• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১, ১২:১৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১, ০৫:২২ এএম

শিল্পীর ৭১তম জন্মজয়ন্তীতে শ্রদ্ধা

আমার শাহাবুদ্দিন

আমার শাহাবুদ্দিন
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ।

শত হাজার বছর আগে গুহাবাসী মানুষ কেন গুহাচিত্র এঁকেছিল সে প্রশ্ন এখনও অবান্তর নয়। কি তাগিদ ছিল মানুষের ছবি আঁকার? অথবা কি এমন বিষয়ে মানুষ প্ররোচিত হলো শিল্পকর্মের জন্য? এসব জিজ্ঞাসার সহজ উত্তর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনও খুঁজেছেন। সভ্যতার বিস্ময়কর সাফল্যে মানুষের অবিচল সংগ্রামকে আবেদীন নানাভাবে পরখ করেছেন। শিল্পের আদি রহস্যকে সহজীকরণের কৌশলের মধ্যে কিংবা সভ্যতার সাথে শিল্পকর্মের রহস্যময় সংযোগ নিয়ে তাঁর উন্মুখ সাধনা শিল্পকলায় এক অনন্য উদ্যোগ বলেই বিবেচিত।

আজ এ কথা অনিবার্যভাবেই সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য যে, শুধু শিল্পকর্মই পারে আনন্দ, ভালোবাসা, বেদনা, দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা, সাফল্য, নিন্দা, হাসি, কান্না, উত্তাপ ও প্রতিবাদকে সৃজনশীলতায় সজ্জিত করতে। শিল্পসজ্জার এমন রূপে বিভোর হয়েই আমাদের অনুভূতিগুলো ক্ষমতাবান হয়, চিন্তায় সজাগ ভাবনা জাগে এবং প্রগতির জন্য নিষ্ঠাময় হয়ে ওঠে আমাদের মানবিক বিবেক। শিল্পকর্মে যে বৈচিত্র্য আছে, এটা তো সহজপাঠ নয় কোনো, হৃদয়ের অনুভব থেকেই কেবল একে ধারণ করার সামর্থ্য আসে। শিল্পীর তুলির আঁচরে সমান গতি থাকে না, চিন্তার প্রতিফলনও ভিন্ন স্বাদের হয়। তাই শিল্পকে আত্মস্থ  করার ক্ষেত্রে সপ্রতিভদৃষ্টির বিকাশ জরুরি। দৃষ্টির বিন্যাস না ঘটালে শিল্পের রূপ ও রস আহরণ অনিন্দ হবে কি করে?

''আমি এই বাংলা আর বাংলার সিংহপুরুষ মুজিবকে ভালো না বেসে থাকতে পারিনি। এমন নির্দয় পাষাণ হৃদয় আমার না। শাহাবুদ্দিনের রঙে ও ভাবনায় যে মহাকাব্য রচিত হয়, সেখানে আমার বিশ্বাস আমার অস্তিত্ব সব সংকট থেকে মুক্ত হয়েছে। ''   

চিত্রকলা বিষয়ে আমার তেমন কোনো জ্ঞান নেই, সামান্যতম শিক্ষাও পাইনি। তবে এ নিয়ে আগ্রহ আছে, গভীর অনুরাগও আছে। শিল্পের জন্য এবং শিল্পীত মানুষের জন্য আমার অবিচল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করি। কিশোরকালে আমিও অন্য দশজনের মতো ছবি আঁকতাম। পূর্ণভবা, মহানন্দা নদীর বুকে নৌকা চলছে, মাঝি ভাই দাঁড়/বৈঠা হাতে নৌকো টানছেন, বহুদূরে গ্রাম, ছোট ছোট গৃহ যেন বৃহৎ সব বৃক্ষে ঢাকা পড়েছে, নীল আকাশে পাখি উড়ে যাচ্ছে। এই চিত্রকে কল্পনা করেই আমি বাংলাদেশের সন্ধান পেয়েছি। মজবুত বন্ধন হয়েছে আমার বাংলার ভূমির সাথে। এই ভূমির কানায় কানায় রক্তের চিহ্ন, তিরিশ লাখ শহীদের শরীরে বাংলার ভূমি রঞ্জিত হয়ে আছে। রক্তস্নাত বাংলার ইতিহাস তিন হাজার বছরের ইতিহাস। তিন হাজার বছরে এখানে কত শতবার রক্তপাত হয়েছে, সে তথ্য আমি জানি না। তবে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ, রক্তের প্লাবন আর অসম সাহসী তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বিজিত রূপের ছবি আমার দৃষ্টির মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। এক মহৎ নেতার মহান উচ্চারণ আমার অন্তরের গভীরে স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছে, এই উচ্চরণেই আমি বাংলাদেশকে খুঁজি পাই। এগুলোর কোনো কিছুই আমার স্মৃতির বয়সকে সমন্বয় করে না। কিন্তু শিল্পী শাহাবুদ্দিন আমাকে বয়সের চৌকাঠ থেকে মুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধ দেখান, বাঙালির তিন হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম অর্জন স্বাধীনতাকে আমি তাঁর চিত্রের সজীব উচ্ছ্বাসে ধারণ করে জেগে উঠতে শিখেছি। একইভাবে এক মহান বাঙালির অসীম সাহসের দীপ্র আহ্বান আমি শাহাবুদ্দিনের শিল্প থেকে জেনে নিই। শিল্পী আমাকে সজীব শেখ মুজিব, রেসকোর্স ময়দানে ভাষণরত শেখ মুজিব, ১৫ আগস্টে মর্মান্তিকভাবে নিহত নির্মোহ শেখ মুজিবের নিথর দেহের মধ্যে বাংলাকে ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগিয়ে দিয়েছেন। আমি এই বাংলা আর বাংলার সিংহপুরুষ মুজিবকে ভালো না বেসে থাকতে পারিনি। এমন নির্দয় পাষাণ হৃদয় আমার না। শাহাবুদ্দিনের রঙে ও ভাবনায় যে মহাকাব্য রচিত হয়, সেখানে আমার বিশ্বাস আমার অস্তিত্ব সব সংকট থেকে মুক্ত হয়েছে।  

''মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার ক্ষিপ্রতা, বাংলার নদী, বনাঞ্চল, চর, নারী ও নারীর শরীরের ভাঁজ শাহাবুদ্দিনের চিত্রকর্মে বিরাট ব্যঞ্জনা পেয়েছে। ''

শিল্পী শাহাবুদ্দিন এক বলবান বাহাদুর যোদ্ধা। কোমরে গামছা বেঁধে কাদাপানি আর মলমূত্রের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সমর যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অদম্য সাহসী শাহাবুদ্দিন জয় বাংলাকে তাঁর শিল্পীসত্তার মূল মন্ত্র ভাবেন আজও। শক্তি সাহস ও বিশ্বাসের এই দৃঢ় অবস্থানকে নির্ভয়ে প্রকাশে তাঁর মধ্যে কোনো সংকোচ দেখি না। দ্বিধাহীন চিত্তে শাহাবুদ্দিন সত্যের ব্যাকুল মহিমা নিয়ে অসত্যের মোকাবিলা করেন। শাহাবুদ্দিনের চিত্রে বিজয় আর বিপ্লবের ঔজ্বল্য নতুন এক মাত্রার সংযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে।  উল্লাস, আনন্দ এবং জাগরণকে তিনি মোটা তুলির আঁচরে উদ্যত সাহসী ও শক্তিমান করে জাগিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার ক্ষিপ্রতা, বাংলার নদী, বনাঞ্চল, চর, নারী ও নারীর শরীরের ভাঁজ শাহাবুদ্দিনের চিত্রকর্মে বিরাট ব্যঞ্জনা পেয়েছে।

শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে লেখক শাহরিয়ার মাহমুদ প্রিন্স। ছবি- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ। 

শাহাবুদ্দিনের বাচনভঙ্গি নির্মল ও স্বতন্ত্র।  তাঁর কণ্ঠে ও দেহের ভাষায় যুদ্ধের বিবরণ শোনার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর কলাবাগানের বাসার ছাদে অনেক বার আমি আড্ডার আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হয়েছি। চিত্তের ব্যাকুল তৃষ্ণা নিয়ে তাঁর বচন শুনেছি। বাংলাদেশ, শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের উপলব্ধি আমাকে সচেতন করেছে এবং মনের মধ্যে জেগে থাকা সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তিকে অস্বীকার করে নিঃসংকোচ হতে সাহায্য করেছে। শিল্পীর সাথে আমার যোগাযোগ ২০০১ সালে। বিশ্ববরেণ্য শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদকে সেবারই আমি সরাসরি প্রথম দেখি। তিনি ফ্রান্স থেকে ফিরে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন। আমি টেলিভিশনে তাঁর ইন্টারভিউ দেখছিলাম। আব্বাকে বললাম: ‘আমি ঢাকা যাব, শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সাথে পরিচিত হব। আমাকে কিছু টাকা দেন। আব্বা আমাকে ১৫০০ টাকা দিলেন। চারুকলার অধ্যাপক নিসার হোসেনকে ফোন করে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ করে দিতে অনুরোধ করলেন। নিসার ভাই আমাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনি বললেন: ‘দু-একদিনের মধ্যে শিল্পী শাহাবুদ্দিন চারুকলা ইন্সটিটিউটে আসবেন, আপনাকে ডেকে নিব।‘ নিসার ভাই আমাকে সুযোগ করে দিলেন শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের। শিল্পী সেদিন কলমের আঁচরে একটা স্কেচও এঁকে দিয়েছিলেন আমাকে। তিন ঘণ্টা তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার অন্তর মুগ্ধ হয়েছিল। আমার আগমনের বিবরণ নিসার ভাই শিল্পী শাহাবুদ্দিনকে যখন জানালেন তখন তিনি বিস্ময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুলে বলেছিলেন, আবার দেখা হবে তোমার সাথে। হ্যাঁ, শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সাথে অনেকবারই দেখা হয়েছে।

শাহাবুদ্দিন ভাই শিশুর মতো সরল মানুষ। এমন সরল সহজ ও উচ্ছ্বাসে অনর্গল হতে হলে মানুষের মধ্যে শিশুমন থাকতে হয়। সরলতা না থাকলে খাঁটি মানুষ হওয়ার সুযোগ কম। শাহাবুদ্দিন ভাই তাঁর সহজাত সরলতা দিয়ে দ্রোহ ক্ষিপ্রতা ও গতিকে শান্তির বারতা দিয়ে এঁকেছেন। দ্রোহে যেমন শেখ মুজিবের আহ্বানকে তিনি অবলম্বন করেছেন, তেমনি শান্তির জন্য গান্ধীর কাছে ছুটে গেছেন। তাঁর অতল আগ্রহে শেখ মুজিবের প্রতিটি ক্যানভাস বাঙালির পরিচয়কে ঋদ্ধ করেছে। শাহাবুদ্দিন শেখ মুজিবের বিশালতা ও উদারতার মধ্যে এক বৃহৎ বাঙালির সন্ধান পেয়েছেন। সেই বৃহৎ বাঙালিই তাঁর সকল প্রেরণার মূল উৎস। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর অনেক চিত্রকর্ম। এসবের অনেকগুলোই তিনি আমাকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। ঘাতকের আঘাতে বঙ্গবন্ধুর দেহ সিঁড়িতে পড়ে আছে, অথচ রক্তাক্ত দেহের মধ্যেও মানুষকে ভালোবাসার মতো নিষ্পাপ বঙ্গবন্ধুর দুখানা চোখ জ্বলজ্বল করছে। বড় মর্মান্তিক ও বেদনাবিধূর এসব ছবি। এ ছবিগুলো দেখে অশ্রুসজল হয়েছি। আবার মেঘনার তীরে জেগে ওঠা বালুচর, প্রমত্তা নদীর ঢেউ, রমণীর শরীরের স্নিগ্ধতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকতে পারিনি।

''ফ্রান্স সরকার তাঁকে (শিল্পী শাহবুদ্দিনকে) নাইট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছেন। শাহবুদ্দিনকে তাঁরা নাগরিকত্ব দিলেও তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের বাইরে কোনো দেশের নাগরিক তিনি হবেন না। তিনি স্বদেশের সবুজ ঘাসে, মেঘনা নদীর তীরে তাঁর পরিচয়কে বেঁধে রাখেন এখনও।''

শাহাবুদ্দিন ভাইকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, অতল শ্রদ্ধার মানুষ তিনি। আমার জীবনকে যদি সামান্যতম সার্থক মানার সুযোগ থাকে, আমি কিছুতেই শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সান্নিধ্য ও অপার স্নেহের কথা না বলে থাকতে পারব না। দীর্ঘ উনিশ বছর তাঁকে চিনি ও জানি, আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগকে তিনি আরও গভীর ও ঘনিষ্ঠ করেছেন। তাঁর অকুণ্ঠ স্নেহ ভালোবাসায় আমার জীবন আনন্দময় হয়েছে। তিনি আমার দৃষ্টিকে বিভ্রান্তমুক্ত ও সচেতন করেছেন। বিপুল উৎসাহে সেই বোধ নিয়েই আমি বাংলাদেশকে জানার আগ্রহ পেয়েছি।

বাঁ দিক দিক থেকে লেখক, শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ। ছবি- ব্যক্তিগত সংগ্রহ। 

শিল্পী শাহাবুদ্দিন প্রবাস জীবন নিয়ে চার দশকের অধিককাল প্যারিসে আছেন। ফ্রান্স সরকার তাঁকে নাইট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছেন। শাহবুদ্দিনকে তাঁরা নাগরিকত্ব দিলেও তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের বাইরে কোনো দেশের নাগরিক তিনি হবেন না। তিনি স্বদেশের সবুজ ঘাসে, মেঘনা নদীর তীরে তাঁর পরিচয়কে বেঁধে রাখেন এখনও। বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে তিনি প্রবাসে গর্ব নিয়ে আছেন। শাহাবুদ্দিনের সকল আনন্দ, সকল উচ্ছ্বাস শাশ্বত বাংলাকে নিয়ে এবং তাঁর নিবিড় ভালোবাসা বঙ্গবন্ধুর প্রতি।

 

লেখক- সাংবাদিক, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী।

দ্রষ্টব্যঃপ্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব  

 

জাগরণ/এসকেএইচ