• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০১৯, ০৭:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১০, ২০১৯, ০৭:২৩ পিএম

আশ্চর্য সুখ

আশ্চর্য সুখ

পর্ব:  ১

প্রাণ কোকিলা ডাক দেয় আচমকা এক রাইতে যহন আমার বয়েস চল্লিশ। চোখ ডলতে ডলতে ঘুম ভাঙ্গি, নাহ্ ঘুমাই নাই তো ! আমি তো জাগনা তয় ক্যান এমুন ঘুম ঘুম, আমি জ্যাতা না মরা হেই ঠাহর পাই নাই এতদিন।

আইজকা ক্যান এমুন জ্যাতা জ্যাতা লাগে? কেমুন ব্যাপার? কিচ্ছু বোজোনের উপায় নাই । আমারে কি বান বাতাসে ধরছে? নাহ্ কয়দিন ধইরা পুস্কনিত নামি না, বাতাস লাগব কেমনে? তয় ? নাকি কেউ যাদু- টোনা করছে! ও গাফুরুর রহিম এমুন লাগে ক্যান ?  চিন্তায় চিন্তায় আমি সাতরাইতে থাকি পিছের দিকে ...

পর্ব : ২ 

পিছের দিকে যাই আর কইলজ্জ্যার ভিত্রে ধড়াস ফরাস করে। কার চেহারা ছবি ভাইস্যা ওঠে? আবছা মতন মনে আসে কার খোমাটা ? হ কি জানি মনে ভাসে আবার ভাসেও না ! কেটায় জানি  ?

হ ,আমিই তো তিরিশ বছর আগে যে আমারে হারায়া আইছি পেয়ারা গাছের কাছে, কামরাঙ্গা গাছের কাছে, এক উঠান রইদ আর কালা আন্ধারের কাছে । হেয় কেল্লেগা আজাইরা ডাক পারে আমারে ? না কি এইটা উপরঅলার ইশারা?  আমার লগে লগে একটা ছায়া ঘোরে ক্যান। মায়া মায়া ছায়া ? কেটায়রে তুই ? জিয়নকাঠি ?

পর্ব : ৩

কি মুসিবত ! কুতকুত খেলার ঘরগুলি জ্বল জ্বল কইরা ওটে মাইট্টা উঠানে, খেঁজুর বিচিরা খিলখিলায়া হাসে কয় চাইরগুটি খেলবি? এপি পনেরো কেশতেলের নারিকেলের গন্দ এমুন চনমনাইয়া ওটে, উফ্ এটি কি অয় আমার লগে? দড়ি লাফানির দড়িটা ঝুরঝুরায়া খুইল্লা যাইতে গিয়া গোঙ্গায় ক্যা ? চোর পলান্তি খেলনের বেতঝারটা চাইয়া থাকে ক্যা ? আমার মাতাটা বনবনায়া ঘোরে হায় হায় আমি কই যাই কি করি !

রানীমাসি হ হ রানীমাসিই তো ডাক পারে আমারে, য্যান ফিসফিসায়া কানের কাছে কয় ওই ফজিলা কতদিন আহস না আমাগো বাইত! মাধবের বাপে মইরা গেছে তাও একটা খবর নিলি না তরা কেমনে এত পাষান হলিরে? 

ও মাধব , আমার মাধব ! তর ছায়াটাই তয় ঘোরতাছিল আমার পিছে পিছে ! তুই না কৈ গেছিলি গা ? তরে তো আর খুইজ্জা পাওয়া যায় নাই। মাসির কান্দনে সারাটা পাড়া থরথরায়া কাঁপছে। আমি তর লগে সারাদিন খেলতাম, টৈ টৈ কইরা ঘোরতাম । মনে পরতাছে হ সব মনে পরতাছে ।

পর্ব : ৪

ফজি ও ফজি ওটস না ফুল তোলতে যামু’। ধুপ্পুর ধাপ্পুর আমাগো উত্তর মোখের জানলায় আওয়াজ কইরা ডাকনের দিনগুলিরে মনে করলে ঢেক্কুর দিয়া কান্দন আহেরে মাধব। 

আমি তরে আদর কইরা মইদ্দা ডাকতাম, তুই কিছু কইতি না খালি মিটমিটায়া হাসি দিতি। কেমনেরে সব কিছুই হারায়া যায়? তুই আর আমি কতদিন শিউলি ফুল তোলতে গেছি? এমুন ঠান্ডা আর শরীল জুরাইন্না সকাল কি কোনদিন আর মিলব ক ? আশ্বিন মাইস্যা সকালে ফুল তুইল্লা একলগে ইস্কুলে যাইতাম। তুই যাইতি আমার এক কেলাস নিচে। ইস্কুল শ্যাষ কইরা একটা দৌড়ান মারতাম বাইত। কহন যামু তর লগে খ্যালতে এই চিন্তা বাদে আর কোন চিন্তা য্যান আমার দুইন্নাতে আছিলোই না । 

মইদ্দারে, ও মধু ...আমার মাধব। দশমীর দিন তুই যে জোর কইরা আমারে লুচি লাবডা খাওয়াইতে তগো বাইত লইয়া যাইতি হেচরাইতে হেচরাইতে। আমি শরমে মরতাম।
রানী মাসি কি আদর কইরা আমারে তামান খাওয়নটি দিত। অহন আর কেউ ডাকেনারে ।

পর্ব : ৫

আয়রে আমার গোলাপ, আয়রে আমার বেলি, আয়রে আমার টগর। মাতার ভিত্তে ভনভনাইয়া ঘোরতাছে আওয়াজটি। আমি পষ্ট হোনতাছি ...মুন্নায় আমার দুই চোখের উপরে এমুন টাইট কইরা ধইরা রাখছে তবু আমি তর পায়ের আওয়াজ হোনতাছি। তুই কপালে টোক্কা দিলে আমি বুইঝ্ঝা যাইতাম এক্কেরেই। খুকু, তসলি, আমার ছোট বাই মুন্না , তুই আর আমি এই পাঁচ জনে মিইল্লা আমরা কত কি না খেলছি । 

চোর পলান্তি খেলনের সমে তর একটা ঠ্যাং নাইলে একটা হাত বাইর হইয়া থাকতই। তুই কি ভোন্দা আছিলি ? নাকি ইচ্ছা কইরা এমুন করতি আমারে জিতায়া দেওনের লেগা? 
অহন মনে কয় তুই আমারে জিতায়াই রাখতি মইদ্দা চোরা। মনে আছে মইদ্দা চোরা পাদের বোরা ! আমরা একজন আরেকজনরে চেতাইতাম এটি কইয়া হাহ্ হাহ্ হা ।

পর্ব : ৬
হারামী কৈ ডুব দিলি ? ওরে মইদ্দা চোরা... মধুরে ... মাধব! আমাগো বাড়ির থেকা ইট্টু দূরে যে বড় পুষ্কুনিটা আছিলো হেইটায় কত যে শাপলা হইতো। শাপলার ভিত্তে যে ঢ্যাপ অয় হেলেগ্গা আমার পরান পইরা থাকতো। একবার তুই শাপলা তোলতে গিয়া শয়তানি কইরা এই যে ডুব দিলি আর তো ওটস না আমি চিল্লায়া গলা ফাটাইয়া চিল চিক্কুর দিছি পরে তুই ভাইস্যা উটছিলি। আমার জানে পানি ফিরা আইছিল হেদিন। মনে আছে আমি তরে ধইরা কি কান্দনটা দিছিলাম। হারামি শালা অহন পাইলে তরে কিলায়া তর ভূত ছুটাইতাম। 

মইদ্দারে শবে বরাতের রাইতে আমরা দল বাইন্দা রাইত জাগতাম, নামাজ পড়তাম আর তুইও আমাগো লগে বইয়া থাকতি। মায় রুটি হালুয়া দিয়া পাটাইতো মাসিরে আর তুই গপগপায়া খাইতি। আবার রোজা আইলে ইস্তারিও দিতাম। ঈদের দিন আমরা একলগে থাকতাম, বিকালে মেলাত যাইতাম সেলামির ট্যাকা দিয়া খেলনা কিনতাম। হেই সুখের দিনগুলি আর আহে না ক্যা রে? 

আমাগো কাশীপুরে কত্তটি ঘর হিন্দু পরিবার আছিলো, অহন কমতে কমতে একটাও নাই। কেশব কাক্কায় মরণের পরে পরেই তুই যহন নিরুদ্দেশ হইয়া গেলি, যাদব দাদায় রানী মাসিরে লইয়া ওই পারে গেলোগা। আর কোনদিন হেগো খবর পাই নাই। তুই কি হারায় গেলি না মইরা গেলি জানতে পারি নাই। আমার বয়স বারো হওনের পরে পরেই মায় কইয়া দিলো এত্ত ডাঙ্গর ছেড়ি আর ঘরের বাইরে যাবি না। খেলা বন্দ আমিও ইট্টু ইট্টু কইরা মরতে শুরু করলাম। 

পর্ব : ৭ 
লুড্ডু খেলতে গ্যালে খালি আমারে হাপে কাটতো। এমুন জিদ লাগতো আমার। তুই  কি সোন্দর তরতরাইয়া উপরে উইট্টা যাইতি নারে মাধব? তর লগে কতদিন খেলিনা। কেমনে খেলমু অহন তো আমি বুড়ি । সত্যইরে !
মইদ্দা হোন , আমি কালাকোলা খ্যাংরা কাটির মতন আছিলাম দেইখ্খা মেট্টিক পাশের পরেও আমার বিয়ার সম্বন্দ আহে নাই। খুকু আর তসলির গায়ের রং পরিষ্কার ওগো ধপাধপ বিয়া হইয়া গেলো। হেশে কাশেম মামায় হের এক চিনাজানা দর্জি ব্যাটার লগে আমারে জোড় কইরা বিয়া দিয়া দিল। ব্যাটায় কেলাশ এইট তক পাশ দিছিল। হগলতে কইলো কি অইছে দর্জি কি মানুষ না ? আমি আর কি করমু ক? বাপের চিন্তা মায়ের খোটা সব শ্যাষ হইব হেলেগ্গা বিয়া বইলাম। কিন্তু দ্যাখ হেই লুড্ডুর মতন আমার খাতা শূন্যই রইয়া গেলো। সাবু দর্জি আটখুরা আছিলো না আমি আছিলাম জানিনা। আমাগো কোনো পোলাপাইন হইলো না। হের আবার জুয়ার ন্যাশা আছিলো। জুয়ারিগো লগে মাইরপিট কইরা জেলে গেলো। আইজও
গেলো কাইলও গেলো সাবু দর্জি আর ফিরল না। তুই কৈ গেলি ? কেমনে গেলি ? না মইরা গেছস ? কেউ কিছু জানতে পারলামনারে । 


অহন আমি মুন্নার বাইত থাকি। ওর পোলাপাইনটি আমারে আম্মা ডাকে। কি যে আনন্দ লাগে। কিন্তু কি জানস মধু ? আমি ওগো কামের বেটি , বুয়ার মতন থাকি। কি করমু আমার আর উপায় কি ? খালি মরনের দিন গোনতে থাকি। এমুন শ্যাষের বেলায় কইত্তে তর কতা মনে পড়লো কে জানে? তর লগে খ্যালনের কতা চিন্তা কইরা মনে হইতাছে আমি জ্যাতা হইয়া ওটতাছি। মইদ্দা অহন হিসাব কইরা দেহি তুই হইলি আমার জীবনের সত্য সুখ, আমার আলুনি জীবনের নুন। মইদ্দা চোরা তুই কি জানস তরে আমি কত মায়া করি।

/ডিজি