• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২১, ১১:২৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১, ০৬:১৭ এএম

দ্বিতীয় পর্ব

পাঠ উপলব্ধি : আমার দেখা নয়াচীন

পাঠ উপলব্ধি : আমার দেখা নয়াচীন
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

মোহা. শাজাহান আলি ll

বাংলা আমার মাতৃভাষা, মাতৃভাষায় বক্তৃতা করা উচিত

চীনের সীমান্ত ছোট একটা খাল দিয়ে হংকং ও নয়াচীন বিভক্ত ছিল। শান্তি কমিটির স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় সবকিছু দ্রুত শেষ করে ট্রেনে করে বঙ্গবন্ধু নয়াচীনে প্রবেশ করেন। প্রথম শহর ক্যান্টন। বঙ্গবন্ধু এ শহরকে বলেছেন: ‘শহরটি সুন্দর, অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর।’ ট্রেনে মানিক মিয়ার ভাল লেখার ক্ষমতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি ও খাবারের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি এড়ায়নি। কম্যুনিষ্ট দেশের ট্রেনের ক্লাস বর্ণনার পাশাপাশি ট্রেনে ঘুমানোর ব্যবস্থা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, যাত্রা বিরতির জন্য লাউড স্পিকার, খাবারের ব্যবস্থাসহ ট্রেনের একটা সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ট্রেনে বিনা টিকিটে কেউ উঠে না। এটা সম্ভব হয়েছে জনগণের সচেতনতা এবং  রাষ্ট্র কর্তৃক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বলেও বঙ্গবন্ধুর লেখায় ফুটে ওঠেছে।

চীনে প্রবেশের আগে চীনের রাজনৈতিক ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা যেতে পারে। চীনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াৎ সেনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী চিয়াং কাইশেক চীনা জাতীয়তাবাদী দল ও কুওমিঙটাং (কেএমটি) দলের প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। ১৯২৫ সালে ইয়াৎ সেনের মৃত্যু হলে চিয়াং কাইশেক সে পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সান ইয়াৎ-সেনের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে রক্ষণশীল ও রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্রের উপর জোর দেন। অন্যদিকে মার্কস ও এঙ্গেলস মতবাদে প্রভাবিত মাও কম্যুনিষ্ট আদর্শে নয়াচীন গঠন করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি চিয়াং কাইশেকের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে চীনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। চিয়াং কাইশেককে মোকাবিলা করার জন্য চীনের শ্রমিক এবং কৃষকদের নিয়ে রেড আর্মি গঠন, লং-মার্চ (১৯৩৪-১৯৩৫) এবং এরই ধারাবাহিকতায় দুই দশকের গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে নয়াচীন ১ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন নামে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল কারিগর ও অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন মাও। চিয়াং কাইশেক চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে পরাজিত হয়ে তাইওয়ানে পশ্চাদপসরণ করেন। আমার দেখা গণচীন বইয়ে মাওয়ের নয়াচীন আলোচনায় বহুবার ইয়াৎসেন, মাও ও চিয়াং কাইশেকের নাম এসেছে।

দুনিয়ার নামকরা এই শহর। বহু ঝড় গিয়েছে এর ওপর দিয়ে। বহু রাজার রাজধানী ছিল এই শহর। বহু বিদেশি এই শহরটা অনেকবার অধিকার করেছে। শেষবারের মতো জাপানিরা এই শহরটা অধিকার করে-যখন চীন-জাপান যুদ্ধ হয়। তারপর চিয়াং কাইশেকের হাতে ছিল। শেষে, নয়াচীন সরকার মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে এই শহরটা অধিকার করে। আমার দেখা নয়াচীন : শেখ মুজিবুর রহমান

চিয়াং কাইশেক পরবর্তী মাও শাসন আমলে অনেক পরিবর্তন দেখেছে নয়াচীন। চিয়াং কাইশেকের সময় যে সমস্ত অসৎ কর্মচারীরা ট্রেনে কাজ করত তারা অনেকে পালিয়ে গিয়েছিল। যে সমস্ত কর্মচারী সৎ, নিষ্ঠাবান, কর্মঠ বা দেশকে ভালোবেসে ছিল তারা এখনও কাজ করে। চিয়াং কাইশেক আমলের চেয়ে কর্মচারীরা বেতন বেশি পেত। আগের চেয়ে অনেক সুবিধা। নয়াচীন প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়েছিলেন। চারিদিকের সবুজের সমারোহ দেখে বঙ্গবন্ধু ঠিক যেন তাঁর প্রাণের বাংলাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। সন্ধ্যায় ক্যান্টন পৌঁছালে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান শান্তি কমিটির ‘সভ্যবৃন্দ’। ছোট্ট ছেলেমেয়েরা তাঁদের ফুলের তোড়া দিয়ে হাত ধরে নিয়ে যায়। তিনি বাচ্চাদের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। ভাষার সীমাবদ্ধতা থাকায় বঙ্গবন্ধু গায়ে হাত দিয়ে বাচ্চাদের আদর করে দিয়েছিলেন। রাত ৮ টায় তাঁরা হোটেলে পৌছান। রুমে রুমে মালপত্র যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। ক্যান্টনে শান্তি কমিটির পক্ষে ডিনারের আয়োজন ছিল। ডিনারে প্রাদেশিক শান্তি কমিটির সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যান্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। ডিনারের ফাঁকে একজন ছাত্র ক্যান্টন হতে চিয়াং কাইশেক-এর পশ্চাদপসরণ এবং নয়াচীন সেনাবাহিনী কিভাবে মানুষের মন জয় করেছিল তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ করেন। ক্যান্টনে কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি লোকদের কি অবস্থা, কোন অসুবিধা আছে কিনা তার খবর নিত। তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিল নয়াচীন সরকার জনগণের সরকার। তারা জনগণকে সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পরের দিন প্লেনে পিকিং গমন করেন। তাই রাতে হোটেলে ফিরে আসেন দ্রুত। 

নয়াচীনে প্রবেশ, সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও সম্মেলনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা
পিকিং বর্তমানে বেইজিং নামে সর্বাধিক পরিচিত। বঙ্গবন্ধু এ শহর নিয়ে বর্ণনা করেছেন- ‘দুনিয়ার নামকরা এই শহর। বহু ঝড় গিয়েছে এর ওপর দিয়ে। বহু রাজার রাজধানী ছিল এই শহর। বহু বিদেশি এই শহরটা অনেকবার অধিকার করেছে। শেষবারের মতো জাপানিরা এই শহরটা অধিকার করে-যখন চীন-জাপান যুদ্ধ হয়। তারপর চিয়াং কাইশেকের হাতে ছিল। শেষে, নয়াচীন সরকার মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে এই শহরটা অধিকার করে।’ বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য করেন- কোরীয় যুদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটের মধ্যেই শান্তি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। রাজধানী বেইজিং এ অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, গুয়েতামালা, কলম্বিয়া, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া সহ ৩৭ টি দেশের পর্যবেক্ষক, ২৫ টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং ৩৬৭ জন ‘ডেলিগেট’ অংশগ্রহণ করে (আমার দেখা নয়াচীন: পৃষ্ঠা ৩৯)।

চীন শান্তি কমিটি নিজেদের ইচ্ছামতো প্রস্তাব পাশ করাতে চেষ্ট করেনি। বরং প্রত্যেকটি প্রস্তাবের প্রেক্ষিতের আলোচনা ও যুক্তিসহ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। আমার দেখা নয়াচীন : শেখ মুজিবুর রহমান

সম্মেলনে চীনের  অবিসংবাদিত নেতা সান ইয়াৎ সেনের সহধর্মিনী ও শান্তি সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ‘ম্যাডাম-সেন’ সম্মেলনে সবাইকে অভ্যর্থনা জানান। ম্যাডাম সান ইয়াৎ সেনের বক্তৃতার পর চীন শান্তি কমিটির সভাপতি কমরেড কোঃ মোঃ জোঃ বক্তৃতা করেন। চীনা ভাষায় বক্তৃতা করলেও ইংরেজিতে শোনার জন্য ‘কানফোন’ ছিল। বঙ্গবন্ধু বক্তব্যের সারাংশ হিসেবে উল্লেখ করেন, ‘চীন যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। সাম্রাজ্যবাদীরা য্দ্ধু করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোরিয়া, ইন্দোচীন, মালয়, জাপান সকল জায়গায় জাতীয় আন্দোলনকে দমন করার জন্য সৈন্যবাহিনী দিয়ে  যা-তা অত্যাচার করছে।’ য্দ্ধু সম্পর্কে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল: ‘যুদ্ধ চাই না, তবে যদি কেহ যুদ্ধ করতে আসে তবে যুদ্ধের সাধ আমরা মিটিইয়া দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।’

উল্লেখ্য যে, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকের বেশি ডেলিগেট কম্যুনিষ্ট নীতিবোধে বিশ্বাসী ছিলেন না। প্রতিনিধিরা সাব কমিতে বিভক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন। চারটা সাব কমিটি প্রস্তাব লেখার কাজ করে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চীন শান্তি কমিটি নিজেদের ইচ্ছামতো প্রস্তাব পাশ করাতে চেষ্ট করেনি। বরং প্রত্যেকটি প্রস্তাবের প্রেক্ষিতের আলোচনা ও যুক্তিসহ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।’ কাশ্মীর প্রশ্নে প্রথমে ভারতীয় ডেলিগেটদের অনাগ্রহ থাকলেও অন্যান্য দেশের চাপে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। প্রস্তাবটির সারমর্ম ছিল, ‘কাশ্মীরে গণভোটের দ্বারা ঠিক হবে তারা কোন দেশে যোগদান করবে।’ এ ধরনের প্রত্যেকটি প্রস্তাব আলোচনা ও ডিবেটের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের শোষন নিয়েও সভায় আলোচনা হয়। প্রত্যেকটি আলোচনা ও ডিবেট প্রাণবন্ত ছিল কারণ সেখানে বিভিন্ন ব্লকের বা আদর্শের প্রতিনিধি যেমন কম্যুনিষ্ঠ, কংগ্রেস, মুসলিমলীগ, সোসালিস্ট, ডেমোক্রাট বা ইমপ্যারিয়ালিষ্ঠরা উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলনে যারা বক্তব্য রেখেছিলেন তারা তাদের দেশের কথা, শান্তির কথা এবং সাম্রাজ্যেবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমত সভায় কবিতা শোনান এবং তাঁর বক্তব্যে তুরস্কের মানুষের বঞ্চনার কথা  শোনান। ইরানের প্রতিনিধি বলেন, ‘তাদের দেশের সকল সম্পদ এক হাজার ফ্যামিলির হাতে কুক্ষিগত।’ ইন্দোনেশিয়া, ব্রহ্মদেশ, সিংহল, থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার দেশসমূহ, কানাডা, জাপান তারা প্রত্যেকে শান্তির কথা বলেন এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে থিয়েটার বা নাচ হতো। ভারতীতের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ভাল ছিল, উপহার সামগ্রী নিয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের কোন প্রস্তুতি ছিল না। তা সত্তে¡ও দেশের সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রতিনিধি প্রধান পীর মানকি শরীফের সাথে পরামর্শ করে পাকিস্তানের কিছু পতাকা বানিয়েছিলেন উপহার দেওয়ার জন্য।

বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করা উচিত। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভাষার মধ্যে অন্যতম ভাষা বাংলা।’ আমার দেখা নয়াচীন : শেখ মুজিবুর রহমান

পাকিস্তানের প্রতিনিধি পীর মানকী শরীফ, আতাউর রহমান, সরদার শওকত হায়াত, খান গোলাম আহম্মদ খান লুন্দোখোর সহ বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। অন্যরা ইংরেজি বক্তৃতা করলেও বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা করেন। এটা নিয়ে বঙ্গবন্ধু গর্ববোধ করেন। তিনি মনে করেন, ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করা উচিত।’ তিনি মনে করেন, ‘দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভাষার মধ্যে অন্যতম ভাষা বাংলা।’ চীনাদের তাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেম দেখে বঙ্গবন্ধু অভিভুত হয়েছিলেন। নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে গেলে সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর ইংরেজী জানা সত্ত্বেও চীনা ভাষায় তাদের অভ্যর্থনা করেছিলেন। ‘ম্যাডাম ইয়াৎ-সেন’ খুব ভালো ইংরেজি জানা সত্ত্বেও তিনি বক্তৃতা করেছিলেন চীনা ভাষায়। 

সম্মেলনের ফাঁকে অনেকের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপ হয়েছিল। অষ্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ও কর্মচারীদের বিলাসিতা নিয়ে ভৎসনা করেছিলেন। যে দেশের মানুষ এভাবে অভাব অনটন ও দুর্গতির মধ্যে রয়েছে সে দেশের রাষ্ট্রদূতের এ ধরনের বিলাসিতা বড় বেমানান বলে বঙ্গবন্ধুও মনে করতেন। দক্ষিণ আমেরিকার একজন ডেলিগেট বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন পাকিস্তান কোথায়। পাকিস্তানের যথাযথ ব্যান্ডিং তখন বহির্বিশ্ব হয়নি বা সীমিত ছিল বলে বিশ্বের অনেক লোক জানত না। তখন পর্যন্ত অনেকে পাকিস্তানকে-ইন্ডিয়া হিসেবে জানতো। শান্তি সম্মেলনের মতো প্লাটফর্মকে বঙ্গবন্ধু আদর্শ হিসেবে মনে করেছিলেন, আর এর মাধ্যমেই পাকিস্তানকে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা নতুনভাবে জানতে পারবেন বলে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল।

কনফারেন্সের ফাকে চীন দেখা
কনফারেন্সের ফাঁকে বঙ্গবন্ধু চীনের বিখ্যাত স্থান, বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি স্কুল, ধর্মীয় উপাসনালয়, শ্রমিকের অবস্থা, কৃষি ব্যবস্থা দেখতে বেরিয়ে যেতেন। চিনের ‘লিবারেশন ডে’ উপলক্ষে কুচকাওয়াজ দেখতে গিয়ে বন্ধু মাহবুবের সাথে দেখা হয়। বন্ধু মাহবুব ও তার স্ত্রীর আন্তরিকতা ও ব্যবহারে বঙ্গবন্ধু বিমোহিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রদূতের বাসায় পাকিস্তান ডেলিগেটদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। রাষ্ট্রদূত মেজর রেজা ও তার স্ত্রীর ব্যবহার ছিল ‘অমায়িক’। তাদের আতিথেয়তায় আড়ম্বরতা ছিল না। তার আপ্যায়ন ও আতিথেয়তা বঙ্গবন্ধুর ভালো লেগেছিল। বঙ্গবন্ধু রিকসায় ঘুরে ঘুরে নয়াচীন দেখতে পছন্দ করতেন। হোটেল থেকে একদিন রিকসা নিয়েছিলেন। দোভাষীর সহযোগিতায় ভাড়া আমাদের দেশের টাকায় আট আনা নির্ধারিত হয় (সেই সময়ের মুদ্রা যা চীনা টাকায় দুই হাজার ইয়ান)। যাবার সময় দোভাষী ছিল না। কিভাবে ঘরে ফিরবেন বুঝতে পারছিলেন না। রাস্তায় একটা রিকসা পাওয়া যায়। হোটেলের নাম বলায় রিকসা চালক বুঝতে পেরেছিল। মাথা নেড়ে যাবার সম্মতি দেওয়ায় বঙ্গবন্ধু রিকসায় উঠে পড়েন। হোটেলে রিকসা পৌঁছুলে বঙ্গবন্ধু পকেটে হাত দিয়ে প্রায় ১০ টাকা পরিমান হাতে করে রিকসা চালকের সামনে ধরেন। রিকসা চালক ‘ঠিক আট আনা পয়সা গুনে নিয়ে চলে’ যায় (নয়াচীন পৃষ্ঠা ৪৮)। দোভাষীর মাধ্যমে জানতে পারেন চীনাদের এ ধরনের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও দেশপ্রেমের কারণ হলো তাদের ‘ট্রেড ইউনিয়ন’। এরা যা উপার্জন করে যতটুকু সম্ভব ইউনিয়নে জমা দেয়। সেই টাকা দিয়ে ওদের জন্য থাকার বাড়ি, রিকসা মেরামত, চিকিৎসা বন্দোবস্ত ও অন্যান্য কাজ করে দেওয়া হয়। পূর্বে তারা তাদের উপার্জনের বেশির ভাগ টাকা তাদের মহাজনদের দিয়ে দিত। মহাজনদের থেকে রিকসা ভাড়া নিত। মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না। ট্রেড ইউনিয়নের ফলে রিকসা চালকের ন্যায্য হিস্যার ব্যবস্থা হয়েছিল। অন্যদিকে মহাজনরাও তাদের ভাড়া পাচ্ছে।

এটি শুধু গল্প নয় বরং চীনের বর্তমান অবস্থান, জাতীয় আত্মত্যাগ ও দেশ গড়ার প্রতিজ্ঞার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তখন পর্যন্ত চীনে ব্লেড উৎপাদন হয়নি তাই চীনারা ক্ষুর দিয়ে শেভ করে। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে পর্যন্ত তারা ব্লেড ফ্যাক্টরী না করতে পারবে, সে পর্যন্ত ব্লেড কেউই ব্যবহার করবে না। আমার দেখা নয়াচীন : শেখ মুজিবুর রহমান

একদিন বঙ্গবন্ধু রিকসা চালকদের জন্য সরকারের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন। ছোট দুই কামরা বিশিষ্ট ঘর। স্কুল আছে। বেশ ভালোই ছিল তারা। একদিন মুসলিমপাড়া দেখতে যান। সেখানের মুসলমানরা জানায় ধর্ম চর্চায় কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তারা নামাজ পড়ে, কুরআন পড়ে। কম্যুনিষ্ট দেশে মুসলমানদের ধর্ম চর্চায় কোন অসুবিধা নেই। যদিও বাইরে এ ধরনের বিভিন্ন কথাবার্তা ছিল যার জন্য বঙ্গবন্ধু পরে একা বের হয়ে এর প্রকৃত অবস্থা বুঝার চেষ্টা করেছিলেন। চীনের জিনিসপত্রের দাম ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই ছিল। তবে বাংলাদেশের (সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান) তুলনায় কম বলেই বঙ্গবন্ধুর কাছে মনে হয়েছে। সূতার কাজ করা একটি চাদর ১৫ টাকায় বঙ্গবন্ধু কিনেছিলেন। তৎকালীন সময়ে এটির মূল্য আমাদের দেশে ২৫ টাকা হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। প্রতিটি দ্রব্যের দাম লেখা থাকত। পাশাপাশি সরকারি স্টোর ছিল। সেখানে প্রায় সব ধরনের জিনিস পাওয়া যেত। বাজারে সব পণ্য চীনাদের নিজস্ব তৈরি। বঙ্গবন্ধু যতগুলো শহর ভ্রমণ করেছেন তার প্রত্যেকটির বাজারে তিনি লক্ষ্য করেছেন সেখানে কোন বিদেশি পণ্য ছিল না। বঙ্গবন্ধুর শেভ করার ব্লেড শেষ হয়ে গেলে বাজারে ব্লেড পাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনা বলে ভাবলে হবে না। এটি শুধু গল্প নয় বরং চীনের বর্তমান অবস্থান, জাতীয় আত্মত্যাগ ও দেশ গড়ার প্রতিজ্ঞার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তখন পর্যন্ত চীনে ব্লেড উৎপাদন হয়নি তাই চীনারা ক্ষুর দিয়ে শেভ করে। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে পর্যন্ত তারা ব্লেড ফ্যাক্টরী না করতে পারবে, সে পর্যন্ত ব্লেড কেউই ব্যবহার করবে না।

মাও সেতুং এর সাথে রাতের খাবার
চীন সরকারের পক্ষ থেকে মাও সেতুং এর সাথে খাবারের দাওয়াতে এলো। নৈশভোজে মাও সেতুং সহ চৌ এন লাই, চ্যুতে, জিং এবং অন্যান্য বড় বড় নেতা  উপস্থিত ছিলেন। এ ধরনের নেতার সাথে দেখা করার দুর্লভ মুহুর্তগুলির কথা বঙ্গবন্ধু ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ লিপিবদ্ধ করেছেন (পৃষ্ঠা ৫২)। ৩৭টি দেশের সকল প্রতিনিধিদের নিয়ে নৈশভোজে সবাই পৃথক পৃথকভাবে খাবার গ্রহণ করেছিলেন। ভারত ও পাকিস্থানের জন্য পৃথক টেবিল ছিল। টেবিলে সিং কিয়াং প্রদেশের গভর্ণর বোরহান শহীদ ছিলেন। দাওয়াতে বড় বড় মসজিদের ইমামরা উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন, তারা এ ধরনের সরকারি বড় ভোজে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। তাদের সাথে বঙ্গবন্ধু পরিচিত হলেন এবং কুশল বিনিময় করলেন। খাবার শেষে চ্যুতে অতিথিদের টেবিলের কাছে ঘুরতে আসেন। এ সময় চ্যুতের হাতে থাকা গ্লাসের সাথে বঙ্গবন্ধু তার কমলালেবুর রসের গ্লাসের ধাক্কা লাগিয়ে খেয়ে নিলেন। এর অর্থ চীন দেশের সাথে নিজ দেশের বন্ধুত্ব কামনা। চলবে...

লেখক • জ্যেষ্ঠ সহ সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।

আরও পড়ুন