• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২১, ০৫:০১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৪, ২০২১, ০৫:০১ পিএম

স্মরণঃ

নানা আপনাকে সেলাম

নানা আপনাকে সেলাম
গম্ভীরা শিল্পী কুতুবুল আলম।

গ্রীক সভ্যতায় দেবতা দিওয়ানুসুসের নামে যে দেবতার সন্ধান পাওয়া যায় তিনি লৌকিক দেবতা। গ্রীসের জনগণ দেবতা দিওয়ানুসুসের জন্য লোকগানের প্রচলন ঘটিয়ে দেবতার তুষ্টি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কৃষি ভূমিতে ফসল যেনো বিনষ্ট না হয়, কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ যাতে শস্য বা ফসলের ক্ষতি করতে না পারে, এজন্য ত্রাতারূপী দেবতা দিওয়ানুসুসের কাছে গ্রামবাসী কৃপা প্রার্থনা করতেন। ‘ডিথারাম্বি’ তাদের লোকগীতি। এই লোকগীতি গেয়েই তারা দেবতার মনকে নরম ও দয়াময় করেছেন। এরই সাদৃশ্য খুঁজে পাই ‘গম্ভীরা’ গানে। সনাতন ধর্মের ক্ষমতাবান দেবতা মহাদেবের কাছে বাংলার জনগণ হৃদয়ের ব্যাকুলতা দিয়ে আশীর্বাদ কামনা করেছে একই আকাঙ্ক্ষায় এবং একই উদ্যোগে। রুদ্র, কঠিন মহাদেব তাতে সিক্ত হয়ে করুণা দান করেছেন। দেবতাকে নিবেদন করা সঙ্গীত একসময় আকার ও পরিক্রমায় ঋদ্ধ হয়েছে। গানের সঙ্গে সংলাপের যোগসূত্রে মনোরম এক লোকসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে। দেবতার এই আশীর্বাদ লাভ করা সহজসাধ্য ছিল না। উদাসীন এ দেবতা সব দেবতার মতোন সুশীলও নন। গৃহে বসবাসে তাঁর উৎসাহ নেই। তাই উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করেন। গাঁজা সেবন করেন তিনি। এমন এক রুদ্র দেবতাকে মুগ্ধ করতে বাংলার মানুষ কৌশলি হয়েছিল, তাঁকে হাস্য-রস ও পরিহাসময় সংলাপ ও গানে তুষ্ট করাকে তারা ধর্ম বলে মেনেছেন। মহাদেব তাতে সন্তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ দানে কোনো কৃপণতা করেননি। প্রাকৃতজনেরা ফসলের ভূমিতে উৎপাদনমুখী শস্য সম্ভার নিয়ে চিরদিনের দুঃখ ও কষ্টকে বর্জন করতে চেয়েছিল। খুবই নৈতিক দাবি নিয়ে দেবতার স্তুতি লাভকে তারা ধর্মের অংশ বিবেচনা করেছে। এক সময় এই দাবিটি ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়েছে। শিব হয়েছেন মানুষ; তখন গম্ভীরাগান প্রকাশিত হয়েছে শিবের গাজন হিসেবে।

লোকায়িত জনগণ জীবনের জটিল ও কঠিন প্রার্থনায় নিমগ্ন না হয়ে লৌকিক দেবতাকে তুষ্ট করতে অতি সহজ ও সরল সংলাপ এবং হাস্যরস, ঠাট্টা-তামাশাকে বেছে নিয়েছিলো। প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তিতে সালতামামির বিবরণ উপস্থাপন করে তারা আনন্দ বিতরণ করেছে। এক বছরের ঘটে যাওয়া ঘটনারাজির বিবরণ দিতে গিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হন দুজন মানুষ। একজন হলেন লোকায়িত বাংলার জনতার প্রতিনিধি। অন্যজন জ্ঞানী ও বয়সে বয়োজ্যেষ্ঠ। আঞ্চলিক ভাষায় তাদের গান এবং সংলাপে ঠাট্টা-তামাশার সাথে যুক্ত হয়েছে কঠোর বিদ্রূপ। সমাজের অনাচার-অবিচারকে তারা তুলে ধরেছেন দেবতা শিবকে সাক্ষি রেখেই। সমাধানের জন্য পথ দেখিয়ে তারা গম্ভীরাকে বৈচিত্রময়ও করেছেন।

মালদহ জেলাতে গম্ভীরার আদি নিবাস এমন মতামত সর্বাগ্রে। ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগে গম্ভীরাও খণ্ডিত হলো। সমাজ ও রাষ্ট্রের নতুন রূপ পরিগ্রহ করল গম্ভীরা। এদেশের ভূমিতে শিবের গাজন থাকলো না। মর্তে আর শিব এলেন না। নানা-নাতিই দর্শক সারির একজনকে সমাধানকর্তা হিসেবে বিবেচনা করে হাস্যরস, ঠাট্টা-তামাশার মাধ্যমে জীবনের দুঃখ-বেদনা, সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ শুরু করলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রহনপুরের সুফী মাস্টার এই ধারার প্রবর্তক বলা যায়। সাহসী সুফী মাস্টার ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে তাঁর জীবন জর্জরিত হয়েছে। কিন্ত লোকসঙ্গীত সাধনায় তিনি থেমে থাকেননি। সুফী মাস্টার এক সময় নাটকের অভিনেতা কুতুবুল আলমকে পেলেন। কুতুবুল আলমও এক বিস্ময়কর মানুষ ও প্রতিভাধর শিল্পী ছিলেন। খুব সহজেই কুতুবুল আলম এই নবধারার গম্ভীরাকে রপ্ত করে নিলেন। এরপর তার সাথে যোগ হলেন নাতি রকিবউদ্দিন। যার ফলে কুতুবুল (নানা), রকিবউদ্দিন (নাতি) মিলে গম্ভীরাগানের মাধ্যমে মঞ্চকে আলোকিত করে বাজিমাত করেছেন। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে তাঁর সরকারের সমালোচনা করেছেন এ জুটি। বঙ্গবন্ধু কুতুবুল আলমকে স্নেহ  ও উদার ভালোবাসা দিয়ে কতভাবেই না সযত্নে রেখেছিলেন। বাংলাদেশের সব সাংস্কৃতিক আয়োজন-উৎসবে গম্ভীরাকে উপস্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। বেতার-টেলিভিশনে কুতুবুল আলম-রকিবউদ্দিন জুটি গম্ভীরা গান পরিবেশনের সুযোগ পেলেন; সেটাও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। কুতুবুল আলমের সাথে তাঁর ‘বড়নানা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক নিয়ে সবিস্তার বিবরণ দেয়া আমার আজকের উদ্দেশ্য নয়। তবে এ সত্যটুকু জানাতে চাই যে, কুতুবুল আলমকে বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন লোকসঙ্গীতের একনিষ্ঠ শিল্পী হিসেবেই শুধু নয়; বরং বঙ্গবন্ধু যখন জানলেন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে কুতুবুল আলম কারাভোগ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্র শহিদ হয়েছেন এবং দুই সন্তান যুদ্ধাহত তখন থেকেই তাঁর প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কুতুবকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি।

কুতুবুল আলম অসামান্য দক্ষতা দিয়ে ও বঙ্গবন্ধুর স্নেহ-সান্নিধ্য পেয়ে গম্ভীরা গানকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ছিল নিজস্ব একটি ভঙ্গি। ভাষা ও গানের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কুতুবুল আলম মর্তের ক্ষমতাবান শক্তি বা শাসকের কাছে সমাজ-রাষ্ট্রের অভাব-অনাটন আর সমস্যার কথা বলেছেন আমৃত্যু। সমাধানের সূত্রও বলে গেছেন। তাঁর উপস্থাপনের গুণে ক্ষমতাবান মন্ত্রীরা আশু সমাধানে সামান্য বিলম্বও করেননি। উদাহরণযোগ্য হতে পারে নাটোরের টেলিভিশন সম্প্রচার সাব-স্টেশন স্থাপন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন, পরিবার-পরিকল্পনা ও যৌতুকবিরোধী কার্যক্রমের সাফল্য কিংবা রেল ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করা।

লোকায়িত জনগণের শিল্পসত্ত্বা বিবেকবান সভ্য সমাজে প্রাকৃতজনের সংস্কৃতি বলে শেকড়ের দাবি তুললেও আদৌতে এই শিল্পের পরিতোষণ কিম্বা মূল্যায়ণে কোথায় যেন আমাদের কৃপণতা আছে। রাষ্ট্রে যারা এসব ধারণ করবেন, যে সব প্রতিষ্ঠান এগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করবেন তারা সবাই প্রাকৃতজনের সংস্কৃতি নিয়ে বড়ই উদাসীন। নির্লিপ্তও বটে। কুতুবুল আলমের গম্ভীরা বা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলকাপ, কবিগান, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, পুঁথি পাঠ এসবই তো হারিয়ে যেতে বসেছে। আঞ্চলিক ভাষার সংস্কৃতিকে সযত্নে সংরক্ষণ না করলে সমাজ-রাষ্ট্র যে একদিন সংস্কারহীন হয়ে যাবে- এটা বধিরও জানে। কিন্ত সংস্কৃতির ধারক কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এ বিষয়ে কোনও আগ্রহ নেই। ফলে গম্ভীরার মতো লোকসংস্কৃতি ক্রমে ক্রমে দুর্বল হয়ে ওঠেছে সঠিক যত্নের অভাবে। আমরা চাই প্রাকৃতজনের সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা না করে এর কলাকুশলীদের মূল্যায়ণ এবং একে সমহিমায় টিকিয়ে রাখতে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি।

কুতুবুল আলম যে লোকসংস্কৃতিকে ধারণ করেছিলেন সেই সংস্কৃতিটি সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের শিল্প ছিল না। নিতান্তই দরিদ্র দুর্দশাগ্রস্থ ক্ষুধিত জনমানুষের কষ্ট-দুঃখ ও আনন্দের সহযোগে প্রণীত এক মর্মকথার সংস্কৃতি এটি। প্রাকৃতজনের সংস্কৃতিকে কুতুবুল আলম সমাজের পরিচিত, সম্ভ্রান্ত শ্রেণির শিল্পের খোরাক করেছিলেন। জমিনের লোকসংস্কৃতিকে তিনি আসমানের মতো উঁচু স্তরে বসবাসকারীদের জন্য শ্রবণযোগ্য করে যে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলেন, আমার তা শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। জেনেছি, কুতুবুল আলম গম্ভীরা নামক লোকসংস্কৃতিটিকে জনপ্রিয় করবার জন্য কতই না শ্রম দিয়েছেন। ক্ষণজন্মা এই শিল্পী গম্ভীরাকে সজীব  ও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার মতোন মহতি ও অসাধ্য কর্ম সাধনের মাধ্যমে সমগ্র লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্ত কুতুবুল আলমের নাম কে বা আজ স্মরণ করেন? লোকসংস্কৃতির কীর্তিমান শিল্পীদের খুব সহজেই ভুলে যাওয়া যায়। তারা সভ্য সমাজের কাছে খুব সম্মানীত বলে বিবেচিত হন না। বাংলা একাডেমি বা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কুতুবুল আলমদের মতো লোকসংস্কৃতির সাধকদের কি খুব মনে রেখেছে? নিশ্চয় রাখেনি। কুতুবুল আলমের স্মরণে তাঁকে মরণোত্তর সম্মাননা দিয়েও এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ স্বীকার করতে পারতেন। দায়মুক্ত হতেন। কিন্ত এটিও করেননি তারা। তাদের সামনে এর চেয়েও অধিক গুরুত্বের কাজ জমা হয়ে আছে। সেই সব কাজের ফিরিস্তি অনেক বৃহৎ তালিকার। সেখানে হয়তো কুতুবুল আলমেরা অর্বাচীন, গেঁয়ো ও মূর্খ্য!

কুতুবুল আলমকে রাষ্ট্রীয় কোনও সম্মান বা পদক দেয়া হয়নি। কেন দেয়া হয়নি এমন একটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে বলবার কারণ হয়তো একটা আছে। বলবার প্রয়োজন আছে, কুতুবুল আলম যদি গম্ভীরা না করে সিনেমাজগতে থেকে যেতেন কিম্বা নাট্য নির্দেশক-অভিনেতা হিসেবে মধ্য পঞ্চাশ দশকে যে জীবন শুরু করেছিলেন সেখানেই থিতু হতেন, আমি নিশ্চিতভাবে জানি তাঁকে পদক আর সম্মাননা দিয়ে মুখোরিত রাখা হতো। কুতুবুল আলমের অপরাধ তিনি লোকসংস্কৃতির সাধক, তিনি গম্ভীরাগানের ‘নানা’। তিনি বাংলার প্রাকৃতজনের লোকায়িত সংস্কৃতিকে লালন করেছেন। আরও বড় অপরাধ হলো কুতুবুল আলম বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুজিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। মুজিব অন্তপ্রাণ কুতুবুল আলম সত্যিকার অর্থেই সাহসী ও সৎ মানুষ ছিলেন। সামরিক শাসক কিম্বা সাম্প্রদায়িক জামাত-বিএনপি জোট সরকার তাঁকে মূল্যায়ণ করবে না এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সরকার ক্ষমতায় থেকেও যখন তাঁর মতো এক গুণী ও সব হারানো মানুষের সম্মান কপালে জুটে না তখন হতাশ না হয়ে কি কোনও উপায় আছে?

আমি এটা জানি যে, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিবান মানুষের কদর করেন। তিনি যদি জানেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য কুতুবুল আলম আজ অবধি রাষ্ট্রীয় কোনও সম্মান লাভ করেননি, নিশ্চয় তিনি তার সঠিক মূল্যায়ণ করবেন। সেই সময়কালের জন্য আমার যত অপেক্ষা।

১৪ই ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে কুতুবুল আলমের জীবনবাতি চিরতরে নিভে গেলেও তিনি অমর ও অজেয় হয়ে আছেন বাঙালিদের অন্তরে। বাংলা ভাষার লড়াকু সৈনিক, বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ কুতুবুল আলমকে তাঁর মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। রাষ্ট্র তাঁকে কি দিলো বা কি অবিচার করলো এর চেয়ে বেশি জরুরি হলো তিনি আজীবন লোকসংস্কৃতির মাঝে চিরশান্তি খুঁজেছেন। আর এই চিরশান্তি নিয়েই বাংলার গণমানুষের মধ্যে আনন্দ বিতরণ করেছেন সমানতালে। এমন মানুষের মৃত্যু হয় না। তিনি জাগ্রত থাকেন জাগতিক সুখ-শান্তি, আনন্দ-বেদনা এবং প্রবঞ্চিত মানুষের অধিকারের দাবি নিয়ে। মৃত্যুদিবসে নানা আপনাকে সেলাম।

 

লেখক ● সাংবাদিক, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী।। 

 

এসকেএইচ //