• ঢাকা
  • সোমবার, ০৭ অক্টোবর, ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২৩, ০১:২৯ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ২২, ২০২৩, ০১:৪৯ এএম

সাবিরা ইসলাম

তারা অভিশপ্ত

তারা অভিশপ্ত
কবি হক ফারুকের ওয়াল থেকে নেয়া

তোমার সাথে অনেক বিষয়েই
মতের মিল নেই আমার, হবেও না।
হয় না, হওয়ার কথাও নয়! 
আমি বুঝে ফেলেছি, আমাদের
মতের তফাৎ নেহায়েত কম নয়।
সবকিছুতে তুমি খুব বেশি বিরক্ত! 
আর আমি আশাবাদী মানুষ— 
লড়াকু, হতাশ হতে জানি না।
 

এই দেশ এবং দেশের শাসকদের ওপর
তোমার ক্ষোভ, রাগ, ঘৃণা প্রবল
আক্রোশে বিষ্ফোরিত হয়— 
তুমি দৃশ্যমাণ উন্নয়ন অস্বীকার করো না। 
বড় বড় ইমারত উঠেছে শহরের বুক ফুঁড়ে
আবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকাশ্য ভীষণ
সেসব স্বীকারে তোমার জড়তা নেই— 
তবে হীনমণ্যতা কাজ করে কোথায় যেন!

সেসব মেনে তুমি যখন প্রশ্ন তোলো— 
নাগরিক হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা,
 শিক্ষার নিরাপত্তা কোথায়? তখন আমি নীরব হই।
অপরাধীর মত উত্তর হাতড়ে ফিরি !

ওসব না হয় বাদ দিলাম
কিন্তু বায়ান্নটি বছর কেটে গেছে
এখনও দ্বিধা কাটছে না তোমার— 
কে জাতির পিতা প্রশ্ন তোলো
আমি মানি, তুমি মানো না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ৭ মার্চের ভাষণকে 
যখন বলো, বাকোয়াস! মিথ্যার ফুলঝুড়ি!
আমি বিস্মিত হতে ভুলে যাই।
এই তোমাকে আমি চিনি না। 
আমার বুকে সেই পুরোনো চিনচিনে
ব্যথাটা আবারো মোচড় দিয়ে ওঠে। 
আমি নূইয়ে পড়ি-ভেঙ্গে পড়ি!
মতের পার্থক্য তো থাকবেই আমাদের-
তাই বলে অস্তিত্বকে অস্বীকার করে
কী প্রমাণ করতে চাও বুঝতে পারি না!

তুমি কি জানো, আমার বাবা যুদ্ধে যাবে জেনে
বেঁধে রেখে তার সামনেই মাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল? 
আর ভাই আগেই চলে গেছিল বলে 
আমার বোনকে বানানো হয়েছিল গণিমতের মাল?
তার স্থায়ী আবাস হয়েছিল পাকিস্তানি ক্যাম্পে? 
তার শরীরে হানাদারের বিষাক্ত বীজ প্রবেশ করেছিল!
বিজয় মিছিলের ভীড়ে সে স্বেচ্ছায় তাই
আজন্ম চেনা বাড়ির পথ ভুল করে
ট্রেনের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি নিয়েছিল?
আমার ভাই ফিরে আসেনি আর, বাবার মস্তিষ্ক 
বিকৃতি ঘটেছিল, ওভাবেই মরে পড়ে ছিল
রাস্তার পাশে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে।
আমাদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল সেদিনই।
আমার মা ঘরের আরায় ঝুলে পড়েছিল
পরণের ছেঁড়া শাড়ি পেঁচিয়ে দড়ি বানিয়ে— 
শুধু আমার প্রাণটা বড্ড বেহায়া, নির্লজ্জ!
ওটা ঠিক টিকে গ্যাছে দেখো!

সেদিন আমি বেঁচে গেছিলাম, তাই ভাবছো? 
আমার শরীর ওদের উপযুক্ত ছিল না বলে
অপ্রতিরোধ্য আক্রোশে আগুণে ছুঁড়ে ফেলে 
দেয়া হয়েছিল চরম অবজ্ঞায়! 
সেদিনই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আমার ভবিষ্যত।
আমার সারাজীবনের পথরেখা।
পুরুষের মনোরঞ্জনে নারীর যেসব অঙ্গ
খুব বেশি প্রয়োজন, তা পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায়
আমার ঘর হয়নি, সংসার হয়নি আর— 
পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টি কাকে বলে আমি জানি না।
আমার স্বপ্নগুলো এখনও এখানে সেখানে
 বিষন্ন হাওয়া হয়ে দেয়ালে দেয়ালে ঠোক্কর খায়।

একবার তাকাও আমার দিকে
আজ যে মাটির উপর দাঁড়িয়ে তুমি
অস্বীকার করছো সব, আমার স্বপ্ন পুড়িয়ে
তোমার জন্য সে মাটি গড়ে দিয়েছি আমি।
আমার পরিবার, আরো অসংখ্য আত্মত্যাগী মানুষ! 
আরো অনেক পরিবার, নাম না জানা অসংখ্যজন। 
আমাদের সম্মিলিত সর্বনাশের বিনিময়ে
আমাদের সর্বস্ব হারানোর বিনিময়ে
যে দেশ, যে মাটি, যে সম্মান, যে ঐশ্বর্য পেয়েছো
কিছুই মিলত না , কৃতদাস হয়ে কাটাতে জীবন।
ভিক্ষুকের দিকে ছুঁড়ে দেয়া দয়ায় বাঁচতে।
যদি মানুষ হও, মাথা নত করো।
সত্যকে স্বীকার করার হিম্মত দেখাও। 
আছে সেই হিম্মত? নেই যে নিশ্চিত জানি।
কারণ বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা 
শব্দগুলোর ওজন ধারণের সক্ষমতা 
সবার নেই, সবাই সে ভার নিতে পারে না। 
তারা যে অভিশপ্ত! এই মাটি, এই পতাকার
সামনে তারা চির অভিশপ্ত!

 সাবিরা ইসলাম, কবি ও সাংবাদিক