• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২১, ০৪:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৫, ২০২১, ০৪:৩৯ পিএম

রোহনপুরের স্বাধীনতা

রোহনপুরের স্বাধীনতা

সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়েছে। নেমে এসেছে রাত। 
কৃষ্ণপক্ষের রাত। চারদিকে জমাট অন্ধকার। ঝিঁঝি পোকার চিৎকার। ব্যাঙের ডাক। শেয়ালের হাঁক। শীতের কনকনে হাওয়া। এসব কিছু অন্ধকারের রূপকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে। 
রফিক হাওলাদার। সবাই ডাকে রফিক মাঝি। মাঝিগিরি তার চৌদ্দ পুরুষের পেশা। তাই নামের শেষে আপনা-আপনিই ‘মাঝি’ শব্দটা যুক্ত হয়ে গেছে। তার ছেলের নামের শেষেও হবে হয়তো। তবে রফিক মাঝি ইদানীং ছেলেকে বলে—দ্যাশ স্বাধীন হইলে, স্বাধীন দ্যাশে তোরে আমি মাঝিগিরি করতে দিমু না। লেহাপড়া শিখ্যা তুই দ্যাশের জন্যি আরও ভালো কিছু করবি। 
রফিক মাঝি আর তার দশ-এগারো বছর বয়সের ছেলে শফি বসে আছে নৌকার দুই প্রান্তে। পেছনে রফিক মাঝির হাতে হাল, আর সামনে শফির হাতে বৈঠা। শফি বছরখানেক হলো খেয়া নৌকায় বাবাকে সাহায্য করছে। স্কুল থেকে ফিরে বিকেল থেকে কিছুটা রাত পর্যন্ত সে বাবার সাথে খেয়া নৌকায় বৈঠা চালায়। 
এখন যুদ্ধের দিন। স্কুল বন্ধ। কবে খুলবে, তা জানা নেই। জানা থাকত যদি নোটিশ দিয়ে বন্ধ হতো। আচানক গ্রামে খবর রটে গেল, পাকিস্তানি আর্মিরা আসছে স্কুলে ক্যাম্প করতে। গ্রামের যুবকেরা ছুটে পালাল। পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেল। বাবা-মা বয়সী মেয়েদের লুকিয়ে ফেলল। কেউ কেউ সপরিবার গ্রাম থেকে চলে গেল। স্কুলের শিক্ষকরা চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। স্কুল আর চলে? সবাই এখন এটাই জানে, দেশ স্বাধীন হলে স্কুল খুলবে। তবে দেশ কবে স্বাধীন হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। 
পাকিস্তানি আর্মিরা সত্যিই স্কুলে ক্যাম্প করল। আর যেসব মানুষ কোথাও না গিয়ে গ্রামেই অবস্থান করছিল, তারা সবাই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল, পাকিস্তানিরা মানুষ না। ওদের হিংস্র পশুর সাথে তুলনা করাও কম হয়ে যায়। 
অন্যদের মতো রফিক মাঝিও পরিবার নিয়ে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু পালাবার জায়গা নেই তার। তার আত্মীয়স্বজন খুব একটা নেই। দু-চারজন যা আছে, তারা এত গরিব যে, কাউকে দু-চার দিন খাওয়ানোর মতো সাধ্য তাদের নেই। তা ছাড়া সে না থাকলে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন নৌকাটাও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। 
সবদিক চিন্তা করে আর্মিদের হাতে-পায়ে ধরে, বউয়ের পালিত হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, বউয়ের লাগানো গাছের লাউ, ঝিঙা, শিম, বরবটি ইত্যাদি তাদেরকে দিয়ে, নিজেকে মিথ্যা পাকিস্তানভক্ত সাজিয়ে কোনোমতে গ্রামে টিকে আছে। দিন-রাত মনে মনে পশুগুলোকে অভিশাপ দেয়, তাদের ধ্বংস কামনা করে, আর সুযোগ খোঁজে স্বাধীনতার জন্য কিছু একটা করার।
নৌকার সামনে গলুইয়ের সাথে বাঁধা হারিকেনটা টিমটিম করে জ্বলছে। আলোটা বাতাসে কাঁপছে। পানিতে থরথর করে কাঁপছে তার প্রতিবিম্ব। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে শফিও কাঁপছে থিরথির করে। ডিসেম্বর মাস শুরু হওয়ার আগেই কিছুটা শীত নেমে এসেছে। নদীর মুক্ত বাতাসের কারণে নৌকায় শীতের মাত্রা বেশি। 
শফি বলল: আব্বা, চলো ফজা চাচার দোকান থিকা এক কাপ চা খাইয়া আসি। 
: এহন আর কী চা খামু? একটু পর তো চইলাই যামু। এই বলে রফিক মাঝি একটা বিড়ি ধরায়। 
শফির মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। এক কাপ চা খেতে তার খুব ইচ্ছা করছিল। সে দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। 
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ শফি সচকিত হয়ে বলে: আব্বা, দেখো, দুইটা নাও আসতেছে মনে হয়।
রফিক মাঝি ঝট করে তাকায় সামনে। হাতের বিড়ি ফেলে দেয়। দেখে দুটি খোলা নৌকা এগিয়ে আসছে। দুটি নৌকায় দুটি আলোর বিন্দু। হয়তো হারিকেনের আলো। 
শফি কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে: আবার আর্মি না তো?
: আর্মি হইলে সাথে হ্যাজাক বাতির আলো থাকতো, তিন-চার ব্যাটারির টর্চলাইট থাকতো। মনে হয় লোকজন কোনো দিকে পালায়া যাইতেছে। এহন তো খালি পালানোর সময়। এ-গ্রাম থিকা ও-গ্রাম। ও-গ্রাম থিকা এ-গ্রাম। 
ক্রমে নৌকা দুটি নিকটবর্তী হয়। নৌকা থেকে একজন বলে: ভয় পাবেন না। আমরা মুক্তিবাহিনীর ছেলে।
দুটি নৌকায় আটজন করে মোট ষোলোজন যুবক। তাদের কাছে রাইফেল, স্টেনগান, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি অস্ত্র দৃশ্যমান। এছাড়া আরও কিছু আছে নিশ্চয়। 
নৌকা যখন ঘাটের খুব কাছে চলে এল, একজন নিচু কণ্ঠে বলল: আমরা কমলডাঙার ব্রিজ আর নদী পারাপারের ফেরি উড়িয়ে দিতে এসেছি। এ দুটো কাজে সফল হলে এ অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়ে যাবে। আমরা এলাকাবাসীর সাহায্য চাই। 
রফিক মাঝির মন আনন্দে লফিয়ে উঠল। বুকের ভেতর অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য করার সুযোগ এসে গেছে। সে ছেলেকে নিয়ে নৌকা থেকে নামল। মুক্তিযোদ্ধাদের বলল: আসেন আমার সাথে, জান দিয়া সাহায্য করবো। 
মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অনুসরণ করে এগোতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে রফিক মাঝি বলল: ওই ফেরি আর বীরিজটা যদি না থাকতো তো আর্মিরা এই এলাকায় আসতেই পারতো না। ওই দুইটা উড়ায়া দেওয়া খুব দরকারি কাজ। 
রফিক মাঝি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গেল উঁচু রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে। চায়ের দোকানের মালিক ফজর আলী। ফজর আলী রফিক মাঝির বাল্যবন্ধু। দুজনের খুব ভাব, পরস্পরের প্রতি খুব টান। ফজর আলীর আর্থিক অবস্থা রফিক মাঝির চেয়ে কিছুটা ভালো। 
এতগুলো লোক দেখে ফজর আলী প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল। মুহূর্তে সে বুঝে ফেলে, এরা মুক্তিযোদ্ধা। আর তখনই আনন্দে নেচে ওঠে তার মন।
রফিক মাঝি বলল: দোস্ত, তারা কমলডাঙার বীরিজ আর ফেরি উড়ায়া দিতে আসছে। তারপরই এই অঞ্চল স্বাধীন হয়া যাইব। 
এ অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যাবে, এরকম কথা মুক্তিযোদ্ধারা বলেনি। রফিক মাঝি নিজের কথা এটা। এ কথা থেকেই বোঝা যায়, তাদের ভেতর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কত তীব্র! 
ফজর আলী বলল: গলা নামায়া কথা কও। রাইতের বেলা আস্তে কথাও জোরে শোনা যায়। 
ফজর আলী কিছুক্ষণ পর দোকান বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছিল। তাই দোকানের সামনের বেঞ্চিটা রেখে দুই পাশের বেঞ্চি তুলে ফেলেছিল। সে দোকানের ভেতর থেকে তড়িঘড়ি করে বেঞ্চি দুটি বের করে মুক্তিযোদ্ধাদের বসতে দিল। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসার পরও কয়েকজনের বসার জায়গা হলো না। ফজর আলী তাদের দোকানে ভেতরের খালি জায়গায় বসতে দিল। 
তারপর ফজর আলী চা বানিয়ে তাদের হাতে দিল, সাথে দিল বিস্কুট।
চা-বিস্কুট খেতে খেতে মুক্তিযোদ্ধা দলের কমান্ডার বলল: এই রাতটা আমাদের আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
রফিক মাঝি গা ঝাড়া দিয়ে বলল: আমার বাড়িতে থাকবেন। সমস্যা নাই কোনো। 
ফজর আলী বলল: তোমার বাড়িতে যে একটা ঘর! এতগুলা মানুষ ক্যামনে থাকবো? অর্ধেক আমার বাড়িতে থাকবো। রফিক মাঝি যেন একটু লজ্জা পেল। পুরো মুক্তিযোদ্ধা দলটাকে নিজের বাড়িতে না রাখতে পারার একটু কষ্টও মনে। 
কমান্ডার বলল: ভাগ হয়ে থাকলে আমাদের চলবে না। রাত শেষ হবার আগেই আমরা অপারেশনে বের হবো, তাই আমাদের একসাথে থাকতে হবে। আলোচনার ব্যাপার আছে। আর কাঁথা-বালিশ কিছুরই দরকার নেই। সবাই একসাথে বসতে পারলেই হলো।
রফিক মাঝি খুশি হলো। বলল: তায়লে আমার ঘরেই বসবেন। 
ফজর আলী বলল: তুমার ঘরে কি তাগোরে খাওয়ানোর মতো ব্যবস্থা আছে? 
: সেইটা আছে। তাগোরে খাওয়ানোর মতো চাইল-ডাইল আছে। 
কমান্ডার বলল: আমাদের খাবার নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। কোনো অপারেশনের আগে আমাদের মাথায় খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা থাকে না। 
মুক্তিযোদ্ধারা রফিক মাঝির বাড়ি গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে সুস্থির হয়ে বসল। আর তখনই রফিক মাঝির স্ত্রী পেঁয়াজ, মরিচ ও খাঁটি সরিষার তেলে মাখানো মুড়ি আর ধোঁয়া ওঠা চা দিয়ে গেল। খাবারটা দেখে মুক্তিযোদ্ধারা সত্যিই আনন্দিত হলো। 
চা পর্ব শেষ হলে শুরু হলো আলোচনা পর্ব। কখন এবং কীভাবে ব্রিজ আর ফেরি উড়িয়ে দেওয়া যাবে। ব্রিজে মিলিটারি থাকার কথা নয়। এ রকম ব্রিজ পাহারা দিতে ওরা সাধারণত রাজাকার রাখে। মাইন দিয়েই ব্রিজটা উড়িয়ে দেওয়া যাবে। হয়তো রাজাকারদের সাথে সামান্য গুলি বিনিময় হতে পারে। ব্রিজ ওড়াতে চারজন মুক্তিযোদ্ধাই যথেষ্ট। 
কিন্তু ফেরি ওড়ানোর কাজটা সহজ হবে না, যেহেতু সেখানে থাকবে মিলিটিারি। এ কাজে মোট বারোজনকে রাখতে হবে। আর আক্রমণ করতে হবে তিন ভাগে ভাগ হয়ে তিন দিক থেকে। প্রতি ভাগে থাকবে চারজন মুক্তিযোদ্ধা। মিলিটারিদের বিভ্রান্ত করার জন্যই এই ভাগ। অন্ধকারে তো ওরা বুঝতে পারবে না কোন দিকে কতজন মুক্তিযোদ্ধা আছে। তিন দিক থেকে গুলি চালালে ওরা ঘাবড়ে যাবে নিশ্চিত।
এ রকম আলোচনার মুহূর্তেই এলো ফজর আলী। সে কৈ আর মাগুর মাসের সালুন নিয়ে এসেছে। বলল: পুকুর থিকা ধরছিলাম। বউ আপনাগো জন্যি রাইন্ধা দিল। 
এদিকে বাড়ির ভেতর মুরগির ককর-ককর আর্তনাদও পাওয়া গিয়েছে। রফিক মাঝি বলল: বউয়ের সবগুলা মুরগি জবাই হইয়া গেছে। মুরগির সালুন আছে।
কমান্ডার বলল: আপনারা কি পাগল হয়েছেন? এত সব খাবার কে খাবে? 
রফিক মাঝি বলল: এগুলা থাকলে হারামি মিলিটারিগো পেটে যাইবো। আপনেগো খাওয়াইয়া দেই, মনে শান্তি পাব। 
পাশের বাড়ির বৃদ্ধা করিমন বেওয়া নিয়ে এসেছে গরম দুধ। সে কীভাবে জানতে পারল যে রফিক মাঝির বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা এসেছে তা বোঝা গেল না। 
মানুষের ভালোবাসা মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের আপ্লুত করে ফেলল। যুদ্ধের যাওয়ার পর থেকেই তারা মানুষের ভালোবাসা দেখে আসছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পেলে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে। এসব মানুষের হাতে স্বাধীনতার সূর্যটা এনে দিতেই হবে।
একপর্যায়ে রফিক মাঝি বলল: আমি আপনাগো সাথে অপারেশনে অংশ নিবার চাই।
কমান্ডার বলল: আপনার তো ট্রেনিং নেই। আপনি নিজেও বিপদে পড়বেন, আমাদেরও বিপদের সম্ভাবনা থাকবে। 
: আমার টেরনিং নাই তা ঠিক। তয় ওই ফেরিঘাট আর ব্রিরিজ এলাকা আমার খুবই ভাল কইরা চেনা। আমি আপনাগো সাথে থাকলে কোনো না কোনো দিক দিয়া সাহায্য করতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস। 
এর মধ্যে ফজর আলী বলল: আমিও যাইতে চাই আপনেগো সাথে। বিশ্বাস করেন, আমাগো সাথে রাখলে উপকার ছাড়া ক্ষতি কিছু হইবো না।
কমান্ডার তাকাল সহযোদ্ধাদের দিকে। সবার সম্মতি ছাড়া সম্পূর্ণ ট্রেনিংবিহীন কাউকে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে যুক্ত করা ঠিক হবে না। সহযোদ্ধারা বলল: মনে হয় তাদের নিলে ভালোই হবে। দিকনির্দেশনা তো দিতে পারবে। এলাকাটা তাদের চেনা।
সহযোদ্ধাদের সম্মতি পেয়ে কমান্ডার তাদের সাথে নিতে রাজি হলো। রফিক মাঝির ছেলে শফি বলল: আব্বা, আমিও যামু তুমার সাথে।
: যাবি? আইচ্ছা ল’ যাই। দেখবি যুদ্ধ কেমন। বড় হইয়া স্বাধীন দ্যাশে কইতে পারবি যে, একটা যুদ্ধ দেখছোস। 
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই থ’। কারও কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করে সে এতটুকু ছেলেকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিয়ে দিল। হায়রে স্বাধীনতা! হায়রে দেশ! সন্তানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা।
রফিক মাঝি, শফি আর ফজর আলী যুক্ত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা দলের সদস্য বেড়ে হলো উনিশজন। এখন সবাই-ই আলোচনায় অংশ নিতে পারে। রফিক মাঝি বলল: ফেরি আর বীরিজ নয় উড়ায়া দিলেন। তো আমাগো স্কুলের ক্যাম্প? তারা তো আমাগো ওপর অত্যাচার আরও বাড়ায়া দিব। 
কমান্ডার বলল: আমরা সব খবর নিয়ে এসেছি। আজ ক্যাম্পে তেমন কেউ থাকবে না। ফেরিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। ঊর্ধ্বতন অফিসার আসবে সেখানে। ফেরি উড়িয়ে দিতে পারলে ক্যাম্পে যে কয়জন মিলিটারি সদস্য থাকবে, তারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাবার পথ খোঁজা ছাড়া আর কিছুই করবে না। পালাতে গিয়ে গ্রামবাসীর হাতে মারা পড়াই তাদের নিয়তি হবে।
মাঝ রাতের কিছু পরে তারা রওনা হয়ে গেল ব্রিজ আর ফেরি ওড়ানোর উদ্দেশ্যে। 
ফেরিঘাট থেকে বেশ একটু দূরে সবাই অবস্থান নিল। আবছাভাবে ফেরিঘাট দেখা যায়, আর দেখা যায় কিছু বাতি। কমান্ডার বলল: আগে ফেরিটা রেকি করে আসতে হবে। 
সঙ্গে সঙ্গেই রফিক মাঝি বলে উঠলো: আমি যাই। 
: পারবেন? ওরা কিছু টের পেলে কিন্তু আপনিও মরবেন, আমরাও। আমাদের উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে। 
: কিছুই টের পাইব না। আমার ওপর ভরসা রাখেন। 
রফিক মাঝি ফেরি রেকি করে অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে আসে। সে সব খবরই খুব ভালোভাবে এনেছে। কতজন মিলিটারি আছে, কেমন তাদের অবস্থান, তাদের অস্ত্র-সস্ত্র সব। তারা নাকি মদ পান করছিল আর তাস খেলছিল। কয়েকজন ছিল বদ্ধ মাতাল। 

এবার কমান্ডারের চূড়ান্ত আক্রমণ পরিকল্পনা করার পালা। সিদ্ধান্ত হয়, ফেরি আর ব্রিজ একই সাথে ওড়ানো হবে। একই সময়ে হবে দুটি আক্রমণ।
ব্রিজ পাহারায় ছিল মাত্র কয়েকজন রাজাকার। তাই একজনকে নেতৃত্ব দিয়ে চারজনের একটি দল পাঠানো হয় সেখানে। তারা মাইন নিয়ে চলে যায়।
এদিকে থাকে বারোজন মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের সাথে ফজর আলী, রফিক মাঝি ও তার ছেলে শফি-মোট পনেরোজন। কমান্ডার পাঁচজন করে তিন ভাগে ভাগ করে। সফিকে নেয় কমান্ডারের দলে। বলে: তুমি আমার বাঁ পাশে একটু পেছনে থাকবে। তোমার দায়িত্ব চারদিকে নজর রাখা। কোনো দিক থেকে অতর্কিত কেউ এগিয়ে আসছে কি না, তা লক্ষ রাখবে। 
শফি দৃঢ় কণ্ঠে বলে: ঠিক আছে। 
শফির মনে খুব আনন্দ। ঠিক কমান্ডারের পাশে থেকে এ রকম একটা যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারবে, এবং তাতে তার ওপর কিছু দায়িত্বও থাকবে, এটা তো সে কল্পনা করতে পারেনি। 
প্লান হলো, একটা গ্রুপ গুলি করতে করতে এগিয়ে গিয়ে ফেরি দখলে নেবে। কমান্ডারের গ্রুপ পেছনে থেকে তাদেরকে প্রটেক্ট করবে। আরেকটা গ্রুপ অন্য পাশ থেকে গুলি করতে করতে ফেরির কাছে চলে যাবে। সেখান থেকে দুজন গিয়ে ফেরিতে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ফেরি উড়িয়ে দেবে। অপারেশন শুরু হবে কমান্ডারের ফায়ার ওপেন করার সাথে সাথে। 
রাত শেষ প্রহর। এগিয়ে যাচ্ছে ভোরের দিকে। শেষ প্রহরের শীতল বাতাস বইছে। চারদিকে ভৌতিক নীরবতা। 
কমান্ডার ছোট টর্চ জ্বালিয়ে বাঁ হাতের ঘড়ি দেখল। ঘড়ির কাঁটা তিনটা অতিক্রান্ত। ঠিক তখন কমান্ডার ফায়ার ওপেন করল। সঙ্গে সঙ্গেই ফেরি থেকে পাল্টা গুলির শব্দ আসে। কমান্ডার গুলি চালিয়ে তিন দিক থেকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। 
প্রায় দুই ঘণ্টা উভয় পক্ষের গুলি চলে। মিলিটারিদের গুলি ছিল সবই এলোমেলো। কারণ, তারা বুঝতেই পারেনি মুক্তিযোদ্ধারা কতজন, কোথায়, কোন দিকে আছে। 
পাঁচটার কিছু আগে ফেরি থেকে আর কোনো গুলির শব্দ আসে না। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটা গ্রুপ থমকে যায়। ওদের গুলি কি সব শেষ হয়ে গেছে? নাকি ওরা আক্রমণের ধরন পাল্টে ফেলল? 
কমান্ডারের দলের একজন খুব সাবধানে ফেরির দিকে এগোতে থাকে। অন্যরা তার পেছনে তাকে প্রটেক্ট করে এগোয়। 
ফেরির খুব কাছে গিয়ে তারা দেখে ১০-১২ জন মিলিটারি মরে পড়ে আছে। যে কয়জন বেঁচে ছিল তারাও মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে। সবাই তখন আকাশ কাঁপিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ওঠে। তিনটি গ্রুপই তখন ফেরির কাছে চলে এসেছে। সবাই উঠে যায় ফেরিতে। দুজন মুক্তিযোদ্ধা এক্সপ্লোসিভ লাগাতে শুরু করে। আর তখনই যারা ব্রীজ ওড়াতে গিয়েছিল তারা ফিরে আসে। জানায়, সফলভাবে ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। আবার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।
এক্সপ্লোসিভ লাগানো শেষ হলে সবাই ফেরি থেকে নেমে এলো। ফেরি থেকে নেমে আসার অল্প কিছু পরেই বিকট শব্দে চমকে উঠল আশপাশের গ্রামের ভোরের সুখনিদ্রারত মানুষ। কোথায় কী ঘটেছে তারা তা অনুমান করতে পারল না। তাদের হৃদয় কম্পমান।
বিশাল ফেরিটা শুকনো পাতার মতো উড়ে গেল। 
শফিকে মাথায় তুলে নেয় কমান্ডার। আনন্দ-উল্লাস এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে তারা ফিরে আসে তাদের নৌকায়। রফিক মাঝি, ফজর আলী, আর শফির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নৌকায় উঠে যায়। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাদের এ অঞ্চল ত্যাগ করতে হবে। সকালেই পৌঁছুতে হবে নিজেদের ক্যাম্পে। 
ভোরের আলো ফুটতেই উঁচু রাস্তার দুই পাশের বাড়িঘরের মানুষ শুনতে পায় একটা কিশোর কণ্ঠ অবিরত স্লোগান দিয়ে চলেছে: জয় বাংলা।
কেউ কেউ বাইরে বের হয়। দেখে, রাস্তা দিয়ে রফিক মাঝির ছেলে শফি দৌড়াচ্ছে আর স্লোগান দিচ্ছে ‘জয় বাংলা।’ তার হাতে লাঠির মাথায় বাঁধা বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। 
পতাকাটা তাকে দিয়েছে ফজর আলী। সে তার দোকানে পতাকাটা লুকিয়ে রেখেছিল অনেক দিন আগে থেকেই। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাবার পর ফজর আলী দোকান খুলে শফির হাতে পতাকাটা দিয়ে দেয় আর বলে: যাও, উড়ায়া দ্যাও মনের সুখে।
বাইরে আসা লোকদের কেউ কেউ বলে: এই, কী হইছে? মরবা তো গুলি খাইয়া। 
: আর মরণের ভয় নাই। আমাগো রোহনপুর স্বাধীন হয়া গেছে।
: রোহনপুর স্বাধীন...!
: হ, দেহেন গিয়া, স্কুলের ক্যাম্প ফালায়া আর্মিরা পালাইছে। ফেরি আর বীরিজ শ্যাষ। জয় বাংলা।
: জয় বাংলা। অনেক কণ্ঠ যোগ হয় শফির কণ্ঠের সাথে।