• ঢাকা
  • শনিবার, ১১ মে, ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০১৯, ১২:০০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০১:২০ এএম

বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার স্মৃতিমাখা দিন আজ

বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার স্মৃতিমাখা দিন আজ

৮ এপ্রিল ১৯৯৭। আইসিসি ট্রফির প্রথম সেমিফাইনালের প্রথম দিন।  সেই ম্যাচে মুখোমুখি বাংলাদেশ আর স্কটল্যান্ড। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বৃষ্টির কারণে সেমিফাইনাল ম্যাচের পরদিন ৯ এপ্রিল রিজার্ভ ডে রাখা হয়েছিল। বৃষ্টির বাগড়ায় মাঠে খেলা গড়িয়েছিল দুইদিন। সমীকরণ ছিল এমন যে জিতলেই বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্র পাবে বাংলাদেশ, আর চলে যাবে ফাইনালে।

বৃষ্টির কারণে খেলা দেরিতে শুরু হয় আর ঠিক হয় ম্যাচের প্রথম দিন বাংলাদেশ ৫০ ওভার ব্যাট করবে আর স্কটল্যান্ড করবে পরের দিন (যেহেতু স্কটল্যান্ড টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিল)। ১২ রানেই ওপেনার আতাহার আলী খান (বর্তমানে ধারাভাষ্যকার) আউট হলে দল একটু হোঁচট খায়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতে নামে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলট।

বাংলাদেশের দলীয় ৫১ রানে নাঈমুর রহমান দুর্জয় ব্যক্তিগত ২৬ রান করে রান আউট হলে আমিনুল ইসলাম বুলবুল ব্যাট করতে নামেন। পাইলটের সাথে দুর্দান্ত এবং সময় উপযোগী ১১৫ রানের পার্টনারশিপ গড়েন বুলবুল। দলীয় ১৬৬ রানের মাথায় বুলবুল আউট হন ৫৭ রান করে এবং ১৬৮ রানের মাথায় পাইলট আউট হন সর্বাধিক ৭০ রান করে, যা দলের জয়ে বিশাল ভূমিকা রাখে।

এক পর্যায়ে অধিনায়ক আকরাম খান (বর্তমানে বিসিবি পরিচালক) মাত্র ৪ রান করে আউট হলে দলের স্কোর দাঁড়ায় ১৭২/৫। তখন বড় স্কোর গড়ার ক্ষেত্রে দল একটু বিপদেই পড়ে যায়। কিন্তু মিনহাজুল আবেদিন নান্নু (বর্তমানে প্রধান নির্বাচক) টেল এল্ডার ব্যাটসম্যান ও পেসার সাইফুল ইসলামকে নিয়ে গড়েন ৩৯ রানের মাঝারি তবে, মহামূল্যবান জুটি।

সাইফুল ইসলাম ১৬ রানে আউট হলে ক্রিজে আসেন  হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান মো. রফিক। ক্রিজে এসেই তিনি মাত্র ৭ বলে ১ চার ও ১ ছক্কার কল্যাণে আউট হওয়ার আগে ১৬ রানের ক্ষুদ্র ঝড় তোলেন, যা দলকে ২৩০ রানের গণ্ডি পার করাতে ভূমিকা রাখে। রফিক আউট হলেও নান্নু কিন্তু দারুণ ফিনিশিং দিয়েছিলেন। ৪১ বলে ৩৯ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে নান্নু এক প্রান্ত আগলে রাখায় ৫০ ওভার শেষে দলের রান দাঁড়ায় ৭ উইকেটে  ২৪৩। এই রানটাই তখন জয়ের জন্য দলের বোলিং সামর্থ্য আর বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচের পিচ কন্ডিশনের জন্য অনেক ভালো সংগ্রহ ছিল। দেশবাসী এক বুক আশা নিয়ে ৮এপ্রিলের রজনী পার করে দেয় বিশ্বকাপে যাওয়ার আশা নিয়ে।

ম্যাচ সেরার পুরস্কার বুঝে নিচ্ছেন খালেদ মাসুদ - ছবি : ইন্টারনেট

পরদিন ৯ এপ্রিল সকাল থেকে দারুণ আবহাওয়া ছিল কিলাত ক্লাব মাঠ ও তার আশেপাশের এলাকায়। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় (বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৭টা) খেলা শুরু হয়। তখন বাংলাদেশের ১১ কোটি মানুষের হৃদয় পড়ে ছিল মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠে।

স্কটল্যান্ডের ৩১ রানের উদ্বোধনী জুটি কিছুটা দুশ্চিন্তা এনে দিলেও শান্তর করা রান আউটে স্বস্তি ফিরে আসে।  দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে স্কটল্যান্ড আবারও প্রতিরোধ গড়ে তুলছে এমন অবস্থা। আবারো ৩১ রানের জুটি। দলীয় ৬২ রানে ফিলিপকে দুর্জয়ের বলে পাইলট স্ট্যাম্পিং করলে ভাঙে এই জুটি। 

এ সব ঘটনা দেশবাসী জানতে পারছিল চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত আর শামীম আশরাফ চৌধুরীর কণ্ঠে।বাংলাদেশ বেতারে সবাই কান পেতে ছিল। কারণ টিভিতে খেলা দেখা থেকে তখনও দেশবাসী ছিল বঞ্চিত ।

প্রতিপক্ষের দলীয় ৭৩ রান ও ৮০ রানের মাথায় যথাক্রমে তৃতীয় এবং চতুর্থ উইকেট পড়ে গেলে বাংলাদেশ খেলার লাগাম নিতে থাকে ভালোভাবেই। ১১১ রানে পঞ্চম আর ১২৩ রানে ষষ্ঠ উইকেটের পতন হলে বিজয় শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তখন নতুন ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশ। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায় বিজয় উল্লাস যেন আছড়ে পড়েছিল। কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সবাই বেতারের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। সেই শ্বাসরুদ্ধকর বিজয়ের ইতিহাস আজকের প্রজন্মের জানা খুবই জরুরি। কারণ এ খেলার মধ্য দিয়ে ক্রিকেট জনপ্রিয়তা যেমন স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নেয় মানুষের অন্তরে। ক্রিকেট নিয়ে  জনগণ এক কাতারে দাঁড়ানোর ঘটনা ওই প্রথম।

১৫৪ রানে সপ্তম আর ১৬২ রানে অষ্টম উইকেট পড়ে গেলে জয়ের আগেই উল্লাসের জোয়ারে ভেসে যায়  দেশ। আর মাত্র কিছু মুহূর্ত বাকি। বিশ্ব ক্রিকেট মানচিত্রে নতুন এক নাম প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। গর্ব করার মতো একটা কিছু জাতি পেতে চলেছে। ক্ষুধা, দরিদ্রতা, রাজনৈতিক হানাহানি, বন্যার মতো নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হওয়া বাংলাদেশ বিশ্বে ক্রিকেট নিয়ে গর্ব করবে এমন ভাবনার দোলাচলে বেতারের শব্দে প্রকম্পিত হয়েছিল সারাদেশ।

ম্যাচ জয়ের পর বাংলাদেশ দলের জয়োল্লাস - ছবি : ইন্টারনেট 

এর মাঝেই ১৬৯ রানে নবম উইকেট পড়ে গেলে বিজয় থেকে আর মাত্র এক পা দেয়া বাকি। ১১ কোটি মানুষের হৃদকম্পন আজও অনুভব করতে পারেন সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকা জনগণ। শেষ ব্যাটসম্যান মাঠে নামল। খেলা এগিয়ে চলল। ৪৫তম ওভারে বল করছিলেন রফিক। ওভারের পঞ্চম বলে ব্যাটসম্যান শেরিডানের করা শট আমিনুল ইসলাম বুলবুল ক্যাচ ধরার সাথে সাথে চৌধুরী জাফরুল্লাহ শরাফাতের এবং বিশ্বকাপ বলে চিৎকার দিয়ে বলে চলেছেন- ইতিহাস ঘটে গেছে!  প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার টিকেট পেয়ে গেছে বাংলাদেশ!

গোটা বাংলাদেশ তখন উৎসবের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা মাঠে খেলা দেখতে এসে মাঠটাকে এক টুকরো বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলেছিল! ১১ জন খেলোয়াড় ১১ কোটি মানুষের নয়নের মণি হয়ে গেলেন সেই মুহূর্ত থেকে। পতাকা নিয়ে মিছিলে দেশ ভরে যায়। গোটা ম্যাচে ব্যাটিং এর পর বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিল টাইগাররা।

দলের পক্ষে মো. রফিক ২৫ রান দিয়ে ৪টি ও এনামুল হক মণি ৩১ রান দিয়ে ৩টি উইকেট তুলে নিয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তবে ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ৭০ রানের কার্যকরী ইনিংস ও ২টি স্ট্যাম্পিং করার সুবাদে খালেদ মাসুদ পাইলট ম্যাচ সেরার পুরস্কার পান।

২১ বছর আগের আজকের এই দিনের তাৎপর্য আজকের বড় দল হয়ে উঠতে থাকা বাংলাদেশের এখনকার প্রজন্মের সমর্থকরা কতটা উপলব্ধি করেন তা বলা মুশকিল। স্মৃতির গহ্বরে কত বিশেষ দিনই তো আমরা ভুলে যাই। এক আইপিএল শুরু হয়েছে এই নিয়ে কত মাতামাতি! সাকিবের জন্য হোক, আপত্তি নাই। কিন্তু এই দিনটি ভুলে যাওয়া মানে নিজেদের ক্রিকেটকে বিশ্বের বুকে নিজেদের প্রমাণ করার দিনকে ভুলে যাওয়া, এটাই অপ্রিয় সত্য।

আমরা ভবিষ্যতে হয়তো বিশ্বকাপসহ বড় অনেক টুর্নামেন্টে বহুবার চ্যাম্পিয়ন হবো। কিন্তু আজকের এই দিনটি ভুলে যাওয়া আমাদের জন্য বড়ই অন্যায়ের। তাই আসুন আমরা আজকের দিনে স্মরণ করি। স্মরণ করি সেই সময়ের খেলোয়াড়, কোচ, ম্যানেজার, ফিজিও, বোর্ড কর্মকর্তা, নির্বাচক সবাইকে।

নেপথ্যে আরও অনেকে ছিলেন হয়তো যাদেরকে কেউ মনে রাখে নাই। সাংবাদিকদের ভূমিকা তো ছিল অবিশ্বাস্য! ক্রীড়া সাংবাদিকতা আমাদের দেশে প্রসার লাভ করেছিলই মূলত এই অর্জনের ফলে। আর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশবাসীকে আবারও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে পেরেছিল বেতার মাধ্যম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পর বাংলাদেশ বেতারই ছিল একমাত্র খেলার বিস্তারিত জানার মাধ্যম আর কোটি মানুষের বার্তা বাহক।

খেলার বিরতি আর বৃষ্টির সময়ে খেলা বন্ধ থাকার সময়ে দেশাত্মবোধক গান আমাদের মনে বিশ্বাস তৈরি করতো আমরা জিতবোই। আর পাশাপাশি বাংলা ছায়াছবির হিট করা গান শুনে বিনোদন পাওয়ার দিনগুলার কোনো তুলনা হয় না। কি মধুমাখা ছিল সেই দিনগুলি।

আরআইএস/ডিজি