ভোটার তালিকা নিয়ে অভিযোগ

আপিল নিষ্পত্তি না করেই নির্বাচনের পথে ছাত্রদল!

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০১৯, ০৯:৩৬ এএম আপিল নিষ্পত্তি না করেই নির্বাচনের পথে ছাত্রদল!

দীর্ঘ ২৭ বছর পর দলের অন্যতম সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ‘নির্বাচন’ এর দিনক্ষণ নির্ধারণ করেছে বিএনপি। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর সারাদেশ থেকে আগত কাউন্সিলদের সরাসরি ভোটে এ নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন উপলক্ষে এরইমধ্যে খসড়া ভোটার তালিকাও তৈরি করেছে বিএনপি। কিন্তু ভোটার তালিকায় অসংগতি নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ জমা পড়লেও তা আমলে নিচ্ছে না নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। 

বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ, ভোটার হিসেবে মোট ৫৮০ জনের নামের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে এর মধ্যে নানা অসংগতি রয়েছে। এমন নেতাদের এ তালিকায় স্থান দেয়া হয়েছে, যারা ছাত্রদলের কোনো জেলা বা ইউনিট কমিটির সদস্যই নন। ছাত্রদলের নির্বাচন উপলক্ষে যেসব নিয়ম-কানুন ও শর্ত দেয়া হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে- সংগঠনের মোট ১১৭টি অনুমোদিত ইউনিটের সুপার ফাইভ হিসেবে পরিচিত পদধারী নেতারাই শুধুমাত্র আগামী নির্বাচনে কাউন্সিলর হিসেবে সম্মেলনে অংশ নিতে পারবেন এবং একইসঙ্গে তারাই শুধু ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সংগঠনের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্বাচিত করতে পারবেন। 

ছাত্রদল সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে এ সংগঠনের মোট অনুমোদিত ইউনিট রয়েছে ১১৭টি। এর মধ্যে দেশের প্রতিটি জেলা, মহানগর, ইউনিট রয়েছে। এসব ইউনিটের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সুপার ফাইভ হিসেবে পরিগণিত হবেন এবং তারা নির্বাচন উপলক্ষে সম্মেলনে কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দেবেন। একইসঙ্গে তারাই ১৪ সেপ্টেম্বরে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করবেন।

আন্দোলনে অযোগ্যতা, পদ পাওয়ার পর সরকারের সঙ্গে আঁতাতের কারণে নিষ্ক্রিয়তা, টাকার বিনিময়ে সংগঠনের নয় নিজেদের পকেট কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ছাত্রদলের বিগত কেন্দ্রীয় কমিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপির হাইকমান্ড। গত ৩ জুন বিএনপি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ছাত্রদলের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দেয়। এরপর আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ভোটে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে এ নির্বাচনের জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছিল গত ১৫ জুলাই। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নির্বাচনি তফসিলও ঘোষণা করে। কিন্তু নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণে বিএনপির হাইকমান্ড নির্দিষ্ট বয়সসীমাসহ আরও কিছু শর্ত জুড়ে দিলে বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীরা শুরু করে লাগাতার আন্দোলন ও নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরোধ কর্মসূচি। ফলে ওই নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। এরপর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শেষে আপস-মীমাংসা করে নতুন নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে বিএনপি।

নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের ১১৭টি ইউনিটের সুপার ফাইভ পদধারীদের দিয়ে ভোটারতালিকা করে বিএনপি। কিন্তু এ তালিকা নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে অভিযোগ ও আপত্তি আসে। এসব অভিযোগ ও আপত্তির মধ্যে রয়েছে, কেন্দ্রসৃষ্ট এ তালিকায় এমন নেতাদের নাম রয়েছে যারা আদৌ ছাত্রদলের কোনো পদে নেই। নেই সুপারফাইভ পদেও। এসব নাম বাতিল করে অভিযোগ ও আপত্তিকারীরা ভোটারতালিকা সংশোধনের জন্য আবেদন করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে। 

ভোটার তালিকার অসংগতি নিয়ে অভিযোগ বা আপত্তি পাওয়ার কথা প্রথমে অস্বীকার করে ছাত্রদলের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক দফতর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী। 

দৈনিক জাগরণের কাছে এসব অভিযোগের কপি আছে জানালে পরবর্তীতে তিনি স্বীকার করে বলে, ‘হ্যাঁ দুএকটি অভিযোগ বা আপত্তি এসেছে।’ এসব আপত্তি নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত আপিল কমিটি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত বা মীমাংসার উদ্যোগ নেবে।’ 

ছাত্রদলের নির্বাচনে ভোটারতালিকা নিয়ে অভিযোগ ও আপত্তি জানিয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুল ইসলাম হাফিজ। তিনি বলেন, ২৬ জুন ভোটার তালিকার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নির্বাচন সংক্রান্ত আপিল কমিটির কাছে আমি লিখিত অভিযোগ করেছি। হবিগঞ্জ জেলায় মিজান নামে একজনকে কাউন্সিলর করা হয়েছে যার সঙ্গে ছাত্রদলের কোনো সম্পর্ক নেই। আশা করি আপিল বিভাগ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মিজানকে বাদ দিয়ে আমাকে তালিকাভুক্ত করবে।

হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি এমদাদুল হক ইমরান ও জেলা সাধারণ সম্পাদক রবেল আহমেদ চৌধুরী দৈনিক জাগরণকে বলেন, আমরা এখনও ভোটারতালিকা হাতে পাইনি। তবে শুনেছি সেখানে মিজানুর রহমান মিজানের নাম আছে। ‘মিজান হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক’ স্বীকার করে জেলা ছাত্রদলের এ শীর্ষ দুই নেতা বলেন, মিজানকে আমরা তেমন চিনি না। সে সিলেট শহরে রাজনীতি করত, এখনও করে। তবে কমিটি ঘোষণার সময় তার নাম হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আসার পর আমরা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানকে বিষয়টি জানাই। তারা আমাদের উত্তর দেয়, একবার কমিটিতে নাম আসার পর আর কিছু করার নেই। 

হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, মিজান কোনোদিনই হবিগঞ্জ জেলায় রাজনীতি করেনি। এখানে আমরা তাকে কখনও পাইনি। আমাদের সঙ্গে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুল ইসলাম হাফিজ সবসময় ছিল। ছেলেটি অনেক কষ্ট করেছে। সে ভোটারতালিকার বিষয়ে কেন্দ্রে অভিযোগ ও আপত্তিও দিয়েছে। আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়ে যে চূড়ান্ত তালিকা দেবে, তা হাতে পেলেই আমরা এ বিষয়ে কথা বলতে পারব।  

মিজানের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় বিএনপির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জি কে গউছ দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির রাজনীতি করি দীর্ঘদিন। কোনোদিন মিজান নামে ছাত্রদলের কোনো নেতাকে আমি রাজপথে পাইনি। কেমন করে কোন ইশারায় সে ছাত্রদল নেতা হয়ে গেল, ভাই আমি তা বুঝতে পারি না। আমাদের সঙ্গে হাফিজ ছেলেটি সব আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল। সে জেলও খেটেছে আমার সঙ্গে।’

এদিকে, মেয়াদোত্তীর্ণ টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রদলের সভাপতি রাশেদুল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান খান শফিক গত বছর ছাত্রদল থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। রাশেদ বর্তমানে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শফিক জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদধারী নেতা। সংগঠন থেকে পদত্যাগ করার পরও তাদেরকেই ভোটারতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান খান দৈনিক জাগরণকে বলেন, ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্রদল আমাদের কমিটি অনুমোদন দেয়। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক পদ পাওয়ার কারণে ২০১৭ সালের ২৬ মের দুএকদিন পর আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রদলের পদ থেকে পদত্যাগ করি। এ বিষয়ে রেজুলেশন করে আমরা জেলা বিএনপি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলকে আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে জানিয়েও দিয়েছি।   

রাশেদ-শফিক কমিটির অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বাবু এ বিষয়টি উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের আপিল কমিটির কাছে অভিযোগ ও আপত্তি দায়ের করেছে। 

বাবু দৈনিক জাগরণকে এ বিষয়ে বলেন, ‘ছাত্রদলের সকল পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পদত্যাগ করে দুই বছরেও বেশি সময় ধরে যারা মূল দল বিএনপির রাজনীতি করছে, তাদের নাম কাউন্সিলর হিসেবে আসার বিষয়ে আমি প্রায় ৩ মাস আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ ও আপত্তি দিয়েছি। তৎকালীন ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানকে ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সমাধান আমাদের দেয়া হয়নি।’

অভিযোগ বা আপত্তির বিষয়ে ছাত্রদলের নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রধান বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব (ডাকসুর সাবেক জিএস) খায়রুল কবির খোকন দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এ ধরনের অভিযোগ আমরা পাইনি।’

নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলার আপত্তির কথা খোকনকে জানিয়ে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি পাঁচ মিনিট পর আপনাকে ফোন করে এ বিষয়ে জানাবো।’ কিন্তু এরপর তিনি আর ফোন করেননি। এ প্রতিবেদক বারবার ফোন করলেও তিনি আর রিসিভ করেননি। 

ছাত্রদলের নির্বাচন সংক্রান্ত আপিল কমিটির প্রধান বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান (ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি) শামসুজ্জামান দুদু দৈনিক জাগরণকে এসব অভিযোগ ও আপত্তির বিষয়ে বলেন, হ্যাঁ, এসব বিষয়ে আমরা বেশকিছু আপত্তি ও অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি এখনও ফয়সালা হয়নি। দুএকদিনের মধ্যে আমরা বিষয়টি নিয়ে বসব। তখন আশা করি বিষয়গুলো মীমাংসা হয়ে যাবে।

এক প্রশ্নের জবাবে দুদু আরও বলেন, কোনো নেতা যদি ছাত্রদল থেকে পদত্যাগ করে থাকে এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদল যদি সেই পদত্যাগ গ্রহণ করে থাকে; তবে অবশ্যই তারা ভোটার তালিকায় যুক্ত হতে পারে না। বিষয়টি আমি খোঁজ নেব। বিস্তারিত জেনে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।

প্রসঙ্গত, ছাত্রদলের নির্বাচন উপলক্ষে একশ টাকা মূল্যমানের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে মোট ১০৯টি। এর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য জমা পড়েছে ৭৬টি ফরম। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি) ফজলুল হক মিলনের নেতৃত্বে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই কমিটির নেতৃত্বে ফরম যাচাই-বাছাই চলছে। তা চলবে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত। শুক্রবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত  ২২ জনের মনোনয়ন ফরম বাতিল হয়েছে। 

প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা যাবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হবে ২ সেপ্টেম্বর। প্রার্থীদের প্রচারণা ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত। এছাড়া, ৪ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের খসড়া তালিকা প্রকাশ, তালিকার ওপর আপত্তি ও নিষ্পত্তি ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর এবং চূড়ান্ত তালিকা ৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হবে। তফসিল অনুযায়ী প্রার্থীরা আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত ভোটের প্রচারণা চালাতে পারবেন। প্রার্থীকে অবিবাহিত, ২০০১ সাল থেকে দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি/সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। একইসঙ্গে বর্তমানে ছাত্রত্ব আছে এমন প্রমাণপত্রও মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে দাখিল করতে হয়েছে।

টিএস/ এফসি

আরও সংবাদ