কবরীকে অন্তিম শ্রদ্ধা 

মোরশেদ শফিউল হাসান প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০২১, ১২:৩৩ পিএম কবরীকে অন্তিম শ্রদ্ধা 

তাঁর অভিনীত অনেক ছবিই আমি দেখিনি। হয় তো আগের ছবি পরে দেখেছি, পরের ছবি আগে। যেমন ‘সুতরাং’ ছবিটিই আমি দেখেছি অনেক পরে। তবে যখন যে ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখেছি, মনে হয়েছে এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। বিশেষ করে গ্রামীণ নারী চরিত্রের অভিনয়ে দুই বাঙলার চলচ্চিত্র মিলিয়েও তাঁর সমকক্ষ আরেকজন বোধহয় পাওয়া যাবে না (সন্ধ্যা রায়ের কথা মনে রেখেই বলছি)। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার, সহজ স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ের এক আশ্চর্য দক্ষতা ছিল তাঁর। 

চট্টগ্রামের যাত্রা মঞ্চের কিশোরী নৃত্যশিল্পী মীনা পাল থেকে তাঁর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার সংগ্রামটাও কম গৌরবজনক নয়। তাঁর এই অভিযাত্রাটাও উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে রূপায়িত হওয়ার দাবি রাখে, ভবিষ্যতে কেউ এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন কিনা জানি না। একটা বয়সের পর রুপালী পর্দার নায়ক-নায়িকাদের অনেকের পক্ষেই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সৌন্দর্যের সমন্বয় ঘটানো কঠিন হয়। কবরী সে ব্যাপারেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। শিল্পীর সামাজিক দায় পালনের কথা যদি বলি, সেখানেও আমাদের চলচ্চিত্র জগতের অনেকের আগেই তাঁর কথা আসবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। 

বাংলা চলচ্চিত্রের এই ‘মিষ্টি মেয়েটি’কে একবারই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। সে-ও মুহূর্ত কয়েকের জন্য। আমি তখন প্রেষণে সফিপুরস্থ আনসার একাডেমিতে গণশিক্ষা অফিসার পদে কর্মরত। সারা দেশের আনসার-ভিডিপি সদস্য-সদস্যা ও নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আত্মোনয়ন বিষয়ে ক্লাস নিই। সে সময় বাংলা চলচ্চিত্রের নৃত্যসহ অনেক রোমান্টিক দৃশ্যের চিত্রায়ন হতো আনসার একাডেমির কৃত্রিমভাবে তৈরি লেক ও তার চারপাশের সুন্দর পরিবেশে (পরে আনসার বিদ্রোহের ঘটনার পর বোধহয় শুটিংয়ের সে সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়)। তো একদিন আমি লেকের ধারের খড়ের ছাউনি দেওয়া ও চারপাশ খোলা বড় কুটিরের মতো ঘরটিতে আনসারদের ক্লাস নিচ্ছি। এমন সময় দেখা গেল কোনো এক চলচ্চিত্রের টিম (হয়তো লেকপাড়ে যাবার শর্টকাট পথ হিসেবে) ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন। আমি স্বভাবতই বিরক্ত। কিন্তু ওই লোকজনের মধ্যে সামনের দিকের ছোটখাটো মানুষটি যে কবরী সেটা প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। কারণ বিরক্ত আমার চোখ তখন দলের পুরুষ লোকগুলোর দিকে (তাঁদের মধ্যে হয়তো নায়কও ছিলেন, কিন্তু কে তা তখন হয়তো আমি লক্ষ্য করিনি, কিংবা এতদিন পর মনে নেই)। যাই হোক, কবরীকে দেখে ততক্ষণে প্রশিক্ষণার্থীরা চঞ্চল হয়ে উঠেছে, অনেকে বসা অবস্থা থেকে সারি ভেঙে এমনকি দাঁড়িয়েও গেছে। আমার অনুমতি এবং উপস্থিত ইন্সট্রাক্টরের কমান্ড ছাড়া যেখানে তাদের ‘আরামে বসা’রও সুযোগ নেই। আমার ধারণা ওভাবে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়া যে তাঁদের ঠিক হয়নি (এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই তাঁর নিজের কোনো ভূমিকা ছিল না), কবরী যেন তা বুঝতে পেরেছিলেন। চেয়ারে তখনও গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা আমার দিকে তাকিয়ে তিনি মৃদু হাসলেন। সে হাসিতে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভঙ্গি ছাড়াও কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবও যেন ছিল। আমি ততক্ষণে, হয়তো সেই মিষ্টি মুখের হাসি দেখেই, চিনে ফেলেছি তিনি কে। আমিও সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালাম। পর্দার বাইরে দেখা কবরীর সেই মিষ্টি হাসিটুকু আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল, হয়তো বাকি দিনগুলোতেও থাকবে। 

ব্যক্তিগতভাবে কবরী আমাদের বন্ধু শম্ভু পালের দিদি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পর শম্ভুর সঙ্গে আমার আর কখনো কোথাও দেখা হয়নি। অন্য বন্ধুদের কারো কারো কাছে কখনো কখনো তাঁর কিছু খবরাখবর পাই। শম্ভুকে আমার সমবেদনা জানাই।

আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কবরীর মতো আরেকজন জাত এবং একইসঙ্গে বড় মাপের শিল্পীকে পেতে হয়তো আমাদের অনেক কাল অপেক্ষা করতে হবে। শেষদিকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর পরিচালিত ছবিটি দেখার সুযোগ অবশ্য আমার  এখনও হয়নি। তবে সামনে যে চলচ্চিত্রটি তিনি নির্মাণের পরিকল্পনা এবং হয়তো কাজও শুরু করেছিলেন, মৃত্যু তাঁকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করলো। এই দুঃখ ভুলবার নয়, এই ক্ষতি পূরণ হবার নয় ।

আরও সংবাদ