• ঢাকা
  • বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০১৯, ০৪:৪৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২৫, ২০১৯, ১২:১১ পিএম

১৯ বছরেও বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট না শেখার নেপথ্যে

১৯ বছরেও বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট না শেখার নেপথ্যে
২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন পর্যন্ত এই ফরম্যাটে মোট ১১৭টি ম্যাচ খেলে ফেলেছে। ফটো : বিসিবি

চলতি বছর টেস্ট ক্রিকেটের অতি নবীন সদস্য আফগানিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরের মাঠে ২২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হারায় সাদা পোশাকের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অতীতের যৎসামান্য অর্জনকেও সমর্থকদের কাছে তুচ্ছ মনে হতে থাকে। ভারত সফরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পা রাখা বাংলাদেশ যেন দুইটি টেস্টেই তিনদিনে ইনিংস ব্যবধানে হেরে প্রমাণ করে ছাড়লো অনেকটা সাত সাগর পাড়ি দিয়ে সৈকতে পড়ে থাকার মতোই তারা ১৯ বছরেও টেস্ট ক্রিকেট বুঝতেই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
 
ক্রিকেটারদের টেম্পারমেন্ট ধরে রাখতে না পারা, ব্যাটসম্যানদের বাজে শট খেলে প্রতিপক্ষকে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার প্রবণতা, বাউন্স বল খেলার দুর্বলতা, যাচ্ছেতাই ফিল্ডিং, অর্থের ঝলকানিতে টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন পোষণ না করে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহ থাকা, ঘরোয়া ক্রিকেটের মান উন্নয়ন না করা এবং নিয়মিতভাবে তা মাঠে না গড়ানো, পেসবান্ধব উইকেট তৈরি না করা, তিন ফরম্যাটের আলাদা দল গঠনে নির্বাচকদের ব্যর্থতা- এসবই যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এক অন্ধকার অধ্যায়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। 

বিশ্বমানের লেগ স্পিনার খুঁজে পাওয়াকে যেন টিম ম্যানেজমেন্ট সোনার হরিণের মতো দুষ্প্রাপ্য এক বস্তুতে পরিণত করতেই বদ্ধপরিকর। বিপিএল তো বটেই, অতীতে ক্লাব ক্রিকেটেও বারবার দেখা গেছে একাদশে যেন তাদের ভরসা করে সুযোগ দিতে নেই! লাল বলেই যাদের রেকর্ড একেবারেই পক্ষে কথা বলছে না, গোলাপি বলকে তাদের কাছে বিন্দুমাত্র বোধগম্য হবে না এবং পাঠযোগ্য হবে না এটাই তো স্বাভাবিক।       

ইন্দোর টেস্টের দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে বাংলাদেশ দলের হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেই ফেলেন, কোনো সন্দেহ নেই দলের কাঠামোগত বদল আনতে হবে। না হলে ফল একই হতে থাকবে। নির্বাচকদের সঙ্গে বসে সামনে এগোনোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমাকে চিহ্নিত করতে হবে কোন কোন খেলোয়াড় দলকে সামনে এগিয়ে নিতে পারবে। যদি আমাদের নতুন মুখ নিয়ে এগোতে হয়, কিছুটা সময় ভুগতে হয়, আমার মনে হয় বর্তমানে যা হচ্ছে সেটির চেয়ে খারাপ কিছু হবে না। হ্যাঁ, এই দলে দারুণ কিছু খেলোয়াড় আছে তাদের সম্মান করতে হবে। বাংলাদেশের হয়ে তাদের পারফরম্যান্সকে সম্মান জানাতে হবে। তবে দলের স্বার্থই আপনাকে বড় করে দেখতে হবে।

টাইগারদের রক্ষণাত্মক ক্রিকেট খেলার কঠোর সমালোচনা করে দলটির সাবেক কোচ ডেভ ওয়াটমোরের সাফ কথা, হারের অন্যতম কারণ অবশ্যই রক্ষণাত্মক মনোভাব। আমি কোচ থাকাকালীন স্পষ্ট বলে দিতাম, হারতে রাজি আছি; কিন্তু লড়াই ছাড়া হারতে পারব না। মাঠে নেমে প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে দাও, বাংলাদেশকে ছোট দল হিসেবে দেখলে ভুল করবে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যে মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশ খেলে, টেস্টে তা মোটেও দেখা যায় না।

টেস্টে বাংলাদেশের পেস আক্রমণ বরাবরই দুর্বল। একটা সময় প্রতিভাবান পেসার তৃণমূল পর্যায় থেকে বের করে আনার জন্য বিসিবির উদ্যোগে ট্যালেন্ট হান্টের আয়োজনও করা হতো, যা এখন চোখেই পড়ছে না। অথচ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ওয়াটমোরের উপলব্ধি, পেস বিভাগে উন্নতি করতে না পারলে এই কাজ খুবই কঠিন। 

২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন পর্যন্ত এই ফরম্যাটে মোট ১১৭টি ম্যাচ খেলে ফেলেছে। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ১৯ বছরের পথচলায় টাইগারদের পারফরম্যান্স কতটা মলিন, তা বোঝানোর জন্য মোটা দাগে একটি মাত্র পরিসংখ্যান উল্লেখ করাই যথেষ্ট। ১১৭ টেস্টের মধ্যে পরাজয়ের সংখ্যাই ৮৮টি, যার মধ্যে ইনিংস পরাজয়ের সংখ্যাই ৪২টি। মাত্র ১৩ জয়ের পাশাপাশি ড্রয়ের সংখ্যা ১৬টি। অর্থাৎ মাত্র ২৯ টেস্টে পরাজয়ের স্বাদ বরণ না করে বাংলাদেশ মাঠ ছেড়েছে। ড্র টেস্টের কয়েকটি আবার বৃষ্টির বদান্যতায় কপালে জুটেছিল। 

বাংলাদেশ দল টেস্ট আঙিনায় যেটুকু সাফল্য পেয়েছে, তার মাঝেও রয়েছে বিস্তর এক ফাঁক। এখনকার বাস্তবতায় পরিষ্কারভাবেই প্রতীয়মান হচ্ছে, সাফল্য অর্জনের পর অতিমাত্রায় আত্মপ্রসাদে ভুগতে থাকা ক্রিকেট দলটির গৌরবের মাঝে লুকিয়ে আছে শুভঙ্করের ফাঁকি! বিষয়টি অনুধাবন করতে হলে অতীতের কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা তাই এখন অতি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক এবং সময়ের দাবি। 

প্রথম টেস্ট জিততে বাংলাদেশকে ৩৫তম টেস্ট ম্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ঐতিহাসিক সেই টেস্ট তারা জিতেছিল অনেকটাই খর্বশক্তির দল হয়ে যাওয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

২০০৩ বিশ্বকাপেও সুপার সিক্সে উঠেছিল জিম্বাবুয়ে। দেশটির তৎকালীন স্বৈরশাসক রবার্ট মুগাবের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান জানানোর জন্য কালো আর্মব্যান্ড পরে মাঠে নেমেছিলেন হেনরি ওলাঙ্গা এবং অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। আর তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল মুগাবে সরকার। ফলাফল, ওলাঙ্গা ও অ্যান্ডির অপ্রত্যাশিত এবং দুঃখজনক অবসর। 

২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হেরে আসলেও হেনরি ওলাঙ্গা ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের বিদায়ের পর জিম্বাবুয়ের সর্বশেষ শক্তিশালী দলটির বিপক্ষে জয়ের কীর্তি নিয়ে দেশে ফিরেছিল টাইগাররা। তার কয়েকদিন পর জিম্বাবুয়ে সফরে যায় শক্তিশালী শ্রীলঙ্কা। কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় ভয়ানক এক ঘটনা। অতি মাত্রায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে জিম্বাবুয়ের জাতীয় দলের প্রায় সব খেলোয়াড় না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তারা আর কখনোই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলতে নামেননি। সেই ঘটনার রেশ জিম্বাবুয়েকে আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অপ্রিয় হলেও সত্যি, ২০০৫ সালে প্রথম সারির ক্রিকেটারদের হারিয়ে খর্বশক্তির দলে পরিণত হওয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই নিজেদের প্রথম টেস্ট জিতেছিল বাংলাদেশ।   

২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে তাদেরকে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ করতে সক্ষম হলেও তাতে যতটা না রয়েছে কৃতিত্ব, তার চেয়েও ঢের পরিমাণ অবদান রয়েছে বোর্ডের সঙ্গে জড়িয়ে ক্যারিবীয় ক্রিকেটারদের বিদ্রোহ করে না খেলার। অধিকাংশ ক্রিকেটার বিদ্রোহ করে ধর্মঘটে যাওয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড বাধ্য হয়ে তৃতীয় সারির মাঠে নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তাই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয় কতটা গৌরবের ছিল, সেই প্রশ্ন আজও থেকে যাচ্ছে। 

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের সব ম্যাচ ড্র করে টাইগাররা। তাতে সিরিজটাও ড্র হয় এবং দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে ভক্ত-সমর্থকরা আশাবাদী হয়ে ওঠেন। যদিও পরের সময়টা ছিল একরাশ হতাশার। তবে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোয় মানসিকভাবে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ একই বছর শক্তিশালী পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্ট ড্র করে সমর্থকদের আশান্বিত করেছিল। পরের বছর মিরপুর টেস্টে মাত্র তিনদিনেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে সাদা পোশাকেও বদলে যাওয়ার গান গাইতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গন।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০১৭ সালে মিরপুরের মাঠে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক টেস্ট জেতায় সবাই যখন ধরেই নিয়েছিল দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটেও টাইগাররা পরাশক্তি হতে চলেছে; তারা তখন হয়তো আবেগের বশবর্তী হয়ে বিবেচনা করেননি যে দুই দলের পার্থক্য গড়ায় মূল ভূমিকা রেখেছিলেন ম্যাচ সেরা সাকিব আল হাসান। ক্রিকেট দলীয় খেলা হলেও কখনো কখনো একজনের পারফরম্যান্সের উপর ভর করেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়। অজিদের বিপক্ষেও তেমনটি হয়েছিল। 

দুর্বল ক্রিকেট কাঠামো, খেলোয়াড়দের উপযুক্ত পাইপলাইন গড়ে না তোলা, দল গঠনে অনেকের অযাচিত হস্তক্ষেপ নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক কথাই উঠে আসে। তবে অতীতের অর্জন নিয়ে আলোচনার সময় তার ভেতর থেকে যাওয়া ফাঁক নিয়ে তেমন কেউ কথা বলেন না। সঠিক ইতিহাস না জানলে কিংবা তা জেনে উপলব্ধির জায়গা মানসিকভাবে ধারণ না করলে একটা সময় কতটা ভুগতে হয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। তাই সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, ক্রিকেটের জন্য সঠিক ও যোগ্য মানুষদের নিয়োগ দেয়া এখন অতি আবশ্যক হয়ে উঠেছে। সঠিক দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে উত্তম পরিকল্পনা প্রয়োগের মাধ্যমে বিভক্তির মাঝেও গোটা দেশের মানুষকে এক সুতোয় বাঁধতে পারা ক্রিকেট যেন আবারো ফিরে পায় তার সোনালী সময়। 

আরআইএস    

আরও পড়ুন