• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২১, ০১:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৫, ২০২১, ০১:২৮ পিএম

স্বাধীনতার পঞ্চাশ

স্বাধীনতার পঞ্চাশ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হচ্ছে। সোনার বাংলার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। সুবর্ণজয়ন্তী। একটা দেশের জন্ম ভাষার স্বাধিকার চেয়ে। এর চেয়ে বড় কিছু হয় না। পৃথিবীতে এমন কিছু ঘটেছে বলে জানি না। ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্ম দিয়ে। সেই ধর্ম তুচ্ছ করে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল বাংলাদেশ। একটা জাতি নিজের ভাষার স্বাধীনতা চেয়ে ধর্ম বাদ দিয়ে জাতিসত্তাকে অবলম্বন করে দেশই গড়ে তুলল। এমন মহৎ ঘটনা বিশ শতকে আর ঘটেনি। বিশ শতকে দুটি মহাযুদ্ধ ঘটেছে, ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন চলেছে জার্মানিতে। ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটেছে। কিন্তু মার্কিন দেশের ভিয়েতনাম যুদ্ধ, উন্নয়নশীল দেশে খাদ্যের অভাব, যুদ্ধের পর যুদ্ধ মানুষের মনে শান্তি আনেনি। দেশে দেশে যুব-বিদ্রোহ লেগেই ছিল গত শতকের ষাটের দশকে। আমাদের পশ্চিম বাংলাও ছিল অশান্ত, ক্ষুধার্ত। সেই সময় প্রতিবেশী দেশে কী ঘটে যাচ্ছে, তার খবর আমরা পেতাম না।

মুক্তিযুদ্ধের আগে সীমান্তের ওপার ছিল আমার কাছে এক অলীক ভূখণ্ড। বর্ডার এক মাইলকে এক হাজার মাইল করে দেয়। দূরের করে দেয়। আমাদের ফেলে আসা গ্রাম, নদী আর আমাদের নেই, মায়ের কাছে এই কথা শুনে আমি তাঁর দুঃখ আর কান্নাকেই যেন ধারণ করেছিলাম উত্তরাধিকার সূত্রে। পূর্ব পাকিস্তান, আউয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, ভারত-পাকিস্তানের সেই ১৯৬৫-এর যুদ্ধ, ব্ল্যাকআউট, প্যাটন ট্যাঙ্ক, মিগ বিমান, স্যাবার জেট, এসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। পূর্ব বাংলার কোনো খোঁজ তেমন পেতাম না। ভিনদেশ ভিনদেশই হয়ে ছিল। শত শত যোজন দূর যেন, শুধু আমার মা রেডিও পাকিস্তান শুনতেন, তখন শোনা যেত মনে হয়। মা খবর দিতেন সাতক্ষীরাতে কী হলো, কপোতাক্ষ নদে কোথায় ব্রিজ হলো। এই সব সংবাদই ছিল তাঁর কাছে আশ্রয়। এই সব সংবাদ কবিতার সুষমায় ভরা থাকত তাঁর কাছে। মুক্তিযুদ্ধই আমাকে প্রথম জানাল বাঙালি যুদ্ধে নেমেছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। যাদের নিয়ে তারা আলাদা হয়েছিল, কিংবা হাঁড়ি ভিন্ন হয়েছিল, হাঁড়ি আলাদা করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। আর তার নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পর এক দেশনেতা, সব অর্থে বাঙালি, যিনি বলতে পেরেছিলেন, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। নেতাজির সেই ডাক, আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব, তা যেন ভাষার জাদুতে অন্য রকমে আমাদের কাছে নিয়ে এলেন শেখ সাহেব। সেই যে ৭ই মার্চের ডাক, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘ভাইয়েরা আমার, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—মনে হয়েছিল শৌলমারীর সাধু নন, নেতাজি ফিরেছেন শেখ মুজিবুর হয়ে। তখন জানলাম ওপারে কী ঘটছে। কী ঘটছিল তলে তলে। পূর্ব পাকিস্তানের দরজা বন্ধ ছিল। সীমান্ত যখন উন্মোচিত হলো, একটা দেশের জন্ম হচ্ছে অনেক রক্তের বিনিময়ে। বাংলাদেশ বাংলাদেশ। অনেক মৃত্যুর পর, অনেক অপমান আর অত্যাচার সয়ে একটা দেশের জন্ম হলো। এখন সেই দেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। এই ২৬শে মার্চ। বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতার দিনটিকে স্মরণ করবেন। আবার শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করবেন। লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা এবং অত্যাচারিত মানুষকে স্মরণ করবেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় চারপাশে অবাঙালি অধ্যুষিত কলকাতা শহরে বড় হয়ে ওঠা আমি নিজে জানলাম বুঝি সবার আগে আমি বাঙালি। বাংলা ভাষা আমার ভাষা। এই ভাষা রক্ষার দাবিতেই পূর্ব পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উদ্বাস্তু আসছে হাজারে হাজারে। তাদের জন্য সল্টলেক বালুর মাঠে শিবির করা হয়েছে। তখন ওই নগর গড়ে ওঠেনি। ভেড়ি বুজিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে ধু ধু বালুর মাঠ। যাহোক তখন অ্যালেন গিন্সবার্গ কবিতা লিখছেন যশোর রোডের ধারে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তু পরিবার নিয়ে, জর্জ হ্যারিসন রবিশঙ্কর কনসার্ট করছেন বাংলাদেশের সমর্থনে। হুমড়ি খেয়ে আনন্দবাজার যুগান্তর বসুমতী, অমৃতবাজার পত্রিকা পড়ছি। বাংলাদেশ বাংলাদেশ…

My friend came to me
With sadness in his eyes
Told me that he wanted help
Before his country dies
Although I couldn't feel the pain
I knew I had to try
Now I'm asking all of you
Help us save some lives
Bangla Desh, Bangla Desh
Where so many people are dying fast
And it sure looks like a mess
I've never seen such distress
Now won't you lend your hand
Try to understand
Relieve the people of Bangla Desh
Bangla Desh, Bangla Desh
... (অ্যালেন গিন্সবার্গ)

মনে হয়েছিল আমি কি এই আর্ত বাঙালির কেউ নই? খবরের কাগজ আর রেডিও আমাকে বদলে দিতে লাগল। রেডিও কত মধুর তখন। আমি উনিশ পেরিয়ে কুড়ি, তখন একদিন একটি খবর বেরিয়েছিল, বরুন সেনগুপ্ত সাতক্ষীরে গিয়ে ফিরে এসেছেন। বুঝলাম যে সাতক্ষীরেতে আমাদের বাড়ি। তা অলীক ভূখণ্ড নয়। খুব কাছে। বসিরহাট পেরোলেই, ঘোজাডাঙা বর্ডার দিয়ে একটুখানি। সেখানে তাহলে যাওয়া যায়। সীমান্ত দূরে ঠেলে দেয় এক এক ভূখণ্ডকে। যোজন যোজন দূর হয়ে যায় পাশের গ্রাম, পাশের গঞ্জ। তাই-ই ভাবতাম কত দূর সেই সাতক্ষীরা, কপোতাক্ষ আর মায়ের কাছে শোনা ময়মনসিংহ, যমুনা, টাঙ্গাইল, কালিহাতী, নেত্রকোনা, গারো পাহাড়। যোজন যোজন দূর। কোনো দিন তা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

হ্যাঁ, সত্যিই মনে হয়েছিল শেখ মুজিবই নিরুদ্দিষ্ট নেতাজি সুভাষ। তিনিই। না হলে এমন ডাক কে দেবেন? এমন অসাধ্য কে সাধন করবেন? আর আমার মনে হতে লাগল, শেখ মুজিব ডাক দিয়েছেন, আমাকে যেতে হবে যুদ্ধে। শেখ মুজিবকে ২৫শে মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি গ্রেপ্তার করে দূর পশ্চিমে করাচি নিয়ে যায়, কিন্তু তিনি যে ডাক দিয়ে গেছেন, তা সীমান্তের অলীক প্রাচীর ভেদ করে এপারে এসে পৌঁছেছে। মার্চ মাসের শেষ, পূর্ব পাকিস্তানের খাল বিলে আশ্রয় নেওয়া পরিযায়ী বুনো হাঁসের দল ফিরছে নিজ দেশে, সাইবেরিয়ার দিকে, তারা রাতের আকাশে উড়তে উড়তে খবর দিয়ে যাচ্ছিল, জয় বাংলা, বাংলার জয়…, বুনো হাঁসের ডাক শুনেছিলাম এক গভীর রাতে। পূর্ব বাংলা থেকে, হাওর-বাঁওড়ের দেশ থেকে তারা খবর নিয়ে ফিরছিল, যুদ্ধ লেগেছে যুদ্ধ, মানুষের মুক্তির যুদ্ধ, শেখ মুজিবকে নিয়ে গেছে তারা অনেক দূরে, বন্দী করে রেখেছে এক গুহার ভেতর। তার নামে জেগেছে মানুষ, খালবিল নদীনালা গাছ-গাছালি নিয়ে মানুষজন।

শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি,
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ…

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে গান বেঁধেছেন অংশুমান রায়, গেয়েছেনও তিনি। রেডিওতে সেই গান শুনে আমি শিহরিত। আমার ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ প্রবেশ করছে। আমি ভারতীয়। কিন্তু বাঙালি। বাঙালির জাতিসত্তা প্রোথিত হয়ে যাচ্ছে আমার ভেতর। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানিরা নিয়ে গেছে পশ্চিমে। আমি মনে মনে নিজেই লক্ষ মুজিবুরের একজন হয়ে উঠেছি। ঘুমের ঘোরে কী বলছি কে জানে, মা ডাকছেন, কী বলছিস?...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

মনে পড়ে তখন আমার এই শহর কলকাতা উত্তাল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ি, দুপুরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে মিটিং। মিছিল। কলেজে কী অপূর্ব বক্তৃতা শুনলাম কবি, অধ্যাপক তরুণ সান্যালের। একটি ঘণ্টা তিনি বলেছিলেন, নাকি তারও বেশি, শেখ মুজিবের জন্য যেমন ছিল উৎকণ্ঠা, তেমনি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল যেন শেষ যুদ্ধ। শেখ মুজিব ডাক দিয়েছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। বছর কুড়ির আমি করব কী? ফুটছি শুধু ফুটছি। রেডিওতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবাদ পাঠ শুনছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে কথিকা শুনছি। তখন রেডিও আর সংবাদপত্রই ছিল জানার একমাত্র উপায়।

আমি কয়েকজনকে জোগাড় করে চাঁদা তুলতে বেরোলাম পাড়ায়। অবাঙালিরা মুখ ফেরালেন কিছু কিছু, আবার দিলেন যে কেউ কেউ তা-ও মিথ্যে নয়। বাঙালিরা সবাই যে দিলেন তা নয়, অনেকে দিলেন, অনেকে দিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, কী করব আমরা? আমরা কি মুক্তিযুদ্ধে যাব? অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন আমাদের। নীলু, কালু, লালু, বংশীদের নিয়ে চাঁদা তুলতে আসা নিরীহ ছেলেটিকে। নীলু, কালুদের বাড়ি বেলগাছিয়ার বস্তিতে। বাবা কলমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি। উদ্দীপ্ত নীলু বলল, হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধে যাব।

বাঙালির মহাযুদ্ধ ওপারে যে শুরু হয়েছে এই কথা বলতে লাগলাম পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর অংশুমান রায় তখন এপারের বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করছেন। আমি বাঙালি আগে। আমাদের ফেলে আসা মাতৃভূমি আক্রান্ত। মাতৃভূমির কোনো খোঁজই রাখতাম না। কিন্তু এখন চিনলাম। চিনিয়েছেন শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধ চলছে। আমি চাঁদা তুলতে লাগলাম। হ্যাঁ, এ-ও সত্য, আমার সহপাঠী বন্ধুরা, পাড়ার ভদ্রলোক পরিবারের বন্ধুরা কেউ তেমন এলো না, যারা আমার সঙ্গী হলো, সেই সব গরিব বস্তিবাসীর সন্তান, নীলু, কালু, বংশী, লালু, পল্টুরা বলল, বলল, চলো আমরাও যাব যুদ্ধ করতে। কেউ কেউ বলল, পেটো বোমা বানিয়ে নিয়ে যাবে কি না। তারা ভেবেছিল পেটো বোমা দিয়ে খান সেনা মারবে। আমিও কি তা ভাবিনি? আমি নেতা, হ্যাঁ বললেই সোরা, গন্ধক, লোহাচুর ইত্যাদি মাল-মসলা তারা কিনে আনবে, বাড়িতে বসে সুতলি দড়ি দিয়ে বোমা বেঁধে সীমান্তে যাবে, দিয়ে আসবে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। না, তা হয় না। যদিও সেই ৭১-এর কলকাতায় পেটো বোমা প্রায় কুটির শিল্প। তবু ‘না’ বললাম, আগের বছর বোমা বাঁধতে গিয়ে এই এলাকার দাপুটে মস্তান লখিয়া মারা গেছে বিস্ফোরণে। আবেগপ্রবণ আমি তো আসলে ভিতু, সেই ভয় থেকে বললাম, না, পেটো বোমা দিয়ে যুদ্ধ হয় না । বরং ফার্স্ট এইড নিয়ে যাই। এই পরামর্শ পাড়ার সংগীতশিল্পী গোপালদা দিলেন। তিনি গুনগুন করছেন অংশুমান রায়ের গান। তিনি গলা ছেড়ে গাইছেন, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...। তিনি গাইছেন, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…। গোপালদা যা বলছেন তা-ই হলো। সেই টাকায় প্রাথমিক শুশ্রূষার ওষুধ, ডেটল, বেঞ্জিন, তুলো, ব্যান্ডেজ, আর কী কী কেনা হলো। বনগাঁ লোকাল ধরে বনগাঁ চললাম। উদ্দেশ্য হরিদাসপুর সীমান্ত, সীমান্তের ওপার দিয়ে যশোর যেতে হয়, যশোরে আমার কাকিমার বাপের বাড়ি, ছোটবেলা থেকে তাই শুনে আসছি। আর মা বললেন, যশোরের আগে নাভারন বলে একটা জায়গা আছে, সেখান দিয়ে সাতক্ষীরা যাওয়া যায়। মা আরও বললেন, যশোরের কাছেই সাগরদাঁড়ি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি…, সেই মহাযাত্রার আগের রাতে মা আমাকে এসব বললেন। আর বললেন, সাবধানে যাবি। মা আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন।

দমদম জংশন স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম জনা ছয় যুবক। ট্রেন চলতে লাগল, পার হতে লাগল বারাসাত, অশোকনগর, মসলন্দপুর, হাবড়া, গুমো, গাইঘাটা, ঠাকুরনগর…ট্রেন ভর্তি হয়ে যেতে লাগল। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে উঠতে লাগল যুবক আর মধ্যবয়সীরা। তাঁদের গায়ে যেন ওপারে ফেলে আসা খাল বিল, জন্মভূমির কাদামাটির গন্ধ। সবাই যাচ্ছেন সীমান্তে। পাকিস্তান আর থাকবে না। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এসেছেন একজন। বনগাঁ থেকে সেই পতাকা কাঁধে মিছিল চলল সীমান্ত পর্যন্ত। শেখ মুজিবের ডাকে আমরা চলেছি যেন যুদ্ধে। সীমান্তের চেকপোস্টে আটকেছে সীমান্ত প্রহরীরা। কিন্তু তারাই পথ দেখিয়ে দিল, কোন দিক দিয়ে ‘জয় বাংলা’য় ঢুকতে হবে। বাংলাদেশের নাম তখন জয় বাংলা। আমাদের এবার লুকিয়ে যাওয়া। কোন গ্রাম, খাল বিল পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে এক মুক্তি শিবিরে পৌঁছালাম যখন বেলা দুপুর। জয় বাংলা ডাক দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মধ্যবয়সী একজন। তাঁকে আমার স্পষ্ট মনে আছে, লুঙ্গি আর গেঞ্জি, হাতে বন্দুক। শেখ মুজিবের ডাকে এসেছি। জয় বাংলা। যা দেওয়ার দিয়ে ফিরে এসেছিলাম। কেননা শুনছিলাম পাকিস্তানি বাহিনী যশোরেরও এপারে ঝিনাইদহে এসে গেছে। এদিকে আসছে তারা। একটু মাটি নিয়ে ফিরেছিলাম। মাটি দেখে মা আর বাবার চোখে জল। কতকাল বাদে মনে পড়ল সেই ফেলে আসা গ্রাম আর নদীর কথা। বাড়ির সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল সীমান্তের ওপারের কথা। আমি যেন দেখে এসেছি বাড়ির পেছনের কাঁঠালগাছটি। আমি যেন দেখে এসেছি চুষির আমগাছটি। আমি যেন কথা কয়ে এসেছি, এজার শানা, মোজার শানার সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন বাবার বন্ধু। সেই মাটিকে মা তাঁর বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি ধুরোল গ্রামের মাটি বলে লক্ষ্মীর পটের পাশে রেখে দিল।

কলকাতার যে অঞ্চলে বাস করি, আমাদের প্রতিবেশী পাহাড়প্রমাণ লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে নিয়ে এসে পয়লা বৈশাখ এক সভা করলাম পার্কে। লোক ভেঙে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ পাঠ হলো। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি তোলা হলো। কতবার যে আমরা জয় বাংলা বললাম। পিতৃপুরুষের মতো লেখক, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন মিনিট ৪৫ কিংবা এক ঘণ্টা। আমরা বাঙালি। আমাদের ভাই, বন্ধু আত্মজ যুদ্ধে নেমেছে। মুক্তির জন্য এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধও। মুজিবুর আমাদের প্রাণের মানুষ। মুজিবুরের ডাক আমরাও শুনেছি যে কারণ আমাদের ভাষা বাংলা। আহা সেই পয়লা বৈশাখের কথা এখনো মনে পড়ে। বীরভূমের সন্তান, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বক্তৃতা লিখে রাখিনি, তখন রেকর্ড করার ব্যবস্থাও ছিল না। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বলেছিলান, ঋজু মানুষ, সটান দাঁড়িয়ে আছেন মঞ্চে। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি। মুগ্ধ হয়ে শুনছে সমস্ত পাড়া। না, তিনি দেখে যেতে পারেননি বাঙালির মুক্তি, বাংলাদেশের জন্ম। তিনি ওই বছরে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন। তখনো যুদ্ধ চলছে, বাংলাদেশের খালে বিলে মাঠে প্রান্তরে, গাঙে, গাঙ পাড়ে যুদ্ধ চলছিল তখন। মানুষ মরছিল। মানুষ সীমান্ত পার হয়ে যশোর রোডের ধারে ঝুপড়ির বাসিন্দা হয়েছিল। সেই মানুষ নিয়েই তো গিন্সবার্গের কবিতা।

তারপর? যুদ্ধ চলল। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত পেরিয়ে শীতে মুক্ত হলো এই দেশ। নতুন দেশের জন্ম হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে ডাক দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল বাংলাদেশের মানুষ, মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধই জন্ম দিয়েছিল বাংলা নামের একটা দেশের। ভারত পাশে দাঁড়িয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সব মিলিয়ে বাঙালির নিজস্ব একটা দেশ হলো। অনেক পরাজয়ের পর বাঙালি জিতল সেই প্রথম। তার আগের ইতিহাস তো শুধু পিছু হটার। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যে জয় তা এক নতুন দেশের জন্ম দিল। মহৎ মহৎ মহৎ। সেই জয় যা কিনা এমন একটা দেশের জন্ম দিল যে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সরকার চিঠি দেয় বাংলায়। মানুষ বাংলায় চিঠি লেখে প্রধানমন্ত্রীকে। সরকারি অফিসে গিয়ে বাংলায় কথা বলতে পারে সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক মানুষ। বাংলা জানলে কাজ হয়। সর্বত্র বাংলা বাংলা আর বাংলা। আর এই ভাষা, এই ভাষার গান, এই দেশের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস সব নিয়ে দেশটা বিপুল হয়ে উঠল ক্রমশ। আমাদের এপারে এই অভ্যাস থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলাম। এখন তো বাঙালির খাদ্যেই থাবা বসিয়েছে শাসকের খবরদারি। মছলিখোর অপবাদটি আমরা সহ্য করে মাছের ঝোলেই ভাত মাখি। একটা জাতি যা নিয়ে বিশিষ্ট হয়, তাকে সব সময় রক্ষা করা এই ভুবনায়নের দিনে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল সব মুক্তিযোদ্ধার রক্তের অন্তর্গত। সেই স্বপ্ন নিয়েই বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন তাঁরা। স্বপ্ন একদিনে পূরণ হয় না। ক্রমাগত পূরণ করে যেতে হয়। বাংলাদেশে তা হচ্ছে কি হচ্ছে না জানি না, কিন্তু নবান্ন, ঘরে ঘরে পিঠাপুলির উৎসব, এক মাস একুশের বইমেলা, পয়লা ফাল্গুন রঙের উৎসব, পয়লা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপন বাংলা মায়ের ছবির পেছনে যেন আলোক বলয় সৃষ্টি করে যাচ্ছে অবিরত। লৌকিক যে জীবনকে বাঁচিয়ে তোলার কাজটি বাংলাদেশে হচ্ছে নানাভাবে তা নিয়েই বাঙালি আর পাঁচটি জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা ছিল। একটা জাতি তার ভাষা আর সংস্কৃতিকে যেভাবে রক্ষা করছে নানা প্রতিকূলতার ভেতরে তা দেখে আমার মনে হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশ বাংলা ভাষা নিয়ে জন্মেছে। সেই দেশে ভাষা বাদ দিয়ে ধর্মীয় আধিপত্য যেন প্রবল না হয়। তা হবে বাঙালি জাতির বিরোধী ঘটনা। বাংলা ভাষায় অদ্ভুত কিছু বৈপরীত্যও দেখি। ভয় হয়, তা কি দুই বাংলা, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাষা আলাদা করে দেবে? কেউ কেউ ইংল্যান্ড আমেরিকার দুই রকম ইংরেজির কথা বলেন, উচ্চারণ, বানানবিধি, কিন্তু তা হতে পারে, মধ্যে আটলান্টিক মহাসাগর। এখানে সাতক্ষীরার গায়েই প্রায় কলকাতা। একই সুন্দরবনের দুই ভাগ দুই দেশের। ভৌগোলিক দূরত্ব সামান্য। ভাষা আলাদা হয়ে যাবে কেন? বাংলাদেশ আমাদের ভালোবাসার দেশ। বাংলাদেশ ভালো থাকুক। মানুষ সুখে থাকুক। তাহলে আমরাও সুখে থাকব। সোনার বাংলার স্বাধীনতার সোনার জয়ন্তী। একবার ওই দেশের মাটি ছুঁয়ে দেখি এই লেখার ভেতর দিয়ে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ