• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৩১, ২০২১, ০২:১৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৩১, ২০২১, ০২:৫৩ পিএম

আকাশছোঁয়া এক মিনারের মিথ

আকাশছোঁয়া এক মিনারের মিথ

মানুষ বরাবরই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নিজের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছে সব সময়। বাবেল শহরের মানুষও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগের একটি শহর, বাবেল। এ শহরের আকাশচুম্বী এক মিনার নিয়ে রয়েছে দারুণ একটি মিথ। 

কথিত রয়েছে, নূহ নবীর সময়ে এক মহাপ্লাবন আসে এ পৃথিবীতে। এ প্লাবন ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্লাবন শেষে মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করে। তখন সব মানুষ একটি মাত্র ভাষায় কথা বলতো। সবাই সবার কথা বুঝতে পারতো। সে সময় মানুষ শহর তৈরির স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সেই সাথে মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরি করার পদ্ধতিও আবিষ্কার করে ফেলে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সবচেয়ে পুরোনো ইটের বয়স পেয়েছিলেন প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর। আর যে নতুন শহরের কথা বলছি, এটি ছিলো চার হাজার বছর পূর্বের। শহরের নাম বাবেল।

প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন বর্তমান ইরাকের বাগদাদ শহরের মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরে সত্যিই এক সময়ে এমন একটি শহর ছিলো।  তাঁরা এ স্থাপত্যের নাম দিয়েছেন Etemenanki, যার অর্থ পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যকার মন্দির। কেউ কেউ এ শহরের নাম বলেন বেবিলন। সেই বাবেল শহরের মানুষেরা ঠিক করলো, আকাশচুম্বী একটা মিনার বানাবে। তারা ইট তৈরির পদ্ধতি জানে, একটার পর একটা ইট সাজিয়ে উঁচু দেয়াল বানাতে পারে। সুতরাং স্বর্গ পর্যন্ত উঁচু একটা মিনার তো বানানোই যায়। মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই, মানুষ চাইলে সবই পারে। সবাই কাজে নেমে পড়লো আটঘাট বেঁধে। সেসব কাজের কিছু কিছু নিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এখনো খুঁজে পান। তাঁদের মতে, এ মিনার ছিলো পৃথিবীর সর্বপ্রথম উঁচু স্থাপত্য, যা ‘টাওয়ার অফ বাবেল’ নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে এর উচ্চতা বলা হয়েছে, আকাশছোঁয়া। এমন কি কোনো কোনো বর্ণনা মতে, এটি বর্তমান বুর্জ খালিফার তিনগুণ বেশি উচ্চতাবিশিষ্ট ছিলো। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ধারণা করেন, সাতটি ধাপের এ মিনারের উচ্চতা ছিলো ৯১ মিটার। প্রতিটি ধাপ বিভিন্ন রঙের ভারি পাথর দিয়ে বানানো। একেকটি ধাপের রঙ একেক রকম। ধাপগুলো ছিলো সর্পিলাকার। সে সময়ের স্থাপত্যবিদ্যাও বেশ আশ্চর্যজনক। 

বাবেল শহরের মানুষের মনে মিনার তৈরির চিন্তায় যখন এলো, ঐ সময়ে ঈশ্বরের কথা এক বারও তাদের মনে এলো না। অথচ এ যেন খোদার ওপর আরেক খোদকারি। প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে যাবার অদম্য এক স্পৃহা মানুষের। মিনার তৈরির কাজে তারা এত ব্যস্ত হয়ে গেলো যে, এক সময় ঈশ্বরের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেলো। ব্যস, ঈশ্বরেরও ইচ্ছে হলো বাবেলের মানুষদের একটা শিক্ষা দেওয়ার। মিনার তৈরি করতে করতেই এক সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে দেখে, কেউ আর কারো ভাষা বুঝতে পারছে না। এত দিন সবাই একই ভাষায় কথা বলতো, সবাই সবার কথা বুঝতে পারতো। কিন্তু আজ এ কী হলো। একেক জন একেক রকম করে কথা বলছে! মিনারের ইট কোথায় কোনটা কীভাবে গাঁথতে হবে, কেউ আর একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কারণ, প্রত্যেকের ভাষা অচেনা। ইট নিয়ে একজন যদি বাম দিকে গাঁথুনি দেয়, তো আরেকজন দেয় ডান দিকে। মানুষের মধ্যকার একতা নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে কি মিনারের ভারসাম্য ঠিক থাকে? হতাশ হয়ে সবাই মিনারের কাজ বন্ধ করে দেয়। একেকজন চলে যায় একেক দিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে তারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিভিন্ন ভাষাভাষীরা আবার নতুন করে শহর তৈরি করে একেক জায়গা। ‘বাবেল অফ টাওয়ার’ মিথে এভাবেই পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠী সৃষ্টি হবার কথা বলা হয়েছে। 

তবে মানুষ কিন্তু তার স্বপ্ন দেখা থামিয়ে দেয়নি। বাবেলের মিনার হয়তো মতবিরোধের জন্য মানুষ তৈরি করে পারেনি। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে আপনি দেখবেন, পিরামিড, চীনের প্রাচীর, আইফেল টাওয়ার, সিয়ার্স টাওয়ার, টুইন টাওয়ার, বুর্জ খালিফা! আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে মানুষ তার লক্ষ্যে পৌঁছুতে চেয়েছে সব সময়। মানুষ যতই মাটি থেকে আকাশের দিকে উঠতে চেয়েছে, ততই পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে অদৃশ্য সব দেওয়াল। আর তাই মানুষ একই ভাষায় কথা বললেও কেউ কারো কথা আজও বোঝে না। নিজের কথাও বোঝাতে পারে না। 

আকাশমুখী সেই প্রাচীন বাবেল টাওয়ার আজ আর নেই। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সে স্থান খুঁজে বের করে পেয়েছেন ধংসস্তূপ। কেবল মাত্র একটি বড় গর্ত ছাড়া সেখানে আজ কিছুই নেই।