• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২০, ০৭:৩৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৬, ২০২১, ০২:০১ পিএম

অমর কথাকার ফজলুল হক

অমর কথাকার ফজলুল হক

উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষে প্রতিভাবান এক তরুণ গল্পকারের আবির্ভাব ঘটল। তিনি এলেন, জয় করলেন, আবার হারিয়েও গেলেন। লিখলেন মাত্র চার-পাঁচটি গল্প। গল্পগুলো প্রকাশিত হলো সে সময়কার বিখ্যাত কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায়। সবকিছু এত দ্রুততার সঙ্গে ঘটল যে বাংলা সাহিত্যের বিশাল পাঠক সমাজের কাছে তার সাহিত্যকর্ম পৌঁছার আগেই তিনি পাড়ি জমালেন অনন্তের পথে। মানুষ-সমাজ ও রাজনীতিসচেতন এই কথাশিল্পীর নাম ফজলুল হক। আজ তার ৭১তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর নরসুন্দা নদপারের এই কথাশিল্পী হঠাৎই ধরণি ছেড়ে পাড়ি জমান অনন্তের পথে। সেদিন সকালে ঢাকার নীলক্ষেতের কাছে চলন্ত ট্রেনের নিচে নিজেকে বিসর্জন দেন তিনি। অন্য দিনের মতো সেদিনও ফজলুল হক প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন। তারপর হঠাৎই ঘটল এ অঘটন। দুর্ঘটনার পর তার মুখমণ্ডল থেঁতলে গিয়েছিল। নিকটজনেরা তার জুতা ও মাথার চুল দেখে মৃতদেহ শনাক্ত করেছিলেন। 
কথাশিল্পী ফজলুল হকের জন্ম ১৯১৬ সালে ব্রিটিশশাসিত ভারতের তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত জঙ্গলবাড়ী গ্রামে। সে সময়কার সেটেলমেন্ট অফিসার কোব্বাদ আলী ও খুরশিদা বেগমের প্রথম সন্তান ফজলুল হক। জাহানারা জিয়াউদ্দীন, সেলিমা হক ও ড. মোজাম্মেল হক তার অপর তিন ভাইবোন। তার ডাক নাম দুলু, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সবাই তাকে এ নামেই ডাকতেন। পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকায় ছাত্রাবস্থায় তাকে তেমন কোনো সংকটের মুখোমুখি হতে হয়নি। ফজলুল হক ১৯৩২ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে কলকাতায় গিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে দর্শনশাস্ত্রে এমএ করেন তিনি। 

ফজলুল হক কলকাতা থাকাকালীন লেখক, চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। পরে সে সম্পর্ক গভীর হৃদ্যতায় পৌঁছায়। তিনি হয়ে ওঠেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সুহৃদ। সেখানে ফজলুল হকের সহপাঠী ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাগ্নে হাবিবুর রহমান (যিনি পরে ভারত সরকারের চিফ আর্কিটেক্ট হয়েছিলেন)। এই বন্ধুর সূত্র ধরেই চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুবের পরিবারের একজন হয়ে ওঠেন কথাশিল্পী ফজলুল হক। এই সময়ে ভারতবর্ষের অনেক মনীষীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটে তার। কলকাতায় ফজলুল হক থাকতেন বিখ্যাত বেকার হোস্টেলে। বেকার হোস্টেলে কিছুদিন থাকার পর তিনি কলেজ স্ট্রিটের ওয়াইএমসিতে চলে যান। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কাছে হওয়ায় যাতায়াতের সুবিধার্তে তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ফজলুল হক পূর্ব বাংলায় নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। কলকাতা ছাড়লেও আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে তার মনের দূরত্ব তৈরি হয়নি। দুজনের বয়সে যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও তাদের বন্ধুত্বে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। আবু সয়ীদ আইয়ুব বয়সে ফজলুল হকের চেয়ে ৯ বছরের বড় ছিলেন। তার আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রীতীশ দত্ত। তারা একই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও ছিল তাদের একই। তবে অধ্যয়নের বিষয় ছিল আলাদা। প্রীতীশ দত্ত পড়তেন অর্থনীতিতে আর ফজলুল হক দর্শনশাস্ত্রে। অধ্যাপক প্রীতীশ দত্ত পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। আমৃত্যু দুজনের সম্পর্ক অটুট ছিল। বাংলা সাহিত্যেও আরেক খ্যাতিমান কথাশিল্পী শওকত ওসমানের সঙ্গেও সখ্য হয়েছিল ফজলুল হকের। তাদের পরিচয়ও হয় কলকাতায়, চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুবের মাধ্যমে। শওকত ওসমান তখন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়নরত। তিনি বয়সে ফজলুল হকের এক বছরের ছোট। ফজলুল হকের মৃত্যুর প্রায় বছরখানেক আগে তাদের দেখা হয় চট্টগামে। শওকত ওসমান লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সনে ফজলুল হক একবার চাটগাঁ আসেন। আমিও তখন ওই শহরের অধিবাসী। ট্রেনে ফজলুল হক দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী। কামরার দরজা বন্ধ ছিল, কিন্তু জানালা আর বন্ধ করেননি। সকালে ঘুম ভাঙার পর তিনি দেখেন সুটকেস গায়েব, তার অনুসারী জুতা পর্যন্ত। তিনি সোজাসুজি আমার ফিরিঙ্গী বাজারের বাসায় চলে আসেন। আমাদের বাড়ীর নাম ছিল “মিলন-মন্দির”। শুল্ক বিভাগের সৈয়দ মুজিবল হক, বোরহান উদ্দীন আহমদ (তখনও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেননি) আমরা একসঙ্গে থাকতাম। “মিলন-মন্দির” নাম সার্থক এবং চতুরঙ্গ পূর্ণ করতে ফজলুল হক এসে পৌঁছালেন। একসঙ্গে তিন দিন তার সাহচর্য পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।’ [ফজলুল হকের গল্প: একটি স্মরণিকা- সম্পাদনা- শওকত ওসমান, প্রকাশ- সেপ্টেম্বর ১৯৮৩, পৃষ্ঠা. ১৮-১৯]
ফজলুল হক ছিলেন অগ্রসর চিন্তার মানুষ। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা ছিল। আমৃত্যু তিনি লালন করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। যার ছাপ তার লেখায় পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে ফজলুল হকের আগমন ঘটে ১৯৪৩ সালে। তার লেখকজীবন ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। তিনি বেঁচেও ছিলেন খুবই অল্প সময়। মাত্র ৩৩ বছর। জীবনের এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি মাত্র পাঁচটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে আবার একটি গল্প আজও খোঁজে পাওয়া যায়নি। সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, ‘মাছধরা’, ‘বুড়ী-মা’, ‘মাস্টার’ ও ‘হারানের মৃত্যু’ নামের গল্পগুলোর। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’, হুমায়ুন কবীর সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ’ ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় উল্লিখিত গল্পগুলো প্রকাশিত হয়। গল্পকার ফজলুল হকের প্রতিটি গল্পই জীবনমুখী। মানুষ ও সমাজজীবনের হাহাকার, বাস্তব চিত্র তার গল্পে নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। পল্লিকবি জসীমউদদীন, কথাশিল্পী শওকত ওসমান, কবি শামসুর রাহমান, আবুল হোসেন, হাসান হাফিজুর রহমান, হায়াৎ মামুদ, কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার তার গল্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। 
‘চলে মুসাফির’ গ্রন্থে পল্লিকবি জসীমউদদীন লিখেছেন- ‘মুসলিম বঙ্গের সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প লেখক ফজলুল হক, যার ছোটগল্প যে-কোন নামকরা হিন্দু লেখকের লেখা ছোট গল্পের সমপর্যায়ে আনিয়া দাঁড় করানো যায়।’
ফজলুল হকের গল্পের অনুরাগী ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। গল্প পড়ে তিনি তার প্রতি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সে সময় অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে দৈনিক পাকিস্তানে তিনি ফজলুল হক এবং তার গল্প নিয়ে কলাম লেখেন। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী সময়ে কথাশিল্পী শওকত ওসমান সম্পাদিত ‘ফজলুল হকের গল্প: একটি স্মরণিকা’তেও তিনি লেখেন। স্মরণিকাতে শামসুর রাহমান লিখেছেন- ‘ফজলুল হকের ভাষায় কোন চোখ-ঝলসানো চাকচিক্য নেই, নেই অভিনবত্বের ঝলসানি। অত্যন্ত নিরাভরণ তাঁর ভাষা, শহরতলীর সহজ সুন্দরীর মত। আমাকে মুগ্ধ করেছিল ফজলুল হকের অন্তর্দৃষ্টি ও অসামান্য পরিমিতি-বোধ।’ ‘...সুদূর চল্লিশ বছর আগে যিনি তিনটি অসাধারণ ছোটগল্প লিখে ছিলেন উনিশ কুড়ি বছর বয়সে, তাঁর এই অকালমৃত্যু আমাদের সাহিত্যের যে কী ভয়ানক ক্ষতি করেছে আজকের পাঠকরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারবেন না।’
গল্পের বাইরে শক্তিমান গল্পকার ফজলুল হক যে একসময় উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন, সেটি জানতেন তার ছোট ভাই ড. মোজাম্মেল হক। যদিও উপন্যাসটি পরে আর উদ্ধার করা যায়নি। 
কলকাতা থেকে ফেরার পর ফজলুল হক একসময় চাকরিরও চেষ্টা করেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা অর্জনের পাঠ চুকে যাওয়ায় সেটাও জরুরি ছিল। তাই সে উদ্দেশ্যে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসেন। ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন বেতার কেন্দ্রে, কিন্তু চাকরিটা তার হয়নি। দর্শনশাস্ত্রে এমএ পাস করা মেবাধী এই মানুষটার চাকরি না হওয়ায় তার সতীর্থ-স্বজনরা ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। হতবাক হয়েছিলেন তিনি নিজেও। পাশাপাশি সময়ে পারিবারিক উদ্যোগে বিয়েও ঠিক হয় ফজলুল হকের। কনে সম্পর্কে তার নিকট আত্মীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফজলুল হকের আপত্তিতে বিয়েটি ভেস্তে যায়। এ সবকিছুই হয়তো তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। ১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন এক সকালে পাড়ি জমান তিনি অনন্তের পথে। ফজলুল হকের মৃত্যুতে তার বন্ধুরা-স্বজনেরা কেঁদেছেন, ব্যথিত হয়েছেন। পল্লিকবি জসীমউদদীন তার মৃত্যু সংবাদ শুনে তীব্র শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। কেঁদেছিলেন অনেকক্ষণ। ফজলুল হকের প্রিয় বন্ধু-সুহৃদ আবু সয়ীদ আইয়ুব তার প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যান। কিছু সময় পরপর আর্তনাদ করে উঠতেন তিনি। প্রিয় বন্ধু হারানোর বেদনা ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বেশ সময় লেগেছিল তার।
কিন্তু কেন ফজলুল হকের এই আত্মাহুতি। বেকারত্বের গ্লানি, দেশভাগের মর্মবেদনা, প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে দূরে চলে আসা, নাকি কোনো নারীর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। সেসব প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।