটা হলো নির্বাহী নেতৃত্ব। নির্বাহী নেতৃত্ব হলো আমলা। এখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তো নির্বাচিত হয়ে আসার কথা, জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার কথা। কিন্তু আমরা সংসদে সদস্যের অনুপাত দেখি, তাহলে দেখতে পারব এর মধ্যে ৫০ ভাগেরও বেশি হচ্ছে ব্যবসায়ী। সুতরাং ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করছে। ব্যবসায়ীরা ধনী হয়ে থাকে। তাহলে তারা ধনীদের স্বার্থেই করছে। সুতরাং অসমতা থেকেই যাচ্ছে। তারা তো অসমতা চায়। তারা যেহেতু অসমতা চায় সেহেতু তারা এমন নীতি নেয় যেন অসমতা অব্যাহত থাকে। বা বলতে পারেন, এমন নীতি নেয় না— শতকরা ১০ ভাগের আয় যে হারে বাড়বে শতকরা ৪০ ভাগের আয় বেশি হারে বাড়বে। যদি নীতিটা এমনভাবে হতো যেটা আমাদের এসডিজির একটা লক্ষ্য এবং ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্টের লক্ষ্য। যেটা সরকার নিঃস্বার্থভাবে যেভাবে করেছে সেভাবে কার্যকর করতে হলে সরকারকে ব্যবসায়ীদের প্রভাবমুক্ত হতে হবে। 

জাগরণ : প্রথম পঞ্চবার্ষিকের সঙ্গে সর্বশেষ অনুমোদন পাওয়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিকের পার্থক্য কোথায়? এই ৫০ বছরে কী কী পলিসি নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন?

এম এম আকাশ : আমি তো মনে করি বৈষম্য, সম্পদের বৈষম্য, স্বাস্থ্যের বৈষম্য, শিক্ষার বৈষম্য কম করার জন্য কোনো নীতি নেওয়া হয়নি। তার মানে ভবিষ্যতের কথা ভাবা হয়নি। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের যে পরিকল্পনাগুলো আছে, সেটা কার্যকর করা উচিত ছিল। এর মানে হলো গরিবের আয় বেশি হারে বাড়বে সে রকম একটা নীতি দরকার ছিল। সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে যারা বেশি সম্পদের মালিক তাদের ওপর সম্পদ কর বসানো উচিত ছিল। কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে পেশি শক্তি বা ম্যানিপুলেশেন যেন কাজ না করে সে রকম একটা প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার ছিল। এগুলোর কিছুই হয়নি।