• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ০২:২৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১, ০২:১৭ পিএম

আত্মমর্যাদার নীতি

ইংরেজি যেভাবে জ্ঞানের বাহন হলো

ইংরেজি যেভাবে জ্ঞানের বাহন হলো

এডওয়ার্ড গিবনের (১৭৩৭-১৭৯৪) ‘দ্য হিস্টরি অব দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার’কে ধ্রুপদি ইতিহাসশাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন বইয়ের লেখক গিবন তাঁর প্রথম জীবনের লেখালেখির সূচনাটা করেছিলেন ফরাসি ভাষাতে। কেন?

মধ্যযুগের শেষ দিকে ফরাসি রাষ্ট্রের বিপুল উত্থান ঘটে। এর ফলে ইউরোপীয় জগতে জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্যের বাহন ল্যাতিন ভাষার পয়লা স্থানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয় ফরাসি ভাষাটিও। এর কারণটা স্বাভাবিক। রাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যেরও উন্নতি ঘটে। একসময়ে ইউরোপীয় অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ ফরাসি ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫)-এর আমলে ইউরোপীয় আন্তর্জাতিক কূটনীতিরও প্রধান ভাষার স্থান নেয় ফরাসি ভাষা। এই যে একটা পরিভাষা হিসেবে আজ বলা হয় ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’, এর মানে সবার কাছে বোধ্য একটা ভাষা, সেটা এসেছে একটি ইউরোপীয় রাজনৈতিক বাস্তবতার ঐতিহ্য থেকে। মধ্যযুগের ওই সময়ে ফ্রাঙ্কা মানে ফরাসিদের ভাষাটি ইউরোপের শিক্ষিত সবার কাছে বোধগম্য ছিল, যেমন আফ্রিকার বহুস্থানে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল আরবি। এখনকার দুনিয়াতে ইংরেজিই যেমন অন্যতম প্রধান লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা।

তো ইংল্যান্ডে ওই সময়ে ফরাসি ভাষারই রাজত্ব ছিল, ভদ্রলোকেরা ফরাসি ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। অধিকাংশ পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই-ই ফরাসি কিংবা অল্প কিছু ক্ষেত্রে লাতিনে লেখা হতো। সেই রীতি অনুযায়ী গিবনও তরুণ বয়সে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে শিক্ষা গ্রহণ করেন, তার ওপর ফরাসি সংস্কৃতির বিপুল প্রভাব ছিল। ফরাসি ভাষায় গিবন কিছু প্রবন্ধও লেখেন। সুইজারল্যান্ড রাষ্ট্রের ইতিহাস বিষয়ে একটা গ্রন্থ রচনাতেও হাত দেন ফরাসিতেই, যদিও উদ্দিষ্ট পাঠকরা ছিলেন প্রধানত ইংরেজ। ইংল্যান্ড তখনো ইউরোপীয় রাজনীতিতে প্রধান হয়ে ওঠেনি। সমকালীন আরেক বিখ্যাত দার্শনিক ডেভিড হিউম বয়সে ছিলেন গিবনের চাইতে বছর বিশেকের বড়, তিনি গিবনকে পরামর্শ দেন: ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যদি লেখো, তো ইংরেজিতেই লেখো’।

হিউমের এই পরামর্শের মাঝে ভবিষ্যৎকে দেখতে পাওয়া একটা দৃষ্টি ছিল। ইংল্যান্ড জেগে উঠছিল এবং হিউম টের পাচ্ছিলেন এই ইংরেজ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী মাতৃভাষাতেই সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞান পড়তে চাইবে। ফলে পরভাষায় সাহিত্য রচনা করতে চাওয়া অনেকেই যাবেন হারিয়ে, কিংবা কেউ কেউ হয়তো মাতৃভাষায় ফের অনূদিতই হবেন।

আজকে দুনিয়াজুড়ে রাজত্ব করা ইংরেজি ভাষাটির ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে আদতে এই ভাষার রাজত্ব খুব বেশি পুরোনো না। জি এইচ হাবীব তার সোফির জগতের ভূমিকাতে উল্লেখ করেছেন চার্লস বার্বার এর একটি প্রবন্ধের কথা, সেখানে সংক্ষেপে বলা হয়েছে ইংরেজি সাহিত্যের সবচাইতে বড় তারকা উইলিয়াম শেকসপিয়রের সময়ে ইংল্যান্ডে কেন ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হতো না:

‘ইংরেজি ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের যুক্তি ছিল। জ্ঞান অবক্ষয়ের মুখে পড়বে, কেননা ধ্রুপদি ভাষাগুলো শিক্ষার জন্য কোনো প্রণোদনা আর থাকবে না। জ্ঞান ইতর জনগোষ্ঠীর হস্তগত হতে দেওয়াটা বিপজ্জনক ছিল। পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজের জন্য ইংরেজি ভাষা উপযুক্ত ছিল না, কারণ প্রয়োজনীয় পরিভাষার ঘাটতি ছিল। ইংরেজি ছিল একটা ‘অভব্য’ বা ‘বর্বর’ ভাষা যেটা ভাবপ্রকাশে সমর্থ নয়। এটা অনুপযুক্ত এবং সদাপরিবর্তনশীল, গ্রিক বা লাতিনে যেমন অর্থ স্থির থাকে, ইংরেজিতে তেমনটা নয়। ব্রিটেনের বাইরে ভাষাটি সাধারণভাবে বোধ্য নয়, যেখানে লাতিন ছিল একটা আন্তর্জাতিক ভাষা।’

খানিকটা আশা করি অনুমান করা যাচ্ছে এমনকি শেকসপিয়রের আমলে ইংরেজির কী দশা ছিল শাসকগোষ্ঠীর চিন্তায়। এর বড় কারণ ছিল ইংল্যান্ডের জমিদারদের বড় অংশ ছিলেন বিদেশাগত নরম্যান, তারা দেশীয় ইংরেজ প্রজাদের চাইতে অনেক বেশি আত্মীয়তা ও সাংস্কৃতিক মিল খুঁজতেন ফরাসিদের সাথে। শিক্ষার গভীরতা বৃদ্ধি তাদেরকে বহু ক্ষেত্রেই জনগণের বদলে ইউরোপীয় বৃহত্তর অভিজাতের সাথেই সম্পর্কিত করত মননের দিক দিয়ে। ইংল্যান্ডে তাই ষোড়শ শতাব্দীতেও আইন-আদালতের কাজকারবার চলত ফরাসি ভাষায় আর জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন ইতাদির চর্চা চলত লাতিনে।

ইংরেজিভাষী জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত হয়ে ওঠা, তাদের নিজেদের গ্রন্থ সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত হওয়াই ছিল একটা বড় ঘটনা, যেটা ইংরেজি সাহিত্যের চাহিদা বৃদ্ধি করল। এর আগে কেবল জনপ্রিয় নাটক, গান আর কবিতার বিষয় ছিল যে আটপৌরে ইংরেজি ভাষা, সে এখন নতুন উদিত মধ্যশ্রেণির অন্যান্য কৌতূহলেরও বাহন হিসেবে ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা প্রদর্শন করলো। এই বদলটা কিন্তু এক দিনে ঘটেনি। কিন্তু একটা সময়ে পরিষ্কার বোঝা গেল যে ইংরেজ পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে হলে ইংরেজিতেই লিখতে হবে।

পৃথিবীর ভাষার মানচিত্র বারংবার বদলায়, এখনো আমাদের চোখের সামনেই তার ধীর কিন্তু নিশ্চিত বদল ঘটছে। কিন্তু দুটো বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ফরাসি ভাষায় গভীর বুৎপত্তি অর্জন করা গিবনের ইংরেজিতে লেখার প্রতীকি গল্পটাতে। প্রথমত, যে জ্ঞান মাতৃভাষায় নেই তা আমদানি করা দরকার। সেটা তখন ফরাসি বা ল্যাতিন ভাষাতেই ছিল। তাই অন্য ভাষার জ্ঞান নিতে কুণ্ঠার কিছু নাই। কিন্তু দ্বিতীয়ত, ভাষা একটা প্রকাশের মাধ্যম যদি হয়, সংজ্ঞাগতভাবেই কোনো ভাষাই জ্ঞানচর্চার বাহন হতে অক্ষম না। আমাদের সমকালেই জাপানি, চীনা ও কোরীয় ভাষা সেই রূপান্তর হাতে কলমে করে দেখিয়েছে। তৃতীয়ত, নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করবার এই ঝুঁকিটা নেওয়াটা খুব প্রয়োজন। পরভাষায় গৌণ ও প্রান্তিক লেখক হবার চাইতে আপন শক্তিমত্তা অনুযায়ী নিজের জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাবার আহবানে সাড়া দিয়েই যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহান হতে পেরেছিলেন।