• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২১, ০২:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৫, ২০২১, ০২:১৫ পিএম

ছিঃ

ছিঃ

মোবাইল স্ক্রিনে অনলাইন নিউজ পড়তে পড়তে মাহমুদের গম্ভীর মুখের চামড়ার ভাঁজে সূক্ষ্ম সন্তুষ্টির ছাপ ফুটে ওঠে। দেশের চলমান পৈশাচিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ কাজ করছে এখন। সবাই ধর্ষণ রোধের মিছিল বা মিটিংয়ে পথে না নামলেও যে পরিমাণ তরুণ প্রজন্ম নেমে এসেছে, সেটিও কম নয়। এখন এই মানুষগুলোকে সংঘবদ্ধ করে আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। তাই এখন ওর আর ওর দলের অনেক কাজ, মানুষদের পথে আটকে রাখতে হবে, আন্দোলন জোরদার করতে হবে। মানুষ যত পথে নেমে আসবে, যত স্লোগান তুলবে, যত পুলিশের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে সামনে এগোবে তত মাহমুদরা নিজের আধিপত্য বিস্তারের দিকে গুটি গুটি এগিয়ে যাবে। কোনো প্রচলিত রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও, এই আন্দোলন, মিছিল মিটিং করে কম পথ তো পাড়ি দেওয়া হলো না! প্রথমে মনে হয়েছিল, সরকারের বিরুদ্ধে, আইনের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদে, প্রশাসনের স্বেচ্চাচারিতার বিরুদ্ধে, সমাজের নৈতিক স্খলনের প্রতিবাদে এই সব আন্দোলন করে কিছুই পাওয়া যাবে না; পুলিশের লাঠিপেটা আর হয়রানি ছাড়া।

শুরু সেই ২০১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি নিয়ে, শাহবাগে। যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ বিচার তো ওদের আন্দোলনের কারণে দ্রুত আর কার্যকর হয়েছিল। অবশ্য এক একটি যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির আনন্দ সংবাদের পর, ওদের খাসির বারবিকিউ পার্টি বা বিরিয়ানি সেলিব্রেট নিয়ে কিছু সুশীল মানুষের বিখাউজের চুলকানি উঠেছিল, ওসব ছিল ক্ষণকালীন। বিশাল আন্দোলনের পর কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি এলে পোলাপানরা যদি একটু আনন্দ না করে তাইলে কেমনে কী!—আপন মনে ভাবে মাহমুদ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি, ব্লগার হত্যার বিচারসহ আরও কত বিচারের দাবি নিয়ে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে ওরা রাস্তায় নেমেছে, সব আন্দোলন হয়তো সফল হয়নি, কিন্তু মাহমুদ নিজে সফল। এখন ও কোনো মিছিলের আয়োজন করলে কয়েক শ তরুণ-তরুণী শাহবাগে জড়ো হয়ে যায়, সংবাদপত্রে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধির স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রতীক হিসেবে ওর ওপর আর্টিক্যাল ছাপা হয়, মধ্য রাতের টক শোর নির্দলীয় হেভিওয়েট বক্তা হিসেবে দর্শকদের প্রথম সারির পছন্দ। দুই দিন আগে, দেশের চলমান সংকট এবং ধর্ষণ নিয়ে একটি ইন্টারন্যাশনাল টিভিতে ওর দীর্ঘ জুম সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছে। এত বড় কাভারেজের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ওর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে নিঃসন্দেহে, সেই সঙ্গে দেশের অনেকের ঈর্ষার ব্যক্তিতেও পরিণত হয়েছে। এই সব অর্জন মাহমুদকে ভেতরে ভেতরে ভালো আর দম্ভের শিহরণ আর তৃপ্তি বোধ দেয়।
আবার, আজ একটি পত্রিকায় ধর্ষণ রোধে সমাজ এবং রাষ্ট্রের করণীয় এবং দায়বদ্ধতা নিয়ে ওর লেখা একটি আর্টিক্যাল ছাপা হয়েছে। দেশের সচেতন নাগরিকরা তো বটে, প্রশাসনের লোকজন এবং সুশীল সমাজের টনকও নড়িয়ে দেওয়ার মতো হয়েছে লেখাটি। আর্টিক্যালের নিচে কমেন্ট বক্সে মন্তব্যের পর মন্তব্য আসছে, সেগুলো পড়তে পড়তে পরবর্তী আর্টিক্যালের খসড়া নিয়ে মনে মনে ভাবে মাহমুদ। 
এ সময় পাশে রাখা সেলফোনটি মৃদু শব্দে বেজে উঠলে হাতে নিয়ে দেখে মাহমুদ, কোনো নাম নয়; বেশ বড় নম্বর। সম্ভবত দেশের বাইরের। দ্বিধা না করেই ফোনটি রিসিভ করে মাহমুদ। 
হ্যালো, বলার পর ওপাশ থেকে কোনো প্রতিত্তোর শোনা যায় না। মাহমুদ আবার সফটলি হ্যালো বলে, আজকাল ওকে তো আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অনেকই ফোন করে, তেমন কোনো ফোনকল হয়তো। 
কেমন আছো মাহমুদ? এবার একটি নারী কণ্ঠ বেশ স্পষ্ট উচ্চারণে জানতে চায়। মাহমুদ কণ্ঠস্বরটি চিনতে পারে না, কিন্তু ওপাশের কণ্ঠস্বরে অন্য রকম কিছু একটা আছে, যা মাহমুদকে অস্বস্তি বোধ দেয়। তারপরও সে ভারী আর মৃদুকণ্ঠে আবার জানতে চায়, কে বলছেন? সরি চিনতে পারছি না...
স্বর্ণা...মনে আছে? তো?
স্বর্ণা! মাহমুদের মনে হয় ওর পা দুটি যেন কেঁপে উঠল। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোতে চায় না, তারপরও ফ্যাসফ্যাসে স্বরে জানতে চায়, তুমি? তুমি এত দিন পর?
এত দিন পর মানে? তুমি তো আমার কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে চেয়েছ, তাই এত দিন পর এই প্রশ্ন কেন? 
মানে?...এত দিন পর কী মনে করে?
তোমার সাথে আবার যোগাযোগ করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তারপরও করতে বাধ্য হলাম, তোমার ইন্টারভিউ দেখে।
অ...হুম...
তুমি যা বলেছ তা কি তুমি বিশ্বাস করো?
অবশ্যই করি।
লজ্জা ধর্ষকের, ধর্ষিতার নয়। তাই আমাদের উচিত নয়, ধর্ষিতার দিক আঙুল তোলা বা মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। তাদের মানসিক বিপন্নতায় আমাদের উচিত তাদের সঙ্গে মানবিক হওয়া। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তাদের আশ্বস্ত করা, তুমি অশূচি নও, বরং যে তোমাকে আঘাত করেছে তারা অসুর। প্রত্যেক নারীর ভেতর দুর্গা বাস করে, অসুর বধ করাই দুর্গার কাজ। নারী তুমি দুর্গা হয়ে অসুর বধ করে নিজের পথে এগিয়ে যাও। একঘেয়ে স্বরে কথাগুলো আউড়িয়ে যায় স্বর্ণা, যেন মুখস্থ কোনো লেখা পড়ে শোনাচ্ছিল সে।

মাহমুদের কপালে তখন পাতলা ঘামের প্রলেপ। সে ইতস্তত স্বরে বলে, এসব কেনো বলছ? এসব কথায় তো কোনো সমস্যা নেই...
অবশ্যই সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার মুখ দিয়ে যখন এই সব কথা বেরোয় তখন এসব কথা ফাঁকা বুলি আর প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি জানি, তুমি এসব কথার এক বিন্দুও হৃদয় থেকে অনুভব করো না। তুমি হলে হৃদয়হীন একজন ব্যক্তি। তারপরও এই সব আন্দোলন করছো শুধু নিজের পরিচিতির জন্য, তাই না? ধিক! ধিক তোমার ভাবনাকে!
শোনো স্বর্ণা...তখন আমার বয়স কম ছিল। আমি আসলে বুঝে উঠতেই পারিনি আমার কী করা উচিত ছিল। আমি জানি, তোমার পাশে না থেকে আমি ভয়ানক ভুল করেছিলাম।
ভুল! তোমার সে ভুল বাইশ বছর পরও ভাঙেনি, তাই না? এই বাইশ বছরে তুমি একবার আমার খোঁজ নিয়ে জানতে চেয়েছিলে, আমি কেমন আছি? আমার সঙ্গে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, তারপর একজন তরুণীর আত্মহত্যা করার কথা, ট্রমায় পড়ে যাবার কথা। সে সময় আমার একজন বন্ধুর খুব প্রয়োজন ছিল, অথচ সে সময় তুমি তোমার প্রেমিকার কাছ থেকে সটান সটকে পড়লে। একবারের জন্য ভাবলে না, আমি কি বেঁচে আছি না মরে গেছি।
সে সময়ে আমার অমন ব্যবহারের জন্য দুঃখিত...

যেসব তরুণ-তরুণীদের নিয়ে তোমাদের আন্দোলন গড়ে তুলছ, এরা কিন্তু তোমার সেই বয়সটার থেকেও অনেক ছোট। কিন্তু দেখ, কী দারুণ ওদের সাহস। কেমন স্ফুলিঙ্গ ওদের ভেতর! আমার কী মনে হয় জানো? ওরা কখনো বন্ধুর হাত ছাড়বে না। ওদের সেই স্ফুলিঙ্গ কাজে লাগিয়ে তুমি মাহমুদ এখন তরুণদের প্রতিনিধি। হিপোক্রেট! বয়সের দোহাই দাও। বয়স দিয়ে কী আসে যায়। বিষয়টা হলো, মানবিকতা বোধের, দায়িত্ব বোধের, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসার। বন্ধুর প্রতি বন্ধুর আস্থা আর বিশ্বাসের।
মাহমুদ কোনো কথা বলে না, স্বর্ণার কথাগুলো শুনতে শুনতে বাইশ বছর আগের এক বিকাল ওর মাথার মধ্যে ঝড় তোলে। এক কালো বিকালের কথা ওর মনে পড়ে যায়।
বাইশ বছর আগে, মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষে রেজাল্টের অপেক্ষার পাশাপাশি চাকরির চেষ্টাও করছিল। আর স্বর্ণা হোমইকোনমিকসে মাস্টার্সের ছাত্রী। দুজনের দুই বছরের প্রেমের সম্পর্ক। কী এক অজানা কারণে, সে বিকালে ওরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বাদ দিয়ে রিকশা করে চলে যায় বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে পার্কের কিছুটা ভেতরের দিকেই চলে যায়। তখনো বিকাল ফুরায়নি, একপশলা বৃষ্টির পর চারিদিকের মায়াবী আলোছায়া আর সতেজ সবুজ গাছগাছালি মুগ্ধতা আনে। ঠিক তেমন সময়টি হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে ওদের ঘিরে, চার-পাঁচজন ছেলে ওদের ঘিরে ধরে। কিছু বোঝার আগেই দেখতে পায়, ছেলেগুলোর হাতে চকচকে ছুরি-চাক্কু, একজনের হাতে আবার পিস্তল। পিস্তলটি সোজা মাহমুদের ঘাড়ে চেপে ধরে একজন বলে, ভাইয়া; আপনি একটু এইখানে বসেন। এ্যাই তোরা দুইজন ভাইরে নিয়া বস তো...

মাহমুদ কি ওদের কথা শুনে প্রতিবাদ করেছিল তখন? ঠিক মনে পড়ে না, তবে ওর গালে, পেটে পটাপট কয়েকটি চড় ঘুষি এসে পড়েছিল। ও নাকের রক্ত মুছতে মুছতে দেখেছিল, দুই-তিনজন ছেলে স্বর্ণাকে টেনেহিঁচড়ে পাশের বড় ঝোপের আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের আড়াল হওয়ার আগে স্বর্ণার বিবর্ণ আর বোবা মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনে প্রথমবার ভয়ানক অসহায় বোধ আর নিজের প্রতি ঘৃণা এসেছিল মাহমুদের।
স্বর্ণার সঙ্গে শেষ দেখা, ট্যাক্সি করে ওকে হোস্টেল গেটে নামিয়ে দেওয়ার সময়, মাহমুদ জানতে চেয়েছিল, ডাক্তারের কাছে যাবে কিনা? স্বর্ণা কোনো উত্তর না দিয়ে হোস্টেলে ঢুকে যায়।

মাহমুদ দুই দিন হোস্টেলে নিজের রুমে শুয়ে কাটায়। তারপর নিজের গ্রামের বাড়ি গিয়া টানা দুই মাস পার করে তারপর একটি স্কলারশিপ নিয়ে থাইল্যান্ড চলে যায়। গ্রামের বাড়িতে থাকার সময়টা সে একবারও স্বর্ণার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেনি, বরং স্বর্ণার সঙ্গে যেন কোনো যোগাযোগ না হয় সে ব্যাপারে ছিল সতর্ক, কমন বন্ধুদের পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়েছিল। দুই বছর পর দেশে ফিরেও কখনো স্বর্ণার খোঁজ করেনি, তবে দু-একজনের মাধ্যমে উড়োধুড়ো জেনেছিল, স্বর্ণা ইউরোপে চলে গিয়েছে, ব্যস; এটুকুই।

মাঝে এতটা বছর পার হয়ে গেছে, যদিও দুজন মুখোমুখি নয়, তারপরও যেন মাহমুদ আজ স্বর্ণার মুখোমুখি। মাহমুদের বোধ হয়, ও শুধু স্বর্ণার মুখোমুখি নয়, বরং ওর সঙ্গে আন্দোলন করে যারা, একপাল সবুজ আর আগ্নেয়গিরির স্ফুলিঙ্গের মতো তারুণ্য, ও ওদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। ওর শরীর থেকে মেকি সম্ভ্রম প্রাচীন প্রসাদের পলেস্তারার মতো খসে খসে পড়ছে। এত দিনের লুকিয়ে রাখা ভেতরের গোপন জীর্ণতা সবার সামনে উন্মোচিত। ওদের সবাইর চোখে ধিক্কার! স্বর্ণা এখনো কথা বলে যাচ্ছে, মাহমুদের কানে আর কিছুই ঢোকে না, লজ্জায় লীন হতে হতে ওর কানে একটি শব্দ ধাক্কা দিয়ে ওর বাকি অস্তিত্বকেও ভেঙেচুরে দেয়, ছিঃ!