• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৪:৪০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৪:৫১ পিএম

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতীক ও সৈয়দ আবুল মকসুদ

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতীক ও সৈয়দ আবুল মকসুদ

সৈয়দ আবুল মকসুদ (১৯৪৬-২০২১) পদানত ব্রিটিশ-বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতীক হয়ে জীবনযাপন করেছেন এবং প্রতীক বহন করে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। এমন জীবনযাপন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৬১-১৯৪১) স্বয়ং করতে পারেননি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদানত ব্রিটিশ বাংলায় পরাধীন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং পরাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি সারা জীবন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি অনুগত ছিলেন ও আনুকূল্য প্রার্থনা করেই জীবনযাপন করেছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রবল প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুগত ও সহায়ক ছিলেন। সেই আলোকে সৈয়দ আবুল মকসুদ অন্তত স্বাধীন ইচ্ছা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতীক হতে সক্ষম হয়েছেন। একজন মুক্ত মানুষ ও লেখকের জীবনে এটাই বড় ধরনের সম্মান ও অর্জন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও (১৮৯৯-১৯৭৬) একজন বিদ্রোহের প্রতীক।

বাঙালি লেখক, কবি ও চিন্তাবিদদের এখনো চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। ফলে সরকারি চাকুরেদের লেখকসত্তা ও স্বাধীন চিন্তাশক্তি ক্ষমতার দাসত্বে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অথবা বলা যায় প্রকাশ শক্তি হারিয়ে ফেলে। সে কারণেই বর্তমান বাংলাদেশে গণমুখী, শক্তিমান কবি, লেখক ও চিন্তাবিদের আত্মপ্রকাশ ঘটছে না। এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন ব্যতিক্রম মানুষ। তিনি ২০০৩ সালে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ঐক্যবদ্ধ ইরাক আক্রমণের প্রতিবাদে সেলাইবিহীন সাদা পোশাক পরিধান করেন এবং পশ্চিমা পোশাক বর্জন করেন। তিনি স্বল্প সময়ের জন্য নয় বরং আমৃত্যু সেলাইবিহীন সাদা পোশাক পরিধান করেছেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতীক হিসেবে তিনি বাংলাদেশে চিহ্নিত হয়েছেন এমন সময় যখন সবকিছুই সাম্রাজ্যবাদের ছায়াতলে। সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন পুরোপুরি বিদ্রোহী না হলেও প্রতিবাদী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতীক।

সৈয়দ আবুল মকসুদ কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা, কলাম, ভ্রমণকাহিনি সব মিলে ৪০টির অধিক বই লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে রবীন্দ্ররাজনীতি (১৯৯১), রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব (২০১২) এবং পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। আরও দেখবেন মাওলানা ভাসানী, মহাত্মা গান্ধী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহসহ আরও কয়েকজন বাঙালি লেখক সম্পর্কে তিনি বই লেখেছেন। তবে দেখবেন কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে তাঁর কোনো বই প্রকাশ হয়নি। ধরে নিতে পারেন এটাও তাঁর চরিত্রের  একটা বিশেষ লক্ষণ। আমার কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে তাঁর রচিত ‘রবীন্দ্ররাজনীতি’ বইটি। আমি এই বইয়ের আলোকে সৈয়দ আবুল মকসুদের রবীন্দ্রভাবনা বিচার করে দেখব।

রবীন্দ্ররাজনীতি যথার্থভাবে বোঝার জন্য অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদ কী জিনিস, তা জানা জরুরি। রবীন্দ্ররাজনীতির মর্মকথা বুঝতে পারা যাবে যদি সাম্রাজ্যবাদ কী বস্তু, তা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। অনেক বাঙালি সাম্রাজ্যবাদ না বুঝে রবীন্দ্রনাথকে পূজা করেন। বাংলাদেশের বাম রাজনীতির মূল সমস্যা রবীন্দ্রনাথ ও সাম্রাজ্যবাদের আসল সম্পর্ক বোঝার ক্ষেত্রে অক্ষমতা। এটাই বাংলাদেশের বাম রাজনীতির বড় ব্যর্থতা। তাই সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে পূজা  করতে আগ্রহ আছে এ দেশের অনেকের কিন্তু তাঁর সাহিত্য পড়তে আগ্রহ নেই কারো খুব একটা। তাঁর গান শুনতে ভালো লাগে অনেকের কিন্তু তাঁর চিন্তাধারায় সিক্ত হতে নয়’ (সৈয়দ আবুল মকসুদ, রবীন্দ্ররাজনীতি, মুক্তধারা, ঢাকা, তৃতীয় প্রকাশ, ২০০৭, পৃ. ৪৭)।

সৈয়দ আবুল মকসুদ যেমন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিবাদের প্রতীক তেমনি অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচক। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদের তীব্র আগ্রাসন সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, অর্থনীতি-ব্যবসায়ী আর রাজনীতি-ব্যবসায়ীরা এখন সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি উচ্চারণও করেন না। ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি’-নামে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে তাহার বার্ষিক প্রতিবেদনগুলি পড়িয়া দেখুন—যদি পড়িবার মত কোন বস্তু থাকে—দেখিবেন সাম্রাজ্যবাদ কোথাও নাই।” (সলিমুল্লাহ খান, সাম্রাজ্যবাদ কি জিনিশ? ভূমিকা, বঙ্গোপসাগর:  সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, মনির ইউসুফ ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিশ্ববাংলা প্রকাশন, ঢাকা, ২০২০)।

হাজারো সমস্যার মধ্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ সাম্রাজ্যবাদ বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং মনে প্রাণে বিরোধিতা করেছেন। তাই তিনি বাংলাদেশের অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা ছিলেন আপসকামিতা প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী উভয়েই শান্তিবাদী এবং সহযোগিতামূলক ও আপসকামী রাজনীতির প্রবক্তা।’ ( সৈয়দ আবুল মকসুদ, রবীন্দ্ররাজনীতি, মুক্তধারা, ঢাকা, তৃতীয় প্রকাশ, ২০০৭, পৃ. ৩২)। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর আপসকামী রাজনীতির কারণে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শোষণ ও নিপীড়ন দীর্ঘায়িত করতে সক্ষম হয়েছে। এই দেশীয় সাম্রাজ্যবাদের দোসররা কখনো ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করেননি বরং সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করেছেন। এখানে সৈয়দ আবুল মকসুদ ব্যতিক্রম। তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও সুবিধাবাদের বিরোধিতা করেছেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ চিন্তার ক্ষেত্রে বর্তমানের ভ্রান্ত বাম ও রবীন্দ্র-ব্যবসায়ীদেরও সমালোচনা করেছেন। কারণ, সাম্রাজ্যবাদের পাতানো কৌশলে বাংলাদেশের বাম ও রবীন্দ্র-ব্যবসায়ীরা বিমোহিত। তাই জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘অথচ নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে রবীন্দ্রনাথের যে কোনো কর্মের অব্যাহত সমর্থন প্রদানকারীর সংখ্যা আজো ক্রমবর্ধমান। অনেক মার্কসবাদী সমালোচকও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক ঘটনাবলির বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করতে গিয়ে সৎসাহসের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ ( সৈয়দ আবুল মকসুদ, রবীন্দ্ররাজনীতি, মুক্তধারা, ঢাকা, তৃতীয় প্রকাশ, ২০০৭, পৃ. ২২)।  আনন্দের বিষয় হল সৈয়দ আবুল মকসুদ এই চরম সুবিধাবাদের সময়ে, আপসকামিতার যুগে, চিন্তাহীনতার আমলেও সাহসী মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান  অব্যাহত রেখে আত্মসম্মান নিয়ে  ইহজগৎ থেকে বিদায় নিয়েছেন।

আপনি অভিবাদন গ্রহণ করুন প্রিয় সৈয়দ আবুল মকসুদ।