• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০১৮, ১১:০১ এএম

পৌনে চারশ’ বছরের পুরোনো শ্যামসুন্দর মঠ-মন্দির অরক্ষিত

পৌনে চারশ’ বছরের পুরোনো শ্যামসুন্দর মঠ-মন্দির অরক্ষিত
পৌনে চারশ’ বছরের পুরোনো শ্যামসুন্দর মঠ-মন্দির

 

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন। এ উপজেলায় মধ্যযুগীয় নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এমনই এক পুরাকীর্তির নাম মঠবাড়ি মন্দিরগুচ্ছ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র্র। যদিও এখন তা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নেয়া হয়েছে।

কলারোয়া সদর থেকে মাত্র ৯.৬ কিলোমিটার দুরে সোনাবাড়িয়া গ্রামে এই মঠবাড়ি মন্দিরগুচ্ছের অবস্থান। প্রায় পৌনে চারশ বছর আগে তৈরি। ৬০ ফুট উঁচু টেরাকোটা ফলক খচিত পিরামিড আকৃতির এ মঠ-মন্দির প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে টিকে রয়েছে। তবে জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় অবস্থায়। ঐতিহাসিক এ মঠ-মন্দিরটি দ্রুত সংরক্ষণ না করার ফলে ধীরে ধীরে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও চুরি হয়ে গেছে মঠ-মন্দিরের পাশে অবস্থিত বিশাল কষ্টি পাথরের শিব মূর্তি। অথচ এক সময় এ মঠ-মন্দিরটি ভক্তদের আনাগোনায় মুখরিত ছিল।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক মোশারফ হোসেনের লেখা ‘প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা’ বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে উল্লেখ করা হয়েছে, এ মন্দিরটি ১৭৬৭ সালে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করেছিলেন। যা সতীশ চন্দ্র মিত্রের বইয়েও আছে।

এই পুরাকীর্তির সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো এর তিনতলা বিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির। যা আবার ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এর সঙ্গে লাগোয়া রয়েছে দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির। এই মন্দিরগুচ্ছের দক্ষিণে একটি অসম বাহুবিশিষ্ট চৌকো দিঘি আছে। শ্যামসুন্দর মঠের নিচের তলা ১০.৮২ মি./৩৫ফু.-৬ ই. বর্গাকার ভিত পরিকল্পনায় নির্মিত। মঠের দ্বিতলের মাপ ১০ মি./৩২ফুট.-১০ইঞ্চি. এছাড়া ৯.৯৮ মি./৩২ ফু.-৯ ই. এবং ত্রিতল ৭.৪৬মি./২৪ ফু.-৬ ই. ও ৭.১৬ মি./২৩ ফু.-৬ ই.।
ফলে মন্দিরটি একটি পিরামিড আকৃতি ধারণ করেছে। দক্ষিণমুখি এই মন্দিরের নিচের তলার ভিতরের অংশে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা অলিন্দ। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ৬.১৪ মি./২০ ফু.-২ ই.পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এবং ১.৩২ মি./৪ ফু.-৫ ই. চওড়া একটি মন্ডপ। তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে প্রকোষ্ঠ রয়েছে। কিন্তু পূর্বাংশের কোঠাটির পিছনে রয়েছে একটি অলিন্দ, যেখানে দ্বিতল ভবনে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে।

অনেকের অভিমত পূর্ব ও পশ্চিম কোঠা দুটি সংরক্ষিত মূর্তির উদ্দেশ্য তৈরি। দোতলায় রয়েছে একটি দক্ষিণমুখি কোঠা। ত্রিতল ভবনটি তুলনামূলকভাবে ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। মোশারফ হোসেনের ওই জরিপ বইয়ে আরো বলা হয়েছে, শ্যামসুন্দর মঠের নিচে রয়েছে ৪৫.৭ সেমি./১ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু নিরেট মঞ্চ। এর প্রত্যেক তলার ছাদপ্রান্ত ধনুকের মত বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধমুখী গম্বুজ ও মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রত্ন রয়েছে। তাই এটি ‘নবরত্ন স্মৃতি মন্দির’ নামে পরিচিত। নবরত্ন বা শ্যামসুন্দর মঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরও একটি দক্ষিণমুখি মন্দির আছে। যা ‘দুর্গা মন্দির’ নামে পরিচিত। শ্যামসুন্দর মন্দিরের গা ঘেঁষে পূর্বমুখি মন্দিরটিতে ৯১.৪৩ সেমি./৩ ফুট উঁচু একটি কালো কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ ছিলো। কয়েক কোটি টাকা দামের এই কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গটি চুরি হয়ে যায়। এখন সেখানে সিমেন্ট দিয়ে নতুন একটি শিবলিঙ্গ ভক্তদের জন্য বানানো হয়েছে।  এর ওপর একটি ভাষ্য ফলক পাঠোদ্ধার অনুপযোগী অবস্থায় সংস্থাপিত আছে। এর ছাদ চৌচালা, কার্ণিশ ধনুকাকারে বাঁকা এবং কোণগুলো কৌণিক। এটা ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ নামে পরিচিত। মন্দিরগুচ্ছের সব কটি ইমারতে ২২.৮৫ সেমি. ২০.৩১ সেমি. ২.৫৩ সেমি.(৯ ইঞ্চি, ৮ ইঞ্চি ও ১ ইঞ্চি) মন্দির তৈরিতে পরিমাপের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে। এখন এ মন্দিরগুচ্ছ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই মঠের পাশে আরও ৮টি মতান্তরে ১০টি মন্দির ছিল।

এলাকাবাসীর মতে, রামহংস পরমানন্দ এক সময় মন্দিরগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন। মঠ মন্দিরগুচ্ছের অল্প দক্ষিণে ‘জমির বিশ্বাসের পুকুর’ নামে যে জলাশয়টি আছে তার পাঁকাঘাটে ব্যবহৃত ইটের সাথে অন্নপূর্ণা মন্দিরের ইটের মিল পাওয়া যায়। ফলে ধারণা করা হয় পুকুরটিও একই সময় কালের নিদর্শন। ঐতিহাসিক এই পুকুরটি বিষমবাহুর আকার ধারণ করেছে।

২০১০ সালের জানুইয়ারিতে শ্যামসুন্দর মঠ দেখতে সোনাবাড়িয়া এসেছিলেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক উপ-পরিচালক ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ক লেখক মোশারফ হোসেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট লেখক জ্যোতির্ময় মল্লিক এবং খুলনা জাদুঘরের একটি টিম। পরিদর্শনকালে তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় এলাকাবাসী প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে মন্দিরগুচ্ছের সংরক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু খুলনা জাদুঘরের ওই টিমের পরিদর্শনের সময় আট বছর পার হয়ে গেলেও মঠ-মন্দিরটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে গত দুই মাস আগে খুলনা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কয়েকজন কর্মচারী এসে মন্দিরের পাশে ছোট একটি সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। যাতে লেখা আছে এ মন্দিরের কোনো সম্পত্তিত বিনষ্ট না করার জন্য। তাদের মতে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মঠটি সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারতো সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ সব মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান। দেশের একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

সোনাবাড়ীয়া এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা কলারোয়া সরকারি কলেজের প্রভাষক (অবসপ্রাপ্ত) বাবু সুপ্রশাদ দৈনিক জাগরণকে বলেন, ঐতিহাসিক এ প্রত্নতত্ত্বটি সংস্কার ও দেখার কোনো উদ্যোগ না থাকায় ২৫/২৬ বছর আগে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের শিবলিঙ্গটি চুরি হয়ে যায়। সে সময় এ ঘটনায় কলারোয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। তবে সেটি আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা করার জন্য সিমেন্ট দিয়ে একটি শিবলিঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। এই মন্দিরগুচ্ছ দেখার জন্য স্থানীয় কয়েকটি গ্রামের মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ওই কমিটির সভাপতি দেব প্রসাদ জানান, তিনি নিজে কয়েকবার খুলনা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগীয় অফিসে যোগাযোগ করেছেন। কর্মকর্তারা আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এটি সংরক্ষণ করা হবে বলে জানিয়েছেন। তবে তিনি কর্মকর্তার নাম বলতে পারেনি। তিনি মঠবাড়ি মন্দিরগুচ্ছটি ধংস হওয়ার আগে এটি সংরক্ষণ করার জোর দাবি জানান।

কলারোয়া থানার ওসি শেখ মারুফ আহম্মেদ জানান, কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ চুরির ঘটনাটি অনেক বছর আগের। ফলে এ বিষয়ে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে তিনি বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন।

কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন দৈনিক জাগরণকে বলেন, প্রায় চারশ বছরের পুরানো এই পুরাকীর্তিটি কলারোয়া উপজেলার ইতিহাস, সংস্কৃতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই মঠ-মন্দিরটি সংস্কার ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তৈরীর জন্য একাধিকবার সংস্কৃতি মন্ত্রলায়, পর্যটন মন্ত্রলায়সহ বিভিন্ন দপ্তরে জানিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর.এম সেলিম শাহনেওয়াজ জানান, শ্যামসুন্দর মঠ-মন্দিরটি এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বে রয়েছে। আমরা স্থানীয় প্রশাসন এটি সংরক্ষণের জন্য কাজ করতে পারছি না। তবে তিনি কলারোয়ার এই মঠ-মন্দিরের সংস্কারসহ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।

এসসি/আরআই