• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০১৯, ০৪:১৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ৬, ২০১৯, ০৫:৩৮ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (১৭)

সেই আঁধারেও খুনিদের মুখ চেনা 

সেই আঁধারেও খুনিদের মুখ চেনা 

নভেম্বর মাসের ৭ তারিখটা সামনে এসে দাঁড়ালে আমার বুকটা মোচড় দিতে থাকে। যে মুখটা চোখের সামনে ভাসে, বিশেষ করে তিনি আমার নিকটাত্মীয়। আমার আপন চাচাতো বোনের মধ্যম পুত্র। সম্পর্কে আমার ভাগিনা হলেও আমার চেয়ে ৮-১০ বছরের বড়। তাই তাঁকে আমি মামা বলে সম্বোধন করি। আকমল খান। আমার দুলু মামা।

অতিশয় স্নেহবৎসল, সজ্জন, অমায়িক, সুদর্শন, সুরুচিসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষ। বাংলাদেশ টেলিভিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পঁচাত্তরের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ সকাল সাড়ে নয়টায় অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু গেটে ঢোকার মুখে তাঁকে আটকানো হয়। আটকানো হয় উপরিচালক মনিরুল আলম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ এফ এম সিদ্দিকীকেও। আটকালো কারা তাদের? কেন আটকালো?

এই ‘কেন’র বিষয়ে পরে আসছি। এর আগে বলি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে জাতির জনককে হত্যা করার সময় যে নৃশংসতা ঘটেছিল, তারই ধারাবাহিকতা ছিল ৩ নভেম্বরের লোমহর্ষক জেলহত্যা। এবং সেই একই মানবতার বহ্ন্যুৎসব ঘটেছে ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সেনা অভ্যুত্থানের আচ্ছাদনে। পুরো ব্যাপারটাই ছিল একাত্তরের পরাজয়ের হিংস্র প্রতিশোধ। এর প্রধান লক্ষ্যই ছিল ভারত বিরোধিতা। ভারতে সক্রিয় সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং পাকিস্তানের মুখের গ্রাস হাতছাড়া হয়ে গেছে। এই ক্ষোভে উন্মত্ত পাকিস্তানি-মার্কিন-সৌদি চক্র ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র, বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, নানা ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল শুরু থেকে, যা এখনো পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ৭ই নভেম্বর তথাকথিত সিপাহি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক হিংস্র উন্মাদনার যে চাষ শুরু হয়েছিল, তারই কদর্য ছাপ পরিলক্ষিত হলো দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কেন্দ্রস্থল টেলিভিশন চত্বরে। মুক্তিযুদ্ধের বীর স্থপতিদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যার পর বুদ্ধিজীবী নিধনের সূচনা করা হলো টেলিভিশনের চার মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীর প্রাণসংহারের মধ্য দিয়ে।

ঠিক কী কারণে এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল, তা আজও স্পষ্ট হয়নি। তবে এই হত্যার সূত্র ধরে অগ্রসর হলে অনেক চাঞ্চল্যকর রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে বলে আমি মনে করি। তবে ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষের সেনা অফিসারদের হত্যার যে পরিকল্পনা চক্রান্তকারী শিবির করেছিল, এ ক্ষেত্রেও এর একটি প্রভাব ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ক্ষোভ, বিক্ষোভ, বঞ্চনা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে তাদের হত্যা করা হয়।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রেডিও ও টিভি স্টেশনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ওই সময় দাবি-দাওয়া নিয়ে বিটিভির তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কল্যাণ সমিতির আন্দোলন চলছিল। ওই অবস্থায় রামপুরা টিভি ভবনে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর অনারারি লেফটেন্যান্ট (অব.) আলতাফ হোসেনের সঙ্গে কর্মচারী নেতাদের সমঝোতা হয়। তাদের দাবি আদায় করা হবে বলেও আশ্বাস দেয়া হয়।

সিদ্ধান্ত হয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আটক করে দাবি আদায় করা হবে। তাতে রাজি না হলে তাদের খুন করা হবে।

’৭৫-এর ৬ নভেম্বর রাতে লেফটেন্যান্ট আলতাফসহ আন্দোলনকারীদের বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আটক করে দাবি আদায় করা হবে। তাতে রাজি না হলে তাদের খুন করা হবে। সেসময় বিটিভির নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা বলতে থাকেন, বিটিভির তৎকালীন মহাপরিচালক জামিল চৌধুরী, জেনারেল ম্যানেজার মোস্তফা মনোয়ার, ডিরেক্টর অব প্রোগ্রাম এম মনিরুল আলম, প্রধান হিসাবরক্ষক এম আকমল খান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ এফ এম সিদ্দিকী ভারতের দালাল।

পরদিন সকালে লেফটেন্যান্ট আলতাফের নেতৃত্বে সবাই বিটিভির গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন, কর্মকর্তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয় সাদা কাগজে সই নিয়ে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মনিরুল আলম, আকমল খান ও এ এফ এম সিদ্দিকী কার্যালয়ে এলে আলতাফ, বিটিভির সাবেক সহকারী পরিচালক আবুল কাশেম বাগোজা ও আব্দুল আউয়াল সরকার, প্রযোজক লুৎফর রহমান, অধিবেশন নিয়ন্ত্রক সৈয়দ আইনুল কবির, ডিউটি অফিসার আইনুজ্জামান ও মো. শাহজাহান মিয়াজী তাদের আটক করেন।

(উপরে বাঁ থেকে, ঘড়ির কাঁটার দিকে) মনিরুল আলম, এ বি সিদ্দিক, আকমল খান ও ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী

বিটিভির তখনকার মহাপরিচালক জামিল চৌধুরী ও জেনারেল ম্যানেজার মুস্তাফা মনোয়ারকেও সেদিন আটক করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেদিন অফিসে না আসায় তারা প্রাণে বেঁচে যান। আটক মনিরুল আলম, আকমল খান ও এ এফ এম সিদ্দিকীকে বিটিভির ১০১ নম্বর কক্ষে আটকে রাখা হয়। এরপর দুপুরের দিকে টিভি ভবনে আসেন ক্যামেরাম্যান ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি কর্মকর্তাদের আটকে রাখার প্রতিবাদ করলে তাকেও আটক করা হয়। ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ।

মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, ৭ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে বিটিভির সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়। ফিরোজ কাইয়ুম, এ এফ এম সিদ্দিকী ও আকমল খানকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় টিভি ভবনের পেছনে ঝিলপাড়ে। সেখানে অনারারি লেফটেন্যান্ট আলতাফের নেতৃত্বে আবুল কাশেম বাগোজা, আব্দুল আউয়াল সরকার, লুৎফর রহমান, সৈয়দ আইনুল কবির, আইনুজ্জামান ও মো. সাহজাহান মিয়াজী প্রথমে তাদের গুলি করেন এবং তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে ঝিলের পানিতে লাশ ফেলে দেন।

খুন করে লাশ ঝিলে ফেলে দেয়ার কথা শুনে পরদিন ক্যাপ্টেন আলতাফের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, মনিরুল ভালো আছেন, বিকেলের মধ্যেই বাসায় ফিরে যাবেন।

মনিরুলকে আটকে রাখার খবর পেয়ে স্ত্রী আনোয়ারা আলম তার ছোট ভাই স্বপনকে নিয়ে টিভি ভবনে ছুটে যান। সেখানে আলতাফ হোসেনের সঙ্গেও তাদের কথা হয়। আলতাফ তাদেরও গ্রেফতারের হুমকি দিলে বাধ্য হয়ে সেদিন তারা বাড়ি ফিরে যান। বোনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে স্বপন আবার রামপুরা টিভি ভবনের সামনে আসেন। খুন করে লাশ ঝিলে ফেলে দেয়ার কথা শুনে পরদিন ক্যাপ্টেন আলতাফের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, মনিরুল ভালো আছেন, বিকেলের মধ্যেই বাসায় ফিরে যাবেন। সেই থেকে কেটে গেছে ৪৫টি বছর, কিন্তু অদ্যাবধি মনিরুলের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

হত্যাকাণ্ডের ৪ দিন পর নিহতদের লাশ ভেসে উঠলে আবুল কাশেম বাগোজা ও আব্দুল আউয়াল সরকার, লুৎফর রহমান, সৈয়দ আইনুল কবির, আইনুজ্জামান ও মো. সাহজাহান মিয়াজী টেলিফোন ও টিভি অ্যান্টেনার তারের সঙ্গে ইট বেঁধে সেগুলো আবার ডুবিয়ে দেন। আকমল খান, এ এফ এম সিদ্দিকী, ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী ও মনিরুল আলমের কোনো খোঁজ না পেয়ে ১৯৭৫ সালের ১৯ নভেম্বর তাদের স্ত্রীরা গুলশান থানায় ৪টি অপহরণ মামলা করেন। ঝিলের পানি শুকিয়ে গেলে চাষাবাদের জন্য স্থানীয় লোকজন সেখানে লাঙল দিতে গেলে লাঙলের ফলার সঙ্গে তিনটি কঙ্কাল পাওয়া যায়। এদিনটি ছিল ১৯৭৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। কঙ্কালগুলোকে প্রথমে ঠেলাগাড়িতে করে গুলশান থানায় নেয়া হয়। এরপর সেখান থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে। পরীক্ষার পর কঙ্কালগুলো কাইয়ুম, সিদ্দিক ও আকমলের বলে চিহ্নিত করা হয়, তবে মনিরুলের কোনো চিহ্ন আজও মেলেনি।

জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ‘নামমাত্র তদন্ত করে’ ১৯৭৮ সালের ৯ জানুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ফলে আটকে যায় হত্যাকাণ্ডের বিচার। জেনারেল জিয়া যেমন আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করেছিল, তদন্ত কাজে বাধা দিয়ে জেলহত্যার বিচার বাধাগ্রস্ত করেছিল, তেমনি নানা কৌশলে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারও বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার বাধাগ্রস্ত করে।

তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিহত আকমল খানের স্ত্রী মনোয়ারা খান মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদন জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের ২০ জানুয়ারি মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করেন। সিআইডি আসামি আলতাফ হোসেন, আবুল কাশেম বাগোজা, আবদুল আউয়াল, লুৎফর রহমান ও আইনুজ্জামানকে গ্রেফতার করে। তাঁদের মধ্যে আলতাফ ও কাশেম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। উদ্ধার করা তিনটি কঙ্কালের ময়নাতদন্ত করা হয়। কঙ্কালের সঙ্গে থাকা পরনের কাপড় সংরক্ষণ করা হয়। ঘটনার ২৪ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৮ আগস্ট অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। ২০০২ সালে মামলাটি বিচারের জন্য প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। 

অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হচ্ছেন বিটিভির তৎকালীন সহকারী পরিচালক (এডি) আবুল কাশেম বাগোজা ও আবদুল আউয়াল সরকার, বিটিভির ১ নম্বর গ্রেডের প্রযোজক লুৎফর রহমান তালুকদার, অধিবেশন নিয়ন্ত্রক সৈয়দ আইনুল কবির, সেসময়ে বিটিভিতে কর্মরত কর্মকর্তা আইনুজ্জামান, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অনারারি লেফটেন্যান্ট আলতাফ হোসেন, ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সদস্য কে এ এম জাকারিয়া হায়দার ও শাহজাহান মিয়াজী। ২০০৪ সালে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আবুল কাশেম বাগোজা, আবদুল আউয়াল সরকার ও লুত্ফর রহমান তালুকদার তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন (কোয়াশমেন্ট) করেন। পরের বছরের ১৭ এপ্রিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই তিনজনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার আদেশ দেন। আসামি আইনুজ্জামান মারা যাওয়ায় ২০০৪ সালের ১০ মার্চ তাঁকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। বাকি পাঁচজন আসামির মধ্যে আলতাফ হোসেন ছাড়া আর সবাই জামিনে আছেন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ১৯ মে মনিরুল আলমের শ্যালক মহম্মদ আলী স্বপন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষ তাকে জেরাও শুরু করে। কিন্তু আসামিদের আবেদনে ওই বছরের ২৬ মে হাইকোর্ট এই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। আসামিদের মধ্যে আইনুজ্জামান ২০০৪ সালের ৪ জুন মারা যান। ২০০৫ সালের ১৭ এপ্রিল হাইকোর্ট আবুল কাশেম বাগোজা, আবদুল আউয়াল সরকার ও লুৎফর রহমান তালুকদারকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। 

মামলা চলাকালে আসামিদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও পরে তারা দীর্ঘদিন বিটিভিতে চাকরি করেছেন, এমনকী কাউকে কাউকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে, চাকরি শেষে তারা পেনশনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।

নওয়াজেশ আলী খানের ভাষ্য
‘প্রায় ৪০ বছর আগের কথা, ফলে সবকিছু নিখুঁতভাবে মনে নেই, থাকার কথাও নয়। সেদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিটিভির তৎকালীন উপমহাপরিচালক মনিরুল আলম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ এফ এম সিদ্দিকী, প্রধান হিসাবরক্ষক আকমল খানকে আটক করা হয়। দুপুরের দিকে ক্যামেরাম্যান ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী আসে এবং গেটে অবস্থানকারীদের সঙ্গে তার বাগ্‌বিতণ্ড‍া হয়। ফলে তারা ফিরোজকেও আটক করে। আমি তখন বিটিভির একজন প্রোডিউসার ছিলাম। ওই দিন সকাল ৯টার দিকে বিটিভির একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আমাকে পুরো বিষয়টি  জানায় এবং টিভি ভবনে না আসার জন্য বলে। ফলে আমি ওইদিন অফিসে যাওয়া থেকে বিরত থাকি।’

‘যে চারজনকে হত্যা করা হয়েছে তাদের তিনজনের স্ত্রী মারা গেছেন বলে আমি শুনেছি। আসামিদের কেউ কেউ ২০০৪ পর্যন্ত বিটিভিতে চাকরি করেছে। কয়েকজন এরইমধ্যে মারাও গেছে। যারা বেঁচে আছে তারাও বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছে।’

‘স্বাভাবিকভাবেই কর্মকর্তাদের পক্ষে সকল কর্মচারীর মন রক্ষা করা সম্ভব হয় না। ‍তাই কর্মকর্তাদের ওপর কারও কারও ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল। সেই সুযোগটাই ওরা কাজে লাগিয়ে জঘন্য ঘটনাটি ঘটিয়েছে।’

‘এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। প্রায় ৪০ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। পরিবারের সদস্যরা আবার একটু উদ্যোগ নিলেই বিচারকাজ সম্পন্ন হবে বলে মনে করি।’

যে দুঃখের শেষ নেই!
আকমল খানের স্ত্রী মনোয়ারা খান ছিলেন বুয়েট থেকে পাশ করা প্রথম নারী ইঞ্জিনিয়দের একজন। ওই বছর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় ৪ জন ছাত্রী উর্ত্তীণ হয়েছিল। শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে ‍তাদেরকে ভর্তি না করার সিদ্ধান্ত নেয় বুয়েটের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা এর বিরুদ্ধে মামলা করে বিজয়ী হয়।  

আকমল খানকে হত্যার পর তাঁর পরিবারের সদস্যদের সরকারি বরাদ্দকৃত বাড়ি থেকে বের করে দেয় জেনারেল জিয়া। বাসা থেকে আসবাবপত্র রাস্তায় ফেলে দেয় প্রশাসনের লোকজন। আকমল খানের মেয়ে টুম্পা তখন খুব ছোট। সারাটা জীবন বাবার স্নেহ আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে। বর্তমানে সে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। আর আকমল খানের স্ত্রী মনোয়ারা খান মারা গেছেন। স্বামীর বিচারের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দারস্ত হয়েছিলেন। প্রাধনমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিদের্শে বিচারকার্য শুরুও হয়েছিল।  তবুও মনোয়ারা আকমলের মনস্কামনা পূরণ হয়নি। সরকার পাল্টে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় সেই বিচার কার্যক্রম।
      
পঁচাত্তরে মনিরুল আলমের ছেলে রাশেদ আলমের বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। তখন পল্টনে ছিল তাদের বাসা। ঘটনার দিন রাতে সে বাসায় শুয়ে ছিল। কেউ একজন এসে খবর দেয় সেনাবাহিনী মনিরুল আলমকে আটক করেছে। খবর পেয়ে মনিরুল আলমের স্ত্রী তার ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী স্বপনকে নিয়ে টিভি ভবনে যান। অনারারি ক্যাপ্টেন আলতাফ তাদের বলেছিলেন, মনিরুল আলম ভালো আছেন এবং কয়েক দিন পর বাসায় ফিরে যাবেন। মনিরুল আলম আবার ফিরে আসবেন এই আশায় বুক বেঁধে ছিল ছেলে রাশেদ আলম। কিন্তু ৪৫ বছরেও তার সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এই দুঃখ বুকে নিয়েই সম্প্রতি রাশেদ মারা গেছে। রাশেদ আলম বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলার প্রধান ডিজাইনার হিসেবে কাজ করত। চাকরি হারানোর পর শুরু করেছিল ব্যবসা, বাড়ি বিক্রি করে বিনিয়োগ করে সেই ব্যবসায়। কিন্তু ব্যবসায় সে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে।

৪০ বছর ধরে বাবার লাশ খুঁজছি। শুনেছি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর গুলি করে বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিরা বাবার লাশ ফেলে দিয়েছিল বিটিভির পেছনের ঝিলে। কিন্তু সেই লাশ আজও পাইনি। এমনকী বাবার কঙ্কালটিও নয়।

মৃত্যুর আগে সে প্রায়ই বলত, ‘খুনের বিচার হয়নি। আর বিচার চাই না, বাবার লাশ চাই। ৪০ বছর ধরে বাবার লাশ খুঁজছি। শুনেছি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর গুলি করে বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিরা বাবার লাশ ফেলে দিয়েছিল বিটিভির পেছনের ঝিলে। কিন্তু সেই লাশ আজও পাইনি। এমনকী বাবার কঙ্কালটিও নয়। একজন সন্তান তার পিতার মৃত্যু ঠিক কবে হয়েছে জানে না। কোথায় তাকে কবর দেয়া হয়েছে তা জানা যায়নি। প্রত্যেক সন্তান চায়, তার বাবার কবর জিয়ারত করতে। খুনিরা সে সুযোগ আমাকে দেয়নি। অথচ আজও সেই খুনিরা বেঁচে আছে। তারা আমার মেয়েকে অপহরণের হুমকি দেয়। বাসার টেলিফোনে হুমকি দেয়। জানি, বাবাকে হারিয়ে কত কষ্টে আছি তা বোঝাতে পারব না। ৪০ বছর পরও খুনিরা নির্বিঘ্নে যখন ঘুরে বেড়ায়, তখন আর স্বাভাবিক মানুষ থাকতে পারি না। খুনি হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে।’

রাশেদের এই কথাগুলো গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছে। যে দুঃখ বুকে নিয়ে রাশেদ আলম মারা গেছে, বোধ করি সেই একই ধরনের বেদনার আগুন জ্বলছে আকমল খান, এ এফ এম সিদ্দিকী ও ফিরোজ কাইয়ুমের সন্তানদের মনে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হলে তারা কিছুটা হলেও সান্ত্বনা খুঁজে পাবে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমি বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি বিশেষ মিল খুঁজে পাই। বাস্তবিক এটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার বাংলাদেশি সংস্করণ। তাই প্রথম থেকেই জেনারেল জিয়ার সরকার এই  হত্যাকাণ্ডের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমি বর্তমান সরকারের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করছি। 

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

[ বি.দ্র : পরবর্তী পর্ব প্রকাশ হবে আগামী ১৩ নভেম্বর, বুধবার। ] 

আরও পড়ুন