• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০১৯, ০৩:৫২ পিএম

ছিটমহলে শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপক উদ্যোগ

ছিটমহলে শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপক উদ্যোগ
এম এ খালেক

 

------------------------------------------
‘‘১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার সময়ই মূলত এ সমস্যার সৃষ্টি করা হয়। এ ছিটমহল নিয়ে প্রায়শই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিবাদ এবং উত্তেজনা সৃষ্টি হতো। কিন্তু কোনো সরকারই এ সমস্যাটি সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কারণ এটা অত্যন্ত জটিল একটি সমস্যা ছিল। এর এঙ্গ রাজনীতি জড়িত ছিল। তাই কোনো সরকারই ছিটমহল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে সাহসী হয়নি’’
------------------------------------------

প্রধান শিক্ষক ডেকে আনার পর অত্যন্ত স্মার্টলি আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। নাম জানতে চাইলে সে বলল, তার নাম সোনালি আক্তার (৮)। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সোনালি জানাল, পড়াশোনা করতে তার খুব ভালো লাগে এবং সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায়। কথা বলার সময় তাকে খুবই আত্মপ্রত্যয়ী মনে হলো। সোনালির মতো মেয়েরাও ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তার বাবা একজন ট্রাক ড্রাইভার। অথচ কয়েক বছর আগেও সোনালিদের স্বপ্ন দেখা মানা ছিল। তারা জানত না ভবিষ্যতে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। কারণ সোনালি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দা। তারা ভারতের নাগরিক হলেও সে দেশের সঙ্গে তাদের সহজ যোগাযোগ ছিল না। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় চুক্তির আওতায় ‘গাবাতি’ এখন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সোনালিরা এখন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। আগে তাদের নাগরিকত্ব নিয়েও বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যেত।    

সম্প্রতি দেশের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড় ভ্রমণের একপর্যায়ে অধুনালুপ্ত ভারতীয় ছিট মহল ‘গাবাতি’ পরিদর্শন করি। এ সময় আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমন করি। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জনাব কেরামত আলি আমাদের অভ্যর্থনা জানান। তিনি জানালেন, ‘বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১৫০০ বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের আওতায় অধুনালুপ্ত ভারতীয় ছিটমহল (যা বর্তমানে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত) ‘গাবাতি’তে এই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয়েছে। তিনি ও অন্য একজন শিক্ষক শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বিদ্যালয়ে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৩০ জন। এরা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আগে এ ছিটমহলে কোনো বিদ্যালয় ছিল না। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ছিটমহল বিনিময় চুক্তির আওতায় ভারতীয় এ এলাকাটি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ বিদ্যালয় এলাকাসংলগ্ন অঞ্চলে আনুমানিক ১ হাজার পরিবার বাস করে। এদের জন্য আগে কোনো স্কুল ছিল না। ছিটমহলটি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সরকার এখানকার মানুষের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই অংশ হিসেবে এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দোতলা পাকা ভবনে বিদ্যালটির কার্যক্রম চলছে। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলামের নামে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয়টি উদ্বোধন করেন। প্রায় ৩ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি চা বাগান দ্বারা পরিবেষ্টিত। এলাকার প্রধান সড়করে পাশে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিদ্যালয়টি দেখলে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জনাব কেরামত আলি জানালেন, এলাকায় আরও কয়েকটি বিদ্যালয় থাকলেও এটিই একমাত্র সরকারি বিদ্যালয়। এলাকার মানুষ সাধারণ মানুষ নানাভাবে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সহায়তা করে থাকেন। প্রধান শিক্ষক ও তার সহকর্মী শিক্ষক মিলে তাদের নিজস্ব খরচে বিদ্যালয়ের চারপাশে নানা জাতের গাছ রোপণ করেছেন। গাছগুলো বড় হলে বিদ্যালয়ের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাবে। এলাকার মানুষের লেখাপড়ার প্রতি বেশ আগ্রহী আছে। আগামীতে বিদ্যালয়টিকে উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরের ইচ্ছে আছে। এক সময় ছিটমহলবাসীদের পরিচয় সংকট ছিল। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাস করলেও পরিচিতি ছিল ভারতীয় নাগরিক হিসেবে। বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে তারা যেমন কোনো ধরনের আর্থিক ও সামাজিক সহায়তা পেত না, তেমনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষও তাদের প্রতি ছিল উদাসীন। ফলে এদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তাদের কার্যত কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। এ সমস্যা চলছিল বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ছিলমহল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারই ফলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে থাকা ছিটমহল সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা হয়। ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলের সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলো বিনিময় করা হয়। এতে ছিটমহলবাসীরা তাদের বহুল আকাক্সিক্ষত নাগরিকত্ব এবং জাতীয় পরিচিতি লাভ করে। ছিটমহলবাসী এখন আর অবহেলিত নন। তারা বাংলাদেশ অথবা ভারতের গর্বিত নাগরিক। ছিটমহল বিনিময় চুক্তির ফলে দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার সমাধান হয়। 

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার সময়ই মূলত এ সমস্যার সৃষ্টি করা হয়। এ ছিটমহল নিয়ে প্রায়শই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিবাদ এবং উত্তেজনা সৃষ্টি হতো। কিন্তু কোনো সরকারই এ সমস্যাটি সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কারণ এটা অত্যন্ত জটিল একটি সমস্যা ছিল। এর এঙ্গ রাজনীতি জড়িত ছিল। তাই কোনো সরকারই ছিটমহল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে সাহসী হয়নি। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা একজন সত্যিকার রাষ্ট্রনায়কের মতোই এ জটিল সমস্যাটি সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে ছিটমহলবাসীকে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেন। ‘গাবাতি’ (যা আগে ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ছিটমহল) এলাকার মানুষ শ্রদ্ধাভরে জননেত্রী শেখ হাসিনার এ অবদানের কথা স্মরণ করে থাকে। আবু তাহের নামে একজন ছিট মহলবাসী বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগ ব্যতীত কোনোভাবেই ছিটমহল সমস্যার সমাধান হতো না।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে উন্নয়নের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তার ঢেউ পঞ্চগড়েও লেগেছে। পঞ্চগড় এলাকায় বাংলাদেশি সীমান্ত এলাকায় যে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবেন না। এ উন্নয়ন কার্যক্রমের ছোঁয়া অধুনালুপ্ত ছিটমহল গাবাতির মানুষের মাঝেও লেগেছে। গাবাতি এলাকার মানুষ এখন আধুনিক জীবনযাপনের সুযোগ পাচ্ছে। তারা নানা ধরনের আয়বর্ধক কর্মে যুক্ত হতে পারছে। আগে তারা সাধারণত কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এখন নানা ধরনের ছোট ছোট শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছেন। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। তারা আগামীতে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জনাব কেরামত আলি আরও জানালেন, শুধু অধুনালুপ্ত গাবাতি ছিটমহলবাসীই নন, সন্নিহিত এলাকার অন্যান্য ছিটমহলের মানুষও সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাফেলায় শামিল হয়েছে। তারা নানাভাবে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে নিজেদের উন্নতির পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।        

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড