• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২১, ০৩:৫৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১০, ২০২১, ০৪:৩৬ পিএম

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: কোনোভাবেই প্রয়াণলেখ নয়

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: কোনোভাবেই প্রয়াণলেখ নয়

আমাদের প্রজন্মের ছেলেদের কাছে ক্ল্যাসিক মানে সালমানের হাসি আর রুবেলের জোড়া পায়ের লাথি। তখন শহরে ডজনখানেক সিনেমা হল। ফলে মৌসুমী আর শাবনাজের উজ্জ্বল ত্বকের বিচ্ছুরণে আমাদের বয়ঃসন্ধি পুষ্টি পাচ্ছিল। এসবের মধ্যে একদিন ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি ‘দেশ’ পড়া শুরু করলাম। পরের বছর , ১৯৯৯ সালের শারদ দেশ বাজারে আসার পরপর ‘ভূতপঞ্চমী’ শীর্ষক একটি সংখ্যা বাজারে আসে। সেখানে পাঁচটি ভূতের গল্প মুদ্রিত হয়। জীবনের সেরা ‘ভূতের গল্প’ পড়ি সেখানে। লেখকের নাম–বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত । গল্পটির নাম –‘অদ্ভুত এক হাওয়া’। বিষয় সামান্যই, এমন গল্পের বিষয় অজস্র। কিন্তু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নামটির যাকে বলে প্রথম দেখাতেই প্রেমে কেন পড়লাম, সেটি বলতে গেলে গল্পটা খানিক বিস্তারিত তুলে ধরা দরকার।

অরূপ স্কুলের মেয়েদের ড্রিল টিচার, ধনী পরিবারের মেয়ে মনীষা তাকে বিয়ে করবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এখন তারা ট্রেনে ভূপাল যাচ্ছে। ট্রেনে অরূপ সিগারেট ধরিয়েছে। তারপর–‘আশ্চর্য সহজ মুখের মধ্যে সবচেয়ে গভীর চোখ দুটো। আর ওর হাতের দৈবে পাওয়া আঙুলগুলোর মতো সুন্দর কারও আঙুল দেখেনি মনীষা। ওই আশ্চর্য চোখ দুটোর জন্য আঙুলগুলোর জন্য সবকিছু করতে পারে মনীষা। ঝরে যেতে পারে, মরে গিয়ে বেঁচে উঠতে পারে আবার।’ তারা ভূপাল যাচ্ছে, সেখানে চাকরি করবে দুজন, নতুন সংসার পাতবে। ওইটুকু পড়ে মনে হলো এ একজন প্রকৃত কবির হাত। তখন সদ্য আঠারো আমার। কবিতা আর শরীরের হাহাকার যুগপৎ আক্রমণ করেছে। ট্রেন দুর্ঘটনা হলো, সব ভেঙেচুরে গেল, স্বপ্নসাধ। আহত দুজন দুজনকে খুঁজে পায়, হোটেলে আশ্রয় নেয়, সব স্বাভাবিক। সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসে–‘খুট করে একটা শব্দ হল। আলো নিবিয়ে দিল অরূপ। তারপর এগিয়ে যেতে লাগল মনীষার দিকে। হঠাৎ মনে হলো চাপা এক অন্ধকারের ভেতর দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটছে সে। কিন্তু মনীষা কোথায়? ঠিক এই সময় তার হাত, হাতের আঙুল স্পর্শ করল মনীষার শরীর। অরূপ জড়িয়ে ধরল মনীষাকে। বুঝতে পারল মনীষাও জড়িয়ে ধরেছে তাকে। শুষে নিতে চাইছে দুজন দুজনের শরীর। অন্ধকারের মধ্যে অরূপের চোখের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মনীষা। বাড়িয়ে দিল তার আঙুল। অরূপের ঠোঁটের ওপর দিয়ে নাকের ওপর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল মনীষার আঙুল। তারপর দুটো গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল। এগিয়ে যেতে লাগল সেই গর্ত দুটোর মধ্য দিয়ে। একি, কোথায় অরূপের চোখ? চোখের জায়গায় হাড়হিম এক আঁধারের মধ্য দিয়ে কোথায় চলেছে তার আঙুল? আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল মনীষা। ঝরে যেতে লাগল আসমুদ্র অন্ধকার, সেই ঘর, সময়।

অরূপের আঙুল উঠে এলো মনীষার চোখের দিকে। তারপর দুটো গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল তার আঙুল। অরূপ বুঝতে পারল সব। বুঝতে পারল দুটো গর্তের মধ্য দিয়ে এক অনন্ত জলরাশির ভেতর ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে দুটো আঙুল। অনেক অনেক দূরে মনীষার কান্না তবু ছুঁতে পারল অরূপ। কেন এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল সব? নাকি তারা এমনই ছিল চিরকাল? মনীষা কি কোনো দিনই মানুষী ছিল না? সে-ও কি মানুষ ছিল কোনো দিন? কিছু মনে পড়ল না অরূপের। মনীষার মনে পড়ল না কোনো কিছু। শুধু অদ্ভুত এক হাওয়া এসে ঘিরে নিল তাদের।’ অষ্টাদশ বর্ষীয় তরুণ বুঝতে পারে, এ নিছক ভূতের গল্প নয়। আমাদের প্রেম, শরীর, স্বপ্ন, সত্তা সব একসঙ্গে রাষ্ট্রীয় দুর্ঘটনায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার গল্প।

আরও কিছুদিন যায়। স্যাটেলাইট কানেকশন নেওয়ার পর আরও অনেকের মতো ফ্যাশন টিভি, রেন টিভিতে নিশিরাতে সমাজতন্ত্রের আপাত পরাজয়ের রুশী শীৎকার গিলতে গিলতে আরেকটু হলেই রুশ ভাষাবিদ হয়ে পড়ার মধ্যের এক দুপুরবেলা কলকাতার চ্যানেল ইটিভি বাংলায় দেখতে বসলাম–উত্তরা। কিছু শ্বাসাঘাত ধ্বনির জন্য রুচিবাগীশ পরিবারে প্রকাশ্যে দেখতে পারিনি। অনেক দিন পরে আবার দেখে বুঝি, শীৎকারের সাউন্ড এফেক্ট কখনো কখনো কান্নার প্রতিধ্বনি হতে পারে। চরাচর, লাল দরজা–পরপর আরও ছবি। মনে পড়ে, ‘কীভাবে ছবি করি, কীভাবে ছবি হয়’ – বুদ্ধদেবপ্রণীত চলচ্চিত্রবিষয়ক বইয়ের সূচনাবাক্য –‘সিনেমার প্রাণ হল ইমেজ।’ তাঁর ছবি আর কবিতার পাশাপাশি ঘর করা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক বিশেষ লাবণ্য যুক্ত করে। চরাচরে বুদ্ধদেব, সর্বপাপহর শমিতপ্রাণ নেমসেক গৌতমের মতোই সর্বপ্রাণবাদী হয়ে পড়েন। মানুষ যদি প্রকৃতির ভাষা বুঝত, আত্মহত্যা বিলুপ্ত হয়ে যেত বলে মনে হয়। একটা খালি মাঠে হাঁটছেন একা, একটা একলা পাখি আপনার কাঁধে এসে বসল। আপনারা দুইজন হয়ে উঠলেন। সে আপনাকে শোনাল দূর নগরের সংবাদ। অরণ্যের মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় নানা ভাষায় বৃক্ষের কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা আমাদের জ্যান্ত থাকায় বাড়তি শক্তি জোগাত নিশ্চিত। সিনেমা নিয়ে আরো অনেক কথা হবে সামনে, কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালক পরিচয়ের আড়ালে তাঁর কবি পরিচয়, কথাসাহিত্যিক পরিচয় অনেকটাই আড়ালে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১৯৪৪-২০২১)

দ্রাক্ষাপুঞ্জ, শুঁড়ি ও মাতাল– বইতে মণীন্দ্র গুপ্ত কী বলছেন আমরা দেখে নিতে পারি: ‘এই সন্ত্রাসকালের বীর্য ততটা নয়, যতটা জ্বালা , ঘৃণা ও কারুণ্য স্পর্শ করেছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে। কিন্তু তাঁর আবেগ বিস্তৃত হলেও ছিল অনেকটাই উপরিতলের–দেশের এই স্থায়ী অবস্থাটারই বেশি বিপক্ষে। ফলত তাঁর কবিতা আর্ত নয়, ক্ষুদ্ধ; গভীর নয় স্মার্ট; সরাসরি নয়, প্রতীক ও প্যাটার্নে অন্বিত। দ্রুত, উত্তেজিত, খোলামেলা ও উদ্ভট চিত্রে কীর্ণ তাঁর এই সময়ের কবিতা বলিষ্ঠতা, নতুনত্ব ও সাম্প্রতিকতার জন্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আদৃত হয়েছিল।’ এতটা সংক্ষপে বুদ্ধদেবের কবিতা নিয়ে বিশদ মন্তব্য চোখে পড়েনি। একজন মহৎ কবি যখন চিহ্নিত করছেন একজন কবিকে তখন তিনি অল্প কয়েকটা স্কেচেই একটা বৃহৎ পটভূমির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। আমরা এখন প্রাক-করোনা শারদ এই সময় পত্রিকায় (২০১৯ ) মুদিত একটি কবিতা পড়তে পারি–

‘শুয়োরের বাচ্চার মতো টিকটিকিরও বাচ্চা হয়। সেদিন বই-এর তাকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা টিকটিকির বাচ্চা। কোত্থেকে এল? কী করে এল? কোন বড় টিকটিকি এসে ডিম পেড়ে চলে গেল? শুয়োরের বাচ্চাদের দেখলে যেমন রাগ হয়, লাথি মারতে ইচ্ছে করে পেছনে, টিকটিকির বাচ্চাটাকে দেখে আমার তেমনই হলো কিন্তু বউ বলল–ওকে মেরো না, চল ওকে আমরা পুষি। ওকে খাওয়াই, পরাই, ইশকুলে ভর্তি করে দিই, তারপর কলেজে। তারপরে একদিন গালফোলা মন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়ে ওর পকেটে ছেড়ে দিয়ে আসি। টিকটিকি বড় হতে হতে একদিন একটা কুমির হয়ে যাবে, তারপর যখন ঘুমিয়ে থাকবে সবাই, সেই কুমির আস্তে আস্তে গিলে ফেলবে মন্ত্রীকে, মন্ত্রীর বউকে, মন্ত্রীর বাচ্চাকে। বউ-বাচ্চা কোনো দোষ করেনি কিন্তু কুমির তো কুমিরই, কুমিরের মাথায় কি বুদ্ধি আছে যে অতশত বুঝবে।’

সেই এক পৃষ্ঠার লেখার শেষ দিকে বুদ্ধদেবের কবিতা নিয়ে বেশ খানিকটা হতাশামাখা রাগ দেখিয়েছিলেন মণীন্দ্র। লিখেছিলেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, সাধারণভাবে কবিসমাজ নিয়েও কথাটা খাটে–‘কিন্তু পৃষ্ঠপোষক-পাঠকের আদরও যে একজন প্রতিশ্রুত কবির পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে, বুদ্ধদেবের পরবর্তী-কবিতা তার উদাহরণ। এখন চাহিদার ফলে বুদ্ধদেব ক্রমে অতিপ্রজ হয়ে তাঁর সেই একদা-আদৃত বাক-প্যাটার্ন ও প্রতীককৌশলের চূড়ান্ত করে চলেছেন। ফলে, এখন তাঁর কাছে বক্তব্যের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে প্রতীক। বক্তব্য রইল সীমিত হয়ে, ক্রমশ তাৎপর্যও হারাল, কিন্তু সংখ্যাতীত হয়ে থাকল প্রতীক। এবং এই প্রবৃদ্ধির ফলে স্বভাবতই তাঁর কোনো ভাবের কোনো বিশিষ্ট প্রতীক রইল না–তারা তাদের স্থির ব্যঞ্জনা ও নির্দিষ্ট মূর্তিরূপ হারিয়ে হলো গলানো কাঁচা মালের মতো। এবং সেইজন্যেই হাত, পা, মাথা, জিভ, দাঁত, কান, চোখ, আঙুল, নাক সবকিছু নিয়েই তাঁর পক্ষে এখন কবিতা খা সম্ভব হচ্ছে।’

যে কবিতা সম্পূর্ণ উদ্ধার করলাম সেটা প্রকাশের আগেই মণীন্দ্র প্রয়াত হয়েছেন। ফলে বুদ্ধদেবকাব্য নিয়ে তাঁর ধারণা বদল হতো কি না, হয়েছিল কি না আমরা জানি না। আজ সকালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত চলে গেলেন। অনন্তলোকের কোনো এক প্রান্তে এই দুজন কবি হয়তো সংলাপে বসবেন, কে বলতে পারে! আমি কেবল ভালোবাসাটুকু টুকে রাখলাম।