• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২, ২০২১, ০৯:২৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২, ২০২১, ১০:১৮ এএম

সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তি প্রসঙ্গে

সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তি প্রসঙ্গে

বাংলা চলচ্চিত্র স্রষ্টাদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় অন্যতম। বহুকাল যাবৎ বাঙালি দর্শক যাকে ‘বই’ বা ‘ছবি’ বলে এসেছেন, সত্যজিৎ তাকে ‘চলচ্চিত্র’ তথা দৃশ্যশব্দময় কারুকলায় পরিণত করেছেন। চলচ্চিত্রকলার নিজস্ব ভাষায় আখ্যানকে দেখিয়ে-শুনিয়ে সাহিত্যের চাটুবৃত্তি না করে দৃশ্য ও শব্দখণ্ডের প্রবাহ দিয়ে সত্যজিৎ চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে চিত্র-সংগীত-সাহিত্যবোধ তাঁকে প্রয়োজনীয় খোরাক জুগিয়েছে। চলচ্চিত্র সৃষ্টি করে তিনি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রকে শিল্পকর্মে উন্নীত করেননি, এর পরিধি বাড়িয়ে বিশ্বজনীনও করেছেন। তাঁর এই চলচ্চিত্র স্রষ্টাবৃত্তির নানা দিক চিহ্নিত করার জন্যই উদ্যোগই বর্তমান প্রবন্ধে নেওয়া হয়েছে।

ঋত্বিক ঘটকের বিবেচনায় ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) সত্যজিৎ রায়কে ‘নবযুগের স্রষ্টার আসনে বসিয়ে দিল, যে আসন থেকে ওঁকে সরাতে কোনো দিনই কেউ পারবে না।’ ঋত্বিক লিখেছেন ‘বিশেষ একটা কিছু না থাকলে জাতশিল্পী হওয়া যায় না, যা সত্যজিতের মধ্যে ছিল।’ সংকলনভুক্ত রচনাগুচ্ছে লেখকগণ এই ‘বিশেষ একটা কিছু’-র সন্ধান করেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যজিতের জীবনদর্শন, বিশ্ববীক্ষা, চলচ্চিত্রনির্মাণ ভাবনা, চলচ্চিত্রকর্মের কারুকৃতি, সমাজভাবনা প্রভৃতি বীক্ষণপূর্বক।

সত্যজিৎ রায় তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমগ্রেই তাঁর বিশ্ববীক্ষার আলামতগুলো রেখে গেছেন। পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সত্যজিৎ রায়ের বিশ্ববীক্ষা’ শীর্ষক রচনায় লিখেছেন যে ‘সত্যজিতের বিশ্ববীক্ষা বাস্তববাদীর—যে বাস্তববাদী শিল্প ও জীবনকে বাঁধতে চান সমাজ ইতিহাসের সামগ্রিকতায়।’ সত্যজিৎ পশ্চিমা বিশ্বের উনিশ শতকের উদার মানবিক মূল্যবোধের দ্বারা নিজের জীবনদর্শনকে পরিপুষ্ট করলেও বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণিজাত মানসিকতাকে পরিহার করেননি বলে পার্থপ্রতিমের অভিমত। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও তাঁর রচনায় সত্যজিৎ রায় যে শুধু উদার মানবতাবাদী চলচ্চিত্রকারই নন এ-সত্য বিধৃত করেছেন। বুদ্ধদেবের মতে সত্যজিৎ খুব চড়া সুরে তাঁর চলচ্চিত্রে রাজনীতিকে, দ্রোহচেতনাকে না বাঁধলেও সমাজের নানা প্রজ্বলন্ত সমস্যা যেমন বেকারত্ব, যুব-বিক্ষোভ, মূল্যবোধের অবক্ষয়, দারিদ্র্যের কারণ ইত্যাদিকে সম্মুখবর্তী করেছেন। এমনকি ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদ ও উদীয়মান ধনতন্ত্রের মধ্যকার সংঘাত, মানুষের নীরব ক্রোধ ও নিরুক্ত প্রতিবাদও সত্যজিতের চলচ্চিত্রে স্থান করে নিয়েছে বলে লেখকের ধারণা। আসলে সত্যজিতের সমাজচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, বুদ্ধদেবের মতে, সূক্ষ্ম কারুকাজে ফ্রেমিং, কম্পোজিশন, শট গ্রহণ, সাউন্ড মন্তাজ, সিচুয়েশন নির্মাণ প্রভৃতি অনুষঙ্গে। 

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ‘আধুনিক’ চিন্তা-চেতনা কীভাবে সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্রে রোপণ করেছেন, ধ্রুব গুপ্ত তা ‘আধুনিকতা ও সত্যজিৎ রায়’ নামক রচনায় ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, ‘সত্যজিৎ রায়ের আধুনিকত্বে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণ-সহাবস্থান ব্যাপক এবং তা ইতিহাসমিশ্রিত, তাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার রয়েছে।’ সত্যজিৎকে অনেকে প্রতিক্রিয়াশীল চলচ্চিত্রকার ভাবেন, লেখক এই ভাবনাকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে নাকচ করেছেন। সত্যজিতের নারী ও পুরুষ চরিত্রগুলো যে আধুনিক জ্ঞানভাষ্যের আলোকে নির্মিত, সে-সত্য উদ্ঘাটনের জন্য লেখক উত্তর-আধুনিক শিল্পতত্ত্বের সাহায্যে সত্যজিতের চলচ্চিত্রসমগ্র পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। বস্তুত ব্রাহ্মসমাজের পরিভাবনা ও ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাব সত্যজিৎমানসে পড়েছিল বলেই তিনি ‘আধুনিকত্বে’ আস্থা আনতে পেরেছিলেন। 

অমর্ত্য সেনও তাঁর এক রচনায় সত্যজিৎ যে নিজ ভূখণ্ডের সমাজবাস্তবতাকে নিজস্ব ধরনে উপস্থাপন করতেন সে-প্রসঙ্গ এনেছেন। এই উপস্থাপন বা ‘চিত্রিত’ করার প্রক্রিয়ায় সত্যজিৎ ‘নিজস্ব সংস্কৃতির পটভূমির গুরুত্বকে সম্পূর্ণ স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্য স্থান থেকে যা কিছু শিক্ষণীয় তাকেও অস্বীকার করেননি’ বলে অমর্ত্য সেন মনে করেন। অনেকে অবশ্য সত্যজিৎ রায়কে শুধুই ভারতীয় রেনেসাঁসের ফসল বলে মনে করেন। উৎপল দত্ত তাঁর এক রচনায় এই বিবেচনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন যে সত্যজিৎ ভারতীয় নয়, বরং ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ফসল। উৎপলের মতে, ভারতীয় রেনেসাঁস বলতে বস্তুত তেমন কিছুই দানা বাঁধেনি; ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মধ্যে ‘ঈশ্বর’-এর চেয়ে ‘মানুষ’-কে বড় করে দেখানোর যে মৌল প্রবণতা দৃষ্ট হয়, সত্যজিৎ তাকেই তাঁর চলচ্চিত্রকর্মে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। ইউরোপীয় রেনেসাঁসে ব্যক্তিমানুষ অধিক গুরুত্ব পেয়েছিল। সত্যজিতের চলচ্চিত্রেও ব্যক্তিমানুষ, তাঁদের জীবনচর্যা, জীবনের প্রবহমানতা ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার নজির বিদ্যমান। ব্যক্তিমানুষ তথা একলা মানুষ, পারিবারিক মানুষ, সামাজিক মানুষ—সব মানুষের নির্জন একাকিত্ব তাঁকে টেনেছে বেশি। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক ব্যবস্থার মানবিক দিকগুলো ও তাঁদের মধ্যকার টানাপোড়েনগুলোর উপস্থিতি তাই সত্যজিতের চলচ্চিত্রত্রয়ী (পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার) ও অন্যান্য চলচ্চিত্রে প্রবল। 

ব্যক্তিমানুষ যে সত্যজিতের প্রায় সকল চলচ্চিত্রের গর্ভফুল ফুটিয়েছে তা গৌতম ভদ্র রচিত ‘সত্যজিৎ-চলচ্চিত্রে কালচেতনা’ শীর্ষক লেখায় স্পষ্ট। গৌতমের মতে ‘সত্যজিৎ রায় সময়কে দেখেন ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ দিয়ে, শ্রেণির দৃষ্টিকোণ দিয়ে নয়, তাঁর গোটা চরিত্রগুলোই নিছক ব্যক্তিমানুষ।’ সত্যজিতের চলচ্চিত্রে কীভাবে কালচেতনা ব্যক্তি ট্র্যাজেডির ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়; শ্রেণি-সংকট উহ্য থাকে কাহিনী-পরিসরে, নিম্নবর্গের মানুষেরা উপেক্ষিত থেকে যায় মীর ও মীর্জাদের কাছে; থেকে যায় সত্তর দশকের পশ্চিম বাংলার রক্তাক্ত ও গভীর রাজনৈতিক সংকট ব্যক্তি ও পারিবারিক কাহিনীর অন্তরালে—গৌতম তার খতিয়ান হাজির করেছেন সত্যজিতের গুটিকয় চলচ্চিত্রবীক্ষণ পূর্বক। প্রলয় শূরও তাঁর রচনা ‘চলচ্চিত্রে কালের কণ্ঠস্বর’-এ সত্যজিতের নিজ সময় ও সমাজের কণ্ঠস্বর তাঁর চলচ্চিত্রে কীভাবে ধ্বনিত হয়েছে, সে প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন।

রবিন ঘোষ সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে সত্যজিৎ সর্বদাই সমাজসংলগ্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে উৎসাহী ছিলেন। তবে যতটা না সমাজ এসেছে, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিমানুষের প্রাধান্য লক্ষ করেছেন লেখক। লেখকের মতে, সত্যজিৎ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যেমন কাজ করেছেন তেমনি মানবিক সংকটও তাঁর সৃষ্টির বিষয় হয়েছে। মানুষই হচ্ছে তাঁর সৃষ্টির প্রেরণাস্থল। এই মানুষকে সত্যজিৎ আহরণ করেছেন প্রধানত সাহিত্যকর্ম থেকে। বাংলা চলচ্চিত্র শুরু থেকেই সাহিত্য তথা গল্প-উপন্যাসনির্ভর। সত্যজিৎ রায়ও তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বরাবরই সাহিত্যের দিকে ঝুঁকেছেন, যদিও কয়েকটি চলচ্চিত্রের কাহিনী তাঁর নিজের এবং কয়েকটি তাঁর পিতা-পিতামহ লিখিত। সত্যজিৎ কেন বারবার সাহিত্যের কাছে ফিরে গেছেন, ঐসব গল্প-উপন্যাস নির্বাচনের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়, সে-সব বিষয়ে শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য ও চলচ্চিত্র : প্রসঙ্গ ‘সত্যজিৎ রায়’ শীর্ষক নিবন্ধে আলোচনা করেছেন। এই নিবন্ধ থেকে সাহিত্যের সাথে চলচ্চিত্রের আন্তঃসম্পর্কের গূঢ় রহস্যটিও অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন পাঠক। সত্যজিৎ রায় সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র, দুই মাধ্যমেই কাজ করেছেন। তাঁর এই দুই মাধ্যমের কাজে ন্যারেটিভের প্রাধান্য কী মাত্রায় উপস্থিত ধীমান দাশগুপ্ত তাঁর রচনায় সে-সব তথ্য হাজির করেছেন। বিশেষ করে চলচ্চিত্র মাধ্যমে পরিবাহিত চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়সমূহ উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করেছেন। সত্যজিৎ জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় সাহিত্যের ন্যারেটিভকে কেন কখনো কখনো বদলে নিতেন সে-কথাও বলেছেন লেখক। ধীমানের অভিমত এই যে ‘সিনেমায় ন্যারেটিভ কাঠামোকে পুরোপুরি গ্রহণ না করলে চলচ্চিত্রে তাঁর প্রতিভার সাফল্য আরও ব্যাপক হতে পারত।’

সত্যজিৎ সাহিত্যকর্ম থেকে কাহিনী গ্রহণের সময় কিছুটা গ্রহণ করতেন, কিছুটা বর্জন করতেন এবং প্রয়োজনে নিজে কিছুটা সংযোজনও করতেন। চলচ্চিত্রে সাহিত্যকর্মকে পরিবহনের সময় এই কাজটি করতেই হয়; কারণ, সাহিত্যের উপকরণ আর চলচ্চিত্রের উপকরণ এক নয়, ন্যারেটিভ নির্মাণের ধরনও এক নয়। সত্যজিৎ বহু বিখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনা নিয়ে চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে একজন। চিদানন্দ দাশগুপ্ত ‘সত্যজিৎ ও রবীন্দ্রনাথ’ নামক রচনায় বেশ কটি বিষয়ে কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট সাহিত্যকর্মে সমস্ত বিপর্যয়ের পরেও জীবন সচল রাখার যে মানববাদী দর্শন প্রতিফলিত তার সাথে সত্যজিৎ কতটা সহমত পোষণ করেছেন; সমাজবাস্তবতার ওপরের স্তরের কাহিনী পরিসরের চেয়ে চরিত্রের, বিশেষ করে নারী চরিত্রের মনস্তত্ত্বের উপস্থাপনায় কতটা মগ্ন ছিলেন; কতটা সমকালীন বাস্তবতাকে এড়িয়ে গেছেন; কেন রবীন্দ্রোত্তর জ্ঞানজগতে প্রবেশে অনাগ্রহী ছিলেন, এসব প্রসঙ্গের বিস্তার ঘটিয়েছেন চিদানন্দ। তাঁর মতে সত্যজিৎ ‘রবীন্দ্রনাথ-প্রভাবিত সুদীর্ঘ কালটিতে মধ্যবিত্ত সমাজের ক্রমবিকাশের ধারাটিকে চিত্রায়িত করেছেন।’ রবীন্দ্র-দর্শনের বলয়ের বাইরে সত্যজিৎ কেন যেতে পারেননি; ‘ঘরে-বাইরে’ (১৯৮৪) উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ দিতে গিয়ে সত্যজিৎ কেন রবীন্দ্র-দর্শন হুবহু অনুসরণ করেছেন, লেখক সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সে-সবের স্বরূপ নির্ণয় করেছেন।

আমরা জানি যে সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের বেশ কটি গল্প-উপন্যাস বেছে নিয়েছিলেন। তারেক মাসুদ সেসব গল্প-উপন্যাসে নারী সম্পর্কে এবং গল্প-উপন্যাসের শেষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যে ভাবনা, তার সাথে সত্যজিৎকৃত চলচ্চিত্রের পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তারেকের বিচারের সাথে চিদানন্দের বিচারের একটা পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তারেকের মতে রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসে নারী চরিত্রের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক যে উত্তরণ দেখা যায়, তা সত্যজিতের চলচ্চিত্রে নেই। রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী নারীরা যেন সত্যজিতের চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত। তারেকের বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শন সত্যজিৎকে টানেনি, টেনেছে তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনী-কাঠামো। একার্থে তারেক বর্তমান রচনায় সত্যজিতের জীবন-দর্শন অন্বেষণ করার চেষ্টা করেছেন। পল্লব সেনগুপ্তও তাঁর রচনায় রবীন্দ্র-সত্যজিতের যুগলবন্দীর স্বরূপ সন্ধান করেছেন। পল্লবের রচনার মুখ্য বিষয় হচ্ছে সত্যজিৎ যখন রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছেন তখন কতটা গ্রহণ আর কতটা বর্জন করেছেন, কতটা রবীন্দ্রনাথের আর কতটা নিজের ব্যাখ্যা স্থান পেয়েছে। এক্ষেত্রে লেখক জানান যে অনেক ক্ষেত্রে সত্যজিৎ নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, কাহিনীর মূল চেহারাটা ঠিক রেখেই। সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের চলচ্চিত্র নির্মাণভাবনার কাছাকাছি থেকেই চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন: রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘দৃশ্যের গতিপ্রবাহ’ দিয়ে চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে সত্যজিৎ ‘সুরের চলৎপ্রবাহ’-এর সাহায্য নিয়েছেন বলে আমিতাভ চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে জানান। তাঁর মতে, ‘চলচ্চিত্রের অন্তরায়িত সাংগীতিক কাঠামোর ব্যাপারে সত্যজিৎ ইউরোপীয় মার্গ সংগীতের কাঠামো অনুসরণ করেছেন।

সত্যজিতের ‘অপুত্রয়ী’ কাহিনীর ধারাবাহিকতার দিক থেকে ত্রয়ী হয়ে উঠেছে। এই ত্রয়ী চলচ্চিত্রের প্রথমটি হচ্ছে ‘পথের পাঁচালী’, যা সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তির প্রথম নিদর্শন। অপুত্রয়ীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় চলচ্চিত্রটি হচ্ছে যথাক্রমে ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’। চিদানন্দ দাশগুপ্ত অপুত্রয়ীর আধেয় ও আধার উভয় দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। চলচ্চিত্রকলা ও সাহিত্যকর্মের পার্থক্য চিদানন্দের জানা আছে বলে তিনি অপুত্রয়ীকে উপন্যাস থেকে স্বতন্ত্র একটি শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করেই তাঁর বীক্ষণকর্ম সম্পাদন করেছেন। তাঁর মতে ‘বিভূতিভূষণের বাস্তবতা একটি অতিসূক্ষ্ম আবরণে ঢাকা; অতি সন্তর্পণে সত্যজিৎ সেই আবরণটি তুলে নিয়েছেন। ফলে অপুত্রয়ী একদিকে ঘনিষ্ঠ বাস্তব, অপর দিকে দৈনন্দিনতার ঊর্ধ্বস্থিত এক বিরাট দেশ-কাল বোধও তার সমস্ত রূপকল্পকে বৃহৎ ব্যঞ্জনা দিয়েছে।’ চিদানন্দ এই ত্রয়ীর আধার বা আঙ্গিক সম্পর্কে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে এর বিশিষ্ট নির্মাণ রীতিটিই সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণরীতি এবং এই রীতি তৈরিতে সত্যজিৎকে হলিউডের চলচ্চিত্রের আঙ্গিকগত দিকটি কিছুটা প্রভাবিত করেছে। 

তানভীর মোকাম্মেলও অপুত্রয়ীর ওপর আলোচনা করতে গিয়ে আধেয় ও আধার প্রসঙ্গকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ত্রয়ী চলচ্চিত্রে মানবজীবনের মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিকে, জীবনের প্রবহমানতাকে সত্যজিৎ তাঁর জীবনদর্শনের আলোকে চিত্রিত করেছেন বলে লেখকের অভিমত। তানভীর ত্রয়ীর চিত্রভাষা তথা দৃশ্যশব্দখ-সমূহের সংগঠনরীতি, সম্পাদনা-কৌশল, আবহসংগীতের বহুমাত্রিক ব্যবহার, চিত্রনাটক রচনার কৌশল, সবই বীক্ষণের আওতায় এনেছেন। সুখপাঠ্য এই রচনায় তানভীর ত্রয়ী চলচ্চিত্রের আখ্যানের বৈশিষ্ট্য ও অন্তর্নিহিত দার্শনিক অভিপ্রায় এবং চরিত্রসমূহের মনোতল উন্মোচন করেছেন। সোমেশ্বর ভৌমিক ত্রয়ী চলচ্চিত্রের প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ সম্পর্কে বলেছেন যে এ-চলচ্চিত্রের সংগঠনরীতি ইতালিয় নয়াবাস্তবতাধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ ভাবনা দ্বারা তাড়িত হয়েও সত্যজিতের ‘নিজস্ব এক বিশ্লেষণাত্বক ভঙ্গি’ থেকে গড়ে উঠেছে। সোমেশ্বরের অভিমত : ‘সত্যজিৎ ধ্রুপদী রীতির থেকে নিয়েছেন তার সংগঠন-নৈপুণ্য, পারিপাট্য, আর নয়াবাস্তবতা থেকে তার সমাজ সচেতন বাস্তবমুখিনতা।’

সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তির অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে রবীন্দ্রমানসের প্রভাব। অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় সেই প্রভাবের মাত্রা নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ আর সত্যজিতের ‘চারুলতা’-র (১৯৬৪) মধ্যকার মিল-অমিল ধরার প্রয়াস নিয়েছেন তাঁর রচনায়। রবীন্দ্র-রচিত উপন্যাস ‘ঘরে বাইরে’-র চলচ্চিত্ররূপ দিয়ে সত্যজিৎ রবীন্দ্রবলয়ে পুনঃপ্রবেশ করেন। পার্থপ্রতিম চৌধুরীর বিবেচনায় ‘ঘরে-বাইরে সত্যজিৎ মননের শ্রেষ্ঠ ফসলগুলির অন্যতম।’ লেখক এর ফ্রেমিং, শট কম্পোজিশন, আলোকসম্পাত, অভিনয়নৈপুণ্য, সেট, ডিটেইলসের ব্যবহার, সবকিছু আলোচনায় এনে এর মধ্যে যে সমাজচৈতন্য ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আছে, তার আলোচনাও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্ররূপ দেওয়ার সময় সত্যজিৎ যে ‘ইস্থেটিক কম্প্রিহেনশন’ ঘটিয়েছেন তার প্রশংসা করেছেন লেখক। সত্যপ্রকাশ তাঁর দীর্ঘ রচনাকর্মে প্রধানত দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোকে ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস ও এর চলচ্চিত্ররূপের বাস্তব সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা, চরিত্রসমূহের বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা এবং ঘটনা-সংস্থাপনের ভিতরে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিতের স্ব-স্ব জীবনদর্শনের স্বরূপ কতটা প্রকাশ পেয়েছে, সে আলোচনা করেছেন।

সত্যজিৎ বিভিন্ন সাহিত্যিকের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, প্রয়োজনে নিজে কাহিনী রচনা করেছেন, ‘নায়ক’ তার মধ্যে একটি। নাজিমুদ্দীন শ্যামল ‘নায়ক’ (১৯৬৬) বীক্ষণ করে দেখিয়েছেন যে অনেকগুলো দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ এই চলচ্চিত্রে ঘটেছে : এতে দেবতা বনাম মানুষ, সামাজিক প্রতিষ্ঠা বনাম গণমানুষের রাজনীতি, অর্থ বনাম শান্তি, সমাজের অসারতা বনাম অগ্রগতি, শ্রেণিবৈষম্য বনাম সমাজ বদলের আকাঙ্ক্ষা, সিমেনা বনাম নাটক, মৃত্যু বনাম বেঁচে থাকা ইত্যাদি দ্বন্দ্বগুলো ক্রিয়াশীল। দ্বন্দ্ব ব্যতীত কোনো চলচ্চিত্রই জমে উঠে না। ‘অশনি সংকেত’-ও (১৯৭৩) দ্বন্দ্বমূলক চলচ্চিত্রই। এই চলচ্চিত্র বীক্ষণ করে সোমেন ঘোষ লিখেছেন ‘অশনি সংকেত শুধু সেকালের স্বাক্ষর বহন করছে না, একালের শ্রেণীদ্বন্দ্বের চেহারাটাও এ ছবিতে খুব স্পষ্ট।’ সত্যজিৎ এ চলচ্চিত্রে কেন রং-এর ব্যবহার করেছেন; রং দিয়ে কিভাবে চরিত্রের মনোলোককে উদ্ভাসিত করেছেন—এসব প্রসঙ্গ আলোচনার পর লেখক বলেছেন যে সত্যজিৎ তাঁর নিজস্ব চলচ্চিত্র-ভাষায়ই উপন্যাসের ঘটনাবলিকে চলচ্চিত্রে পরিবাহিত করেছেন। এই পরিবহনকর্মে সত্যজিৎ তাঁর স্রষ্টাবৃত্তির সমূহ প্রকাশ ঘটিয়েছেন বলেই আমাদের অভিমত। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’-তেও (১৯৭৭) সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তির সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। নিত্যপ্রিয় ঘোষ এই চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে বলেছেন যে প্রেমচন্দ্রের কাহিনী অনুসরণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ প্রকৃত ইতিহাসচ্যূত হয়েছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে লেখক তথ্য ও যুক্তি দিয়েছেন যা চলচ্চিত্র পাঠে উৎসাহীজনদের তাতিয়ে তুলবে।

সত্যজিৎ রায়ের শেষ বয়সের কাজ ‘গণশত্রু’ (১৯৮৯)। সত্যজিৎমানসের এক বিশেষ দিকের পরিচয় পাওয়া যায় এই চলচ্চিত্রে। দীপক সেনগুপ্ত এই চলচ্চিত্রবীক্ষণের শুরুতেই জানান যে গত শতাব্দীর শেষ সিকি ভাগে উপমহাদেশ জুড়ে মৌলবাদের যে উখান ঘটে সত্যজিৎ তা দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি মৌলবাদ তথা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। দীপক লিখেছেন : ‘গণশত্রু মৌলবাদের দাপটের বিরুদ্ধে একক সংগ্রাম।’ লেখকের বিবেচনায় এই চলচ্চিত্রে ‘সম্প্রদায়গত ধর্মের চেয়ে মানবধর্ম প্রাধান্য পেয়েছে।...সত্যজিৎ এখানে তথাকথিত ঐতিহ্যকে ছুড়ে ফেলে সনাতনপন্থী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এককভাবে দাঁড়াতে চেয়েছেন।’ সত্যজিৎ রায় বস্তুত জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চলচ্চিত্রকে সমালোচনামূলক সন্দর্ভ করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক’ (১৯৯১) তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ প্রশ্ন রেখেছেন এই বলে যে, সভ্য কে? আধুনিক মানুষ না আদিবাসী তথা লঘু নৃ-সমষ্টি? দেবাশীষ রায় তাঁর সমালোচনাকর্মে ঠিক এই প্রশ্নেরই উত্তর সন্ধান করেছেন। লেখক লক্ষ করেছেন যে এই চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ বলতে চেয়েছেন: মারণাস্ত্র নিষিদ্ধ করতে হবে; মানবিক গুণাবলীকে রক্ষা করতে হবে। কোনো একক শক্তি পৃথিবী শাসন করুক এটাও সত্যজিৎ চাননি। তিনি সবাইকে কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁর শেষ চলচ্চিত্রে—তবেই এ সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। সত্যজিতের এই দার্শনিক অভিজ্ঞান আজ আরও প্রাসঙ্গিক, আরও প্রয়োজনীয়।

প্রকৃতপ্রস্তাবে সত্যজিৎ ক্রমাগত নিজেকে তথা নিজের পূর্বতন ধারণা ও বিশ্বাসকে ভেঙে এগিয়ে গেছেন। এই এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই তাঁর স্রষ্টাবৃত্তির নানা দিকের সন্ধান করতে হবে। ইরাবান বসুরায় ‘সত্তর দশক ও সত্যজিৎ রায়ের ছবি’ শীর্ষক রচনায় সত্তর দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিতের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ (১৯৬২), ‘মহানগর’ (১৯৬৩) ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৬৯), ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১), ‘জনঅরণ্য’ (১৯৭৫) চলচ্চিত্রসমূহের বিষয়বস্তুর আলোচনা করে তাঁর মানসগঠনের নানাদিক বুঝতে চেয়েছেন; সত্তর দশকের সমাজ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে এই সব চলচ্চিত্রের প্রাসঙ্গিকতা নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন।        

পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মতন স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রেও সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য উপ্ত আছে। নবীনানন্দ সেন ‘সত্যজিৎ রায়ের ছোট ছবি’ শীর্ষক রচনায় ‘দি ইনার আই’ (১৯৭৪), ‘টু’ (১৯৬৪) এবং ‘পিকু’ (১৯৮১)-র বীক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। তিনটি চলচ্চিত্রই মানুষের একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার বয়ান। নবীনানন্দ চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সত্যজিতের নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষার সন্ধান করেছেন প্রধানত শট, সংলাপ, রং, সংগীত, চিত্রগ্রহণ, চিত্রপট, সম্পাদনা প্রভৃতি উপকরণের ধরন বিচারের মাধ্যমে। এগুলোর স্বরূপই প্রকৃত অর্থে সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তির স্বরূপটি নির্ধারণ করে দিয়েছে।

চলচ্চিত্রকলার অভ্যন্তরীণ মূল উপকরণগুলো হচ্ছে: দৃশ্যখণ্ড, শব্দখণ্ড ও সম্পাদনাকর্ম। সত্যজিৎ এই উপকরণগুলো নির্মাণ করেছেন তাঁর গ্রাফিক সেন্স, সাংগীতিক ও সাহিত্যবোধ দিয়ে। এই তিনটির সাথে এসে মিশেছে তাঁর বিশ্ব চলচ্চিত্র দর্শনের অভিজ্ঞতা; চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে রেনোয়া সৃষ্ট ধ্রুপদী রীতি; ডে সিকা প্রমুখ সৃষ্ট নব্যবাস্তববাদী রীতি; রবার্ট ফ্ল্যাহার্টি প্রবর্তিত কাব্যিক বাস্তববাদী রীতি ইত্যাদি। সব মিলিয়েই সত্যজিতের চলচ্চিত্রবোধ তৈরি হয়েছে।

চলচ্চিত্রকলার প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে চিত্রনাটক। চিত্রনাটকে চলচ্চিত্রের শরীরে যতগুলো প্রাণস্পন্দন থাকে, সবগুলোর খুঁটিনাটি দিক লেখা থাকে। অনিল চট্টোপাধ্যায় ‘চিত্রনাট্য রচনায় সত্যজিৎ’ শীর্ষক রচনায় চিত্রনাটক থেকে শুটিং স্ক্রিপ্ট পর্যন্ত সত্যজিৎ কিভাবে সংলাপ বসাতেন, চরিত্রের বর্ণনা দিতেন, লোকেশন, আবহসংগীত, অভিনয়ের ধরন কিভাবে লিপিবদ্ধ করতেন, তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে সে-সব এই রচনায় বলার চেষ্টা করেছেন। চিত্রনাটকের মধ্যেই কেন সত্যজিৎ প্রতিটি ফ্রেমের ছবি আঁকতেন, মিউজিক্যাল নোট লিখে রাখতেন, কোথায়-কোথায় শট একটু বেশিক্ষণ ধরে রাখতে হবে তা টুকে রাখতেন, তা-ও এই রচনা থেকে জানা যায়। চিত্রনাটকের চাহিদা অনুযায়ী অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে সত্যজিৎ কিভাবে অভিনয় আদায় করে নিতেন তা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভিনয়-শিক্ষাদানে সত্যজিৎ রায়’ রচনাটি থেকে অবগত হওয়া যায়। অভিনয়শিল্পীকে সত্যজিৎ কেন প্রতিটি ডিটেইলের ব্যাপারে বলতেন, বারবার মহড়া করাতেন, কেন সবসময় যথার্থ মুখ বাছাই করতেন, প্রত্যেক চরিত্রের জন্য আলাদা-আলাদা ম্যানারিজম তৈরি করে দিতেন, কেমন গেটআপ মেকআপ হবে তা আগেই বলে দিতেন, সবকিছুর বর্ণনা সৌমিত্রের রচনায় পাওয়া যায় যা ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্রকারদের কাজে লাগতে পারে।

চিত্রনাটক অনুযায়ী অভিনয়শিল্পী বাছাই করার পর তাঁদের দিয়ে অভিনয়কর্মটি যথাযথ সেটের মধ্যে নিষ্পন্ন করতে হয়। এই সেট নির্মাণ শিল্পনির্দেশনার বড়ো একটি দিক। সত্যজিৎ এই দিকটি তাঁর গ্রাফিক ডিজাইন সংক্রান্ত অনুভব দ্বারা সমাধা করতেন বলে রবিউল হুসাইন জানান। এ ব্যাপারে সত্যজিৎ প্রাচ্যরীতি অনুসরণ করতেন বলে লেখকের অভিমত। চিত্রনাটক রচনা, তদানুযায়ী অভিনয়শিল্পী নির্বাচন এবং সেট নির্মাণের পর যে অভিনয়কর্মটি নিষ্পন্ন হয় তা ধারণ করার জন্য ক্যামেরা-সঞ্চালনের প্রয়োজন। এই কাজটি সত্যজিৎ সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করতেন। আনোয়ার হোসেন ‘সত্যজিতের চলচ্চিত্রে ক্যামেরা’ নামক রচনায় সত্যজিতের চলচ্চিত্রে নানা ধরনের আলো তৈরির কৌশল, শটের ব্যবহার, ক্যামেরার মুভমেন্ট, কম্পোজিশনের ধরন, ডিটেইলের ব্যবহার, গ্রাফিক সেন্সের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। আনোয়ার হোসেন ‘সত্যজিতের ক্যামেরায় রবীন্দ্রসাহিত্য’ প্রবন্ধে সত্যজিতের ক্যামেরাকর্মের ওপর আলোচনা করেছেন। তাঁর বিবেচনায় সত্যজিৎ চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষায় রবীন্দ্র সাহিত্যকে চলচ্চিত্র মাধ্যমে পরিবাহিত করেছেন। এক্ষেত্রে সত্যজিৎ একেবারে নিজস্ব ধরনে ট্রলির ব্যবহার করেছেন; রিফ্লেকশন শট, ক্লোজআপ, নানারকম অ্যাঙ্গেল প্রভৃতির ব্যবহার করেছেন বলে আনোয়ারের অভিমত। সত্যজিতের চলচ্চিত্রাঙ্গিক সম্পর্কে তাঁর বিবেচনা : ‘সত্যজিৎ রায় সার্বিক অর্থে নিজেকে প্রকাশ করেছেন এপিক আঙ্গিকে। ...তাই সত্যজিতের চলচ্চিত্রে আমরা কখনো ঘন ঘন ইন্টারকাট কিংবা মন্তাজ অথবা অতিদ্রুত কোনো ট্রলি বা জুমিং-এর অতিরিক্ত ব্যবহার দেখতে পাই না।’

সত্য এই যে, সত্যজিতের চলচ্চিত্রের দৃশ্যখণ্ডগুলো নির্মিতিতে একটা লিরিক্যাল অ্যাপ্রোচ পাওয়া যায় যা এপিকবর্তী। সত্যজিতের নিজস্ব স্রষ্টাবৃত্তি অনুযায়ীই তিনি ফ্রেমিং, কম্পোজিশন, শট ধারণ, দৃশ্য-সংগঠন ও দৃশ্যশব্দময় খণ্ডগুলোর পরপর সংস্থাপনকর্মটি সম্পন্ন করতেন। শব্দখণ্ডের ব্যবহারের বেলায়ও সত্যজিৎ নিরীক্ষা প্রবণ ছিলেন। কম সংলাপ ব্যবহার করে দৃশ্যের প্রবাহ দিয়ে আখ্যান এগিয়ে নেওয়াটা তাঁর চলচ্চিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পারিপার্শ্বিক শব্দকে গুরুত্ব দিতেন, গান ও আবহসংগীতের ব্যবহার তখনই করতেন যখন সংলাপ দিয়ে চরিত্র ও ঘটনার বর্ণনা আর সম্ভব নয় বলে মনে করেছেন। বস্তুত চলচ্চিত্রে দৃশ্য ও শব্দখণ্ডগুলোকে সম্পাদনাকর্মের মাধ্যমে পরপর সংস্থাপনের মাধ্যমে বোধগম্যভাবে কাহিনী সাজানোর পরই আবহসংগীতের পর্বটির কাজ সমাধা করতে হয়।

গৌতম ঘোষ ‘সত্যজিৎ রায়ের আবহসংগীত’ নিবন্ধে লিখেছেন যে ‘দৃশ্যকল্প, শব্দ, সংলাপ, অভিনয়ের মতই আবহসংগীত পরিচালকের একটা মস্ত বড় হাতিয়ার।’ সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনার সময়, শুটিংয়ের সময়, সম্পাদনার সময় কোথায় কিভাবে আবহসংগীতের জন্য স্পেস রেখে দিতেন সে-প্রসঙ্গে লেখক তাঁর অনুধাবন ব্যক্ত করেছেন। সত্যজিৎ কেন আবহসংগীত রচনার সময় পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত, দেশীয় মার্গ সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত ও লোকসংগীতের দ্বারস্থ হতেন, তাও লেখক তাঁর আলোচনায় এনেছেন যা সত্যজিতের আবহসংগীত রচনা সম্পর্কে একটা প্রেক্ষিত পেতে সাহায্য করে। সত্যজিৎ রায় প্রথমদিকে নিজে তাঁর চলচ্চিত্রের আবহসংগীত রচনা করতেন না, পরে কেন নিজেই তাঁর চলচ্চিত্রের আবহসংগীত রচনার ভার নেন, তার নেপথ্য কারণ পাওয়া যায় হীরেন্দ্র চক্রবর্তীর রচনায়। সুধীর চক্রবর্তী তাঁর রচনায় জানান যে চলচ্চিত্রভাষার প্রয়োজনেই সত্যজিতের চলচ্চিত্রে সংগীত ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর মতে ‘সামগ্রিক চলচ্চিত্র ভাবনার যে সুনির্দিষ্ট ছক অবলম্বনে তাঁর ছবিগুলি গড়ে ওঠে, তার মর্মমূলে সাংগীতিক ভাবনাও গৃহীত। ...সংগীত সত্যজিতের চলচ্চিত্রের উপাদান বা অঙ্গ নয়, সংগীত তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয়গত।’ আবহসংগীত রচনার সময় সত্যজিৎ কেন দেশি-বিদেশি সুরের সংমিশ্রণ ঘটাতেন, লেখক সে-প্রসঙ্গও তাঁর আলোচনায় এনেছেন। অনেকে বলেন যে ‘সত্যজিতের চলচ্চিত্রের কাঠামোর মধ্যেই একটা সাংগীতিক গুণ রয়েছে’, পুলক গুপ্ত ‘সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সংগীত’ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে এই আপ্তবাক্যেরই বিস্তার ঘটিয়েছেন। সত্যজিতের কম্পোজিশনের ধরন, নির্মিত সংগীতের টুকরো চরিত্র-ঘটনার পশ্চাতে কোন ভাবনা থেকে ব্যবহৃত হয়েছে, লেখক উদাহরণসহ তা উপস্থিত করেছেন। অতনু চক্রবর্তীও ‘তিনকন্যা’ (১৯৬১) ও ‘চারুলতা’-র আবহসংগীতের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে দেখান কীভাবে সংগীতখণ্ড রচনা করে সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতেন। ‘তিনকন্যা’-র আবহসংগীত সৃষ্টিতে কেন সত্যজিৎ তিনটি প্রধান সুরধারা তৈরি করেন এবং কী কী যন্ত্রে তিনকন্যার (রতন, মনিমলিকা ও মৃন্ময়ী) আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও বেদনা প্রকাশ করেছেন এবং ‘চারুলতা’-র চারুর সামগ্রিক পরিবর্তনের সমান্তরালে আবহসংগীত সৃষ্টি করছেন, সৃষ্টি করতে গিয়ে কোন্ যন্ত্র কেন বাজিয়েছেন, সব বিষয়েই অতনু তাঁর মতামত দিয়েছেন।

আশা করি, প্রবন্ধ থেকে চলচ্চিত্রচর্চায় উৎসাহী পাঠক, শিক্ষার্থী, চলচ্চিত্রবিষয়ক গবেষক—সবাই বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের মহান কারিগর সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তি সম্পর্কে সামান্য হলেও ধারণা পাবেন। 


[২৯ শে মার্চ, ২০২১ তারিখে বাংলা একাডেমির মূলমঞ্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে আয়োজিত ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি’-তে প্রবন্ধটি পাঠ করার কথা ছিলো। করোনা মহামারীর কারণে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হয়। দুঃখের বিষয় এর কিছুদিনের মধ্যেই, ১৫ এপ্রিল ২০২১ তারিখে করোনা আক্রান্ত হয়েই মারা যান এই প্রবন্ধের লেখক সাজেদুল আউয়াল। প্রবন্ধটি পারিবারিকভাবে জাগরণ অনলাইনকে দেয়া হয় প্রকাশ করার জন্য।]