সিএবি থেকে সিএএ, অর্থাৎ নাগরিকত্ব আইন হওয়ার প্রক্রিয়ার সময় থেকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে গোটা ভারত। রাজনৈতিক দল তো বটেই, সামাজিক সংগঠন, যুব সংগঠন এমনকী সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও উঠে আসছে একের পর এক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। যার জেরে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাটসহ আসমুদ্রহিমাচলে আগুন জ্বলছে। এর রেশ এসে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও।
এই বাংলায়ও স্টেশনে আগুন লাগানো, প্ল্যাটফর্মে ভাঙচুর, ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলার চেষ্টা- সবই হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রায় রোজই হুঙ্কার ছাড়ছেন দিল্লির মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। বামপন্থী এবং কংগেসের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলও তাদের কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। কিন্ত এর মধ্যেই এনআরসি আতঙ্ক যে কোন গভীরে পৌঁছেছে, তা স্পষ্ট হয়েছে দুটি মৃত্যুর ঘটনায়। সত্যি সত্যি এনআরসি হলে শেষ পর্যন্ত ভিটেছাড়া হতে হবে এই আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নতুনগ্রামের আব্দুস সাত্তার শেখ এবং আবুল কাশেম শেখ। এর আগে বর্ধমানেরই জৌগ্রামের বাসিন্দা শিপ্রা শিকদারের মৃত্যু হয়েছিল ঠিক একইভাবে। তার পরিবারের সদ্স্যরা অভিযোগ করেছিলেন, শিপ্রাদেবী বেশ কিছুদিন ধরেই মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন এনআরসির কারণে। শেষ পযন্ত হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি।
শিপ্রাদেবীর মৃত্যু যখন ঘটে তখনও ভারতের সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশই হয়নি। আসামের এনআরসি প্রক্রিয়া চলছিল। সেই আতঙ্কই গ্রাস করেছিল তাকে। সেই কারণেই ওই ঘটনাটিকে এতদিন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্ত শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) বর্ধমানের দুই বৃদ্ধের মৃত্যু এনআরসি আতঙ্কের বিষয়টি আর ততটা সহজ থাকতে দিচ্ছে না। মারাত্মক এক অবসাদ চেপে বসছে নাগরিকদের ওপরে।
কাটোয়া থানা এলাকার নতুনগ্রামের এই দুই বাসিন্দার মধ্যে ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। তাদের পরিবারের দাবি, এনআরসির ভয়ে বেশ কয়েকটি নথিতে ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করছিলেন তারা। আর তা করতে গিয়ে দিন কয়েক ধরে তুমুল হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়েছিল তাদের। এতেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সাত্তার ও কাশেম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে পরিবারের অভিযোগ। কাটোয়া-২ ব্লকের কড়ুই পঞ্চায়েতের নতুনগ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা কাশেম বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরিবারের দাবি, তিনি সুস্থই ছিলেন। কিন্তু এনআরসির জন্য জমির দলিল, পরচা, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড প্রভৃতি নথিতে ভুল সংশোধনের জন্য কয়েকদিন ধরে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ছেলেদের বেশ কয়েকবার দুশ্চিন্তার কথা বলেওছিলেন। আর সেই কারণেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।
কাশেমের ছেলে হাসিবুল, ইমারুল, মনিরুলরা বলেন, বাবা সুস্থই ছিলেন। কিন্তু কিছু কাগজপত্র জোগাড় করতে পারছিলেন না। আসলে পুরনো জমির দলিল জোগাড় করা সম্ভব নয়। আধার কার্ড সংশোধন করতেও সময় লাগছিল। কাজ হচ্ছিল না। আমাদের বলতেন, এনআরসি করে অন্য দেশে তাড়িয়ে দেবে। এসব চিন্তাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। ভাইপো শেখ সফিকুল ইসলাম বলেন, গোটা গ্রামের মানুষের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, জমির দলিলে ভুল আছে। আমরা কীভাবে সংশোধন করব বুঝে পাচ্ছি না। এসবের জন্যই আমাদের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
কাশেমের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর শুক্রবার ভোর সাড়ে ৩টা নাগাদ ওই গ্রামেরই পূর্বপাড়ার বাসিন্দা আবদুস সাত্তার শেখ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার ছেলে বলেন, আগের দিনও খামারে ধান ঝাড়ার কাজ করেছেন বাবা। তবে এনআরসির জন্য পুরনো জমির দলিল ঠিক করতে পারছিলেন না। তা নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন। সম্ভবত সেই কারণেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমরা প্রশাসনকে পুরো বিষয়টা জানাব।
এফসি