• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২১, ০৪:১২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২২, ২০২১, ০৬:৩৯ পিএম

শঙ্খ ঘোষ : অন্যায়ের বিপরীতে এক শান্ত প্রতিস্পর্ধা

শঙ্খ ঘোষ : অন্যায়ের বিপরীতে এক শান্ত প্রতিস্পর্ধা

কবি অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত তাঁর দীর্ঘদিনের নিবিড় বন্ধু কবি শঙ্খ ঘোষের (১৯৩২-২০২১) শতশরতের আয়ু চেয়েছিলেন। তাঁর ‘আমার বন্ধু’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘আজ দিনান্তে যুগের দুঃসময়ে/ প্রার্থনা রাখি: থাকুন পাশের সাথী/ আমার বন্ধু শরৎ শতায়ু হয়ে।’ কিন্তু নব্বইয়ে পা রাখার দু’মাস পরে আমাদের আরো নিঃস্ব করে চলে গেলেন শঙ্খ ঘোষ। প্রসঙ্গত, পাঁচ মাস আগে প্রয়াত হয়েছেন অলোকরঞ্জনও।

বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই শুধু নয়, বাঙালি জাতির জীবনে এ এক ঘোর দুঃসময়। সেই কৈশোর অতিক্রান্ত সময়ের পর, যখন থেকে শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়তে শুরু করেছি এবং পরে কিছুটা বুঝতেও শিখেছি, তখন থেকেই জেনেছি রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও অন্যায়ের বিপরীতে এক শান্ত প্রতিস্পর্ধার নাম শঙ্খ ঘোষ।

মানুষটি যেমন নিচু স্বরে কথা বলতেন, তাঁর কবিতার ভঙ্গিটিও আপাতভাবেই অনেকটা সে রকম। কিন্তু এই শান্ত উচ্চারণের মধ্যে যে বিপুল দাঢ্য তা চমকে দিত পাঠকদের। চল্লিশের দশকের বাংলা কবিতায় একটি সাম্যবাদী রাজনৈতিক ধারা যেমন স্পষ্ট ছিল, তেমনই ছিল রোমান্টিক জীবনবোধের কবিতায় আর একটি ধারা। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় এ দুটি ধারার এক অনবদ্য মিশ্রণ ঘটেছিল, খুব গভীর অনুচ্চকিত ভঙ্গিতে। কোনো দলীয় রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও তিনি ছিলেন এক প্রবল রাজনৈতিক কবি ব্যক্তিত্ব।

আর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার তাঁর কবিতার কারণে বিড়ম্বনায় পড়েছে। পণ্যায়নের বিকার যখন আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও গাঢ় ছায়া বিস্তার করছে, গ্রাস করছে আমাদের সমাজজীবনকে, তখন তিনিই লেখেন ‘বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া/ তোমার সাথে ওতপ্রোত/নিয়ন আলোয় পণ্য হলো/ যা কিছু আজ ব্যক্তিগত।’ তিনিই দেখিয়েছেন আমাদের মুখ কীভাবে বিজ্ঞাপনে ঢেকে যায়।

চারপাশে কত কিছুই তো লেখা হয়, কিন্তু কালের বিচারে সব তো টিকে থাকে না। শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘ব্যর্থতার এই বিপুল প্রবাহের মধ্যে অল্প কয়েকজনই হয়ত খুঁজে পান তাঁদের নিজস্ব স্বর, অনেকের মনে অনেক দিনের জন্য তাঁরা চিহ্নিত করে দিতে পারেন সেই স্বর।’ শঙ্খ ঘোষের প্রতিটি লেখার মধ্যে তিনি তাঁর নিজস্ব স্বরকে চিহ্নিত করে গেছেন। তাঁর প্রায় সব কবিতাই দেশ, সমাজ এবং গণমানুষকে নিয়ে। ১৯৫১ সালে কোচবিহারে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল ষোলো বছরের এক কিশোরী। সেই ঘটনা নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা ‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে’- পৌঁছে গেছে কিংবদন্তির পর্যায়ে।

প্রতিবাদের এই ধারা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন তাঁর ব্যক্তিজীবনেও। নব্বই দশকের গোড়া থেকে তাঁর মনে আলাপ-আলোচনার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী সময়ে ওই দিনটিতে ‘ধ্বংসস্তূপে আলো’ নামে কবি সম্মেলনের আয়োজন করত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। তিনি তখন বাংলা আকাদেমির সহসভাপতি।

২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার পরে হাজরা মোড় থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত বিশাল মিছিল তাঁর সাথে পথ হেঁটেছিলাম আমিও। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি বাংলা আকাদেমির সহসভাপতির পদ ত্যাগ করেন। তিনিই আবার কামদুনি কাণ্ডের প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিশাল মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন।

প্রমোটার রাজ থেকে হাল আমলের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘটনাবলিও উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অন্যায্য উক্তিকেও তিনি আশ্চর্য কুশলতায় স্যাটায়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। সেসব পঙ্‌ক্তি মুখে মুখে ঘুরেছে আর বিড়ম্বিত হয়েছে, ক্রুদ্ধও হয়েছে শাসকশ্রেণি। কিন্তু তাতে তিনি বিচলিত বোধ করেননি।

যেকোনো হিংসাত্মক ঘটনার প্রতিবাদ সভায় অথবা পদযাত্রায় তাঁর উপস্থিতি সব সময়ই উদ্বুদ্ধ করেছে বাঙালি সমাজের অধিকাংশ মানুষকে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে আসানসোল এলাকায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে শান্তি ও সম্প্রীতির মিছিলে তিনি বেশ কিছুটা হেঁটেছিলেন অসুস্থ শরীরেই। বটতলা থেকে আকাদেমি অব ফাইন আর্টস পর্যন্ত সেই সুদীর্ঘ মিছিলে তাঁকে পাশ থেকে দেখেছিলাম। অসুস্থ শরীর তবু কি প্রবল মনের জোর!

২০১৯ সালে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে লেখা তাঁর একটি কবিতা ‘মাটি’ সমাজমাধ্যমে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ওই কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘এখনও পরীক্ষা চায় আগুন সমাজ/ এ-মাটি আমারও মাটি/ সেকথা সবার সামনে কীভাবে/ প্রমাণ করব আজ।’

২০১২ সালে আমার দাদা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে আমরা ‘সিরাজ অ্যাকাদেমি’র পক্ষ থেকে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের পুরস্কার প্রদান করে আসছি ২০১৩ সাল থেকে। সেই অনুষ্ঠানে প্রতিবছর তিনিই ‘সিরাজ অ্যাকাদেমি’ পুরস্কার তুলে দিয়েছেন পুরস্কার প্রাপক সাহিত্যিকদের হাতে। এ ব্যাপারে তাঁর দায়িত্ববোধে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। গত এক বছর করোনার আবহে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। তিনিও শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন না। সম্প্রতি তাঁর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সংবাদে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ২১ এপ্রিল, তিনি এই ‘যুগের দুঃসময়ে’ বাঙালি জীবনে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করে চলে গেলেন।

‘আগ্নেয় জীবনযাপনের বিভীষিকার সামনে’ তিনি নিজের ভিতর ও বাহিরকে খুলে দিতে পেরেছিলেন তাঁর অস্তিস্ত্বের পরম যোগ্যতায়, তাঁর কবিতায়। সেই জন্যই তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘আমার মৃত্যুরও নেই আমার জন্মেরও নেই শেষ।’ তিনি অশেষ করে গেলেন আমাদের কবিতাভুবনকে, আজ শুধু মনে পড়ছে তাঁরই পঙ্‌ক্তিমালা: ‘তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু/ শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া/ তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু/ বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া/ দেওয়া ছাড়া/ তোমার কোনো ধর্ম নেই,/এই শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।’