• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০১৯, ০৫:৩৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৮, ২০১৯, ০৬:০৩ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (পাঁচ)

গ্রিন সিগন্যালের পর তৈরি হয় ব্লুপ্রিন্ট

গ্রিন সিগন্যালের পর তৈরি হয় ব্লুপ্রিন্ট

পাক-মার্কিন সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে বঙ্গবন্ধু যখন ভীষণ বেদনার্ত, কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ হারানোর বেদনায় মুহ্যমান, একের পর এক বিপর্যয়ে তাঁর হৃদয় যখন ক্ষতবিক্ষত, তখন পাক-মার্কিন চক্র এবং তাদের দেশীয় অনুচররা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭৪ সালের মাঝমাঝি সময়ে সিআইএর স্টেশন চিফ হিসেবে ফিলিপ চেরিকে ঢাকায় দায়িত্ব দেয়া হয়। এটা ছিল ফিলিপ চেরির দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্ট। এর আগে একাত্তরে আমাদের মু্ক্তিসংগ্রামকে ব্যর্থ করতে মার্কিনরা যখন দিল্লি ও কোলকাতায় সিআইএর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছিল, তখন এই ফিলিপ চেরিকে দিল্লিতে নিয়োগ করা হয়েছিল। ওই অ্যাসাইনমেন্টে চেরি ব্যর্থ হয়েছিল। প্রধানত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কঠোর নজরদারির কারণে তখন সিআইএ তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। চেরির এই ব্যর্থতা পাক-মার্কিন গোয়েন্দাদের বেপরোয়া করে তুলেছিল।

চুয়াত্তরের মাঝামাঝি পৃথক সফরে ভুট্টো ও কিসিঞ্জার বাংলাদেশে আসেন। ভুট্টো আসেন ২৭ জুন আর কিসিঞ্জার ৩০ অক্টোবর। ওই সময় তারা দুজন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের এদেশীয় এজেন্টদের বঙ্গবন্ধুকে হত্যার গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে যান। এর আগে ওই বছরের আগস্ট মাসে অর্থাৎ কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের দুই মাস আগে ফিলিপ চেরিকে সিআইএর প্রধান হিসেবে বাংলাদেশে নিয়োগ করা হয়। কোলকাতায় যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় চেরিকে ঢাকায় নিয়োগ করা হয়। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল ভুট্টো-কিসিঞ্জারের জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে তারা কোনো দিনই সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাই তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাংশে নিশ্চিহ্ন করার জন্য চক্রান্তে লিপ্ত হন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো, কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে জনমনে হতাশা সৃষ্টি, একের পর এক নির্বাচিত প্রতিনিধি হত্যা, ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও ভারতবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোলকাতায় যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই ষড়যন্ত্রের হেডকোয়ার্টার সরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। তবে কুশীলব অপরিবর্তিত। রিং মাস্টার আগের মতোই সেই হেনরি কিসিঞ্জার, আর সহযোগী সেই জুলফিকার আলী ভুট্টো, ফিলিপ চেরি, হ্যারল্ড স্যান্ডার্স, হাবর্টি গর্ডন, জর্জ গ্রিফিন, ডেভিড ইউজিন বোস্টার, খন্দকার মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, জেনারেল জিয়া, মেজর ডালিম, ফারুক ও রশিদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান প্রমুখ।

নিউইয়র্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও হেনরি কিসিঞ্জার   - ফাইল ছবি

বাংলাদেশে ফিলিপ চেরিকে নিয়োগের পর সিআইএ আরো বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। আর ঢাকায় কিসিঞ্জারের সফরের সময় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে সিআইএ নেটওয়ার্ক  দ্রুততার সঙ্গে পুরনো এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। এই যোগাযোগের কাজটি সংগঠিত করতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কেননা খন্দকার মোশতাক ও মাহবুবুল আলম চাষী বাংলাদেশে তাদের পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত বন্ধু। আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খন্দকার মোশতাক যখন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন মাহবুবুল আলম ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব। তখনো তারা সিআইএর অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর ছিলেন। সিআইএর সঙ্গে তাদের যোগসাজশ প্রকাশ হওয়ার পর যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাদের অপসারিত করেছিলেন। এই দুই মানিকজোড় রহস্যজনকভাবে যেমন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তেমনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গন্ধুর সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান করে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকারে থাকা সত্ত্বেও এরা বরাবরই ভেতরে ভেতরে পাক-মার্কিন এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেদের তৎপর রেখেছিল।

এই দুই চক্রান্তকারীর সেই সময়ের অবস্থানগত সমীকরণটা একটু দেখুন, একাত্তরের এপ্রিলে খন্দকার মোশতাক ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর মাহবুবুল আলম চাষী ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোশতাক বাণিজ্যমন্ত্রী, চাষী তাঁর পরামর্শদাতা এবং তাদের প্রিয়পাত্র ও বশংবদ তাহের উদ্দিন ঠাকুর তথ্য প্রতিমন্ত্রী। ’৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর মোশতাক প্রেসিডেন্ট, চাষী তাঁর মুখ্য সচিব। আর মুক্তিযুদ্ধকালীন সিআইএর কর্মকর্তা কোলকাতার সেই ফিলিপ চেরি তখন বাংলাদেশে সিআইয়ের স্টেশন চিফ।

ভুট্টো-কিসিঞ্জারের গ্রিন সিগন্যালের পর ফিলিপ চেরি পূর্বপরিচয়ের সূত্রে মোশতাক ও চাষীকে কাজে লাগায়। ব্লুপ্রিন্ট মোতাবেক মাহবুবুল আলম চাষী অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। জেনারেল জিয়া প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার পর তারা মেজর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। খন্দকার মোশতাকের ভাগিনা মেজর রশিদ সহজেই রাজি হয়। বলা বাহুল্য, মেজর রশিদের ভায়রা হলো মেজর ফারুক। এই মেজর ফারুকের প্রথম পছন্দ ছিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। মেজর ফারুক ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সাক্ষাৎকালে জেনারেল জিয়া জুনিয়র অফিসারদের এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

হেনরি কিসিঞ্জার

মুক্তিযুদ্ধের সময় কিসিঞ্জারের বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন হ্যারল স্যান্ডার্স। স্যান্ডার্স তখন মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডেপুটি ছিলেন। হেনরি কিসিঞ্জার স্টেট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করলে হ্যারল্ড স্যান্ডার্সকেও স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যুক্ত করেন। কিসিঞ্জার তাকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এই স্যান্ডার্স কোলকাতায় মোশতাক গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে স্যান্ডার্সের এই যোগাযোগের বিষয়টি কোলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল হাবর্টি গর্ডন এবং নয়াদিল্লিতে অবস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিংকের কাছে গোপন রাখা হয়। যদিও কোলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল হাবর্টি গর্ডন মুক্তিযুদ্ধ চলকালে মার্কিন ছক বাস্তবায়নে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। কোলকাতা কনসুলের জর্জ গ্রিফিনকেও মোশতাক গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়। গ্রিফিন ছিলেন স্যান্ডার্সের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাই পঁচাত্তরে স্যান্ডার্স তাকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগে প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন।

কিসিঞ্জার চক্র ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়। পেন্টাগন, কোলকাতা ও বাংলাদেশে স্যান্ডার্স, গ্রিফিন, ফিলিপ চেরির অবস্থান তখন সুদৃঢ়। সিআইএর নেটওয়ার্ক তখন পুরোদমে সক্রিয়। চুয়াত্তরের নভেম্বরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার লক্ষ্যে নতুন করে গঠন করা হয় প্ল্যানিং সেল। তৈরি করা হয় ব্লুপ্রিন্ট। সেই অনুযায়ী এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমানকে। সক্রিয় করা হয় ফারুক আর রশিদকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিষয়ে ‘দি কারেঞ্জি পেপারসে’ অনেক তথ্য রয়েছে। এতে কোলকাতায় আঁতাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার কোলকাতায় আওয়ামী লীগের একাংশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু এরা এফেক্টিভ ছিল না। স্টেট ডিপার্টমেন্টের সোর্স থেকে আরো বলা হয়, কোলকাতায় কমপক্ষে ৮টি কন্টাক্ট সোর্স নিয়োজিত ছিল। বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই ৮টি কন্টাক্ট সোর্সের সঙ্গেই খন্দকার মোশতাক আহমেদের যোগাযোগ ছিল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পশ্চিমা গণমাধ্যম অত্যন্ত কৌশলে এই হত্যাকাণ্ডকে কতিপয় সেনা অফিসারের কারসাজি হিসেবে প্রমাণ করার অপপ্রয়াস চালায়। পরবর্তী সময়ে স্বীকৃত খুনিচক্র বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে সকল গালগল্প ও ব্যক্তি আক্রোশের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে অস্বীকার করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক এবং মতাদর্শিক কারণে তরুণ অফিসাররা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে।’ এই আদর্শিক ও রাজনৈতিক পার্থক্যসমূহ আসলে কী? ১৯৭৯ সালের ৪ আগস্ট ‘এইট ডেইস’ পত্রিকায় ‘দ্য ম্যান হু কিল্ড মুজিব’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মেজর রশিদ বলেন, ‘তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করা।’ অপর এক প্রতিক্রিয়ায় খুনি রশিদ বলেছে, তাদের হত্যা পরিকল্পনা ছিল রাজনৈতিক।

এ কথা আজ সবার কাছেই স্পষ্ট, এই হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিবর্তে পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত করা। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ধারার বিপরীতে সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল ও পুঁজিবাদী ধারায় ধাবিত করা। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফল হয়েছিল বৈকি! কেননা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এই পথে হেঁটেছে!

সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত মেজর ফারুক ও রশিদ যতই বলুক না কেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজেদের, এ কথা মোটেই ঠিক নয়। খুব বেশি হলে তাদের মূল চক্রান্তকারীদের অন্ধভৃত্য বলে উল্লেখ করা যায়, এর বেশি কিছু নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার সিদ্ধান্ত ও এর নীলনকশা তৈরি হয়েছে অন্যত্র। মেজর ফারুক ও রশিদের ওপর দায়িত্ব পড়ে সেই নীলনকশার ‘অ্যাকশন’-এর দিকটা কার্যকর করা। এ বিষয়টি বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে নানা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২৫ বছর পর ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার এরিক হিচেন্সের ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ শিরোনামের বই। এতে তিনি কিসিঞ্জারকে অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এক বিচিত্র মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও। বইটিতে তিনি কিসিঞ্জারকে একজন যুদ্ধাপরাধী হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। আর কিসিঞ্জারের বিচারের জন্য ন্যুরেমবার্গসহ অন্যান্য ট্রাইব্যুনালের আদলে একটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের দাবিও করেছেন।

ক্রিস্টোফার এরিক হিচেন্স

হিচেন্স ৩০টির অধিক গ্রন্থের রচয়িতা, সহ-রচয়িতা, সম্পাদক বা সহ-সম্পাদক। স্টেটসম্যান, দ্য নেশন, দ্য উইকলি স্ট্যান্ডার্ড, দ্য আটলান্টিক, লন্ডন রিভিউ অব বুকস, দ্য টাইমস লিটেরারি সাপ্লিমেন্ট, স্লেট, ফ্রি ইনকোয়ারি, ভ্যানিটি ফেয়ারসহ বহু পত্রিকায় তিনি কাজ করেছেন। ভাবাদর্শের দিক থেকে হিচেন্স ছিলেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী ও মার্ক্সবাদী। তিনি চার দশকেরও বেশি সময় সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে জড়িত ছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।

হেনরি কিসিঞ্জার সম্পর্কে হিচেন্স লিখেছেন, “বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে কিসিঞ্জার রাজনীতির বিষয়টাকে একটি নিতান্ত ‘ব্যক্তিগত’ ব্যাপার হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা দেখিয়েছেন। তার কারণে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তার জন্য অসুবিধাজনক কতিপয় ব্যক্তির কথাও আমরা জানি। যাদের মধ্যে ছিল সালভাদর আলেন্দে, আর্চ বিশপ ম্যাকারিওস ও শেখ মুজিবুর রহমান।”

হিচেন্স তার বইয়ে কিসিঞ্জার ও ইয়াহিয়ার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড শুধু নয়, একাত্তরের গণহত্যার জন্যও কিসিঞ্জারকে অভিযুক্ত করেছেন হিচেন্স। হিচেন্সের দ্ব্যর্থহীন মন্তব্য, ভারতবিদ্বেষী নিক্সনকে খুশি করাই ছিল কিসিঞ্জারের ব্যক্তিস্বার্থ। আর এটা চরিতার্থ করতেই তিনি তার বাংলাদেশ নীতি নির্ধারণ করেন। কিসিঞ্জার পণ করেছিলেন, কিছুতেই তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় মানবেন না। এমনকি কিসিঞ্জারের তৎকালীন সহকারী রজার মারিসের মতে কিসিঞ্জার আলেন্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেছিলেন।

হিচেন্স তারই বইয়ে কিসিঞ্জারকে যে অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এক বিচিত্র মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তা যথার্থ বৈকি। যে কিসিঞ্জার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই তিনি ২০০৭ সালের ১ এপ্রিল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘...বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পলিসি ছিল, যাতে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে না পড়ে।’

আবার কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ (Bottomless Basket) বলেছিলেন, এ কথা কে না জানে! কিন্তু এটাও তিনি ওই সাক্ষাৎকারে অস্বীকার করে বলেন, ‘ওভাবে বলেছি কি না তা মনে নেই।’

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।

[ পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে আগামী ২৩ আগস্ট ]

আরও পড়ুন