• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯, ১২:৫৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯, ০১:০১ পিএম

ভিআইপি প্রটোকলে কমান্ডো স্টাইলে চলতেন জি কে শামীম

ভিআইপি প্রটোকলে কমান্ডো স্টাইলে চলতেন জি কে শামীম
জি কে শামীম

মন্ত্রী নন। নন রাষ্ট্রের ভিআইপি মর্যাদার কোনো ব্যক্তি। কেবল যুবলীগের পদবি থাকাতেই সিনেমা স্টাইলে চলাফেরা করতেন ঢাকার রাস্তায় জি কে শামীম। যুবদল করা এই নব্য যুবলীগ নেতা কোটি কোটি টাকা নগদ অর্থসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসতে থাকে সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ক্ষমতাসীন দল ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে সরকারি টেন্ডার বাগিয়ে নেয়াই ছিল তার মূল কাজ। আর ভিআইপিদের সঙ্গে চলতে-ফিরতে নিজেও বনে যান এক ‘ভিআইপি’তে! 

জানা গেছে, গ্রেপ্তারের আগে জি কে শামীম গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরোলে রাস্তা খালি করতে ব্যবহার করতেন তিনটি ২৫০ সিসি ক্ষমতাশালী মোটরসাইকেল। সামনে রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য বেতনভুক্ত কর্মচারীরা বিশেষ ধরনের ওই মোটর সাইকেল নিয়ে শামীমের গাড়ির সামনে এসকর্ট হিসেবে থাকতেন। এই এসকর্টের কাজ ছিল রাস্তা খালি করা, যাতে জি কে শামীম রাস্তা চলতে জ্যামে না পড়েন, দ্রুতই পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে। 

জি কে শামীমকে চিনতেন-জানতেন বা সামনে থেকে দেখেছেন তার নানা কারিশমা- এমন একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, দৈহিক উচ্চতায় জি কে শামীম পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি হবেন। মাথায় চুল সামান্য। সাধারণ দেখতে এই ব্যক্তিটির নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল পুরোপুরি রাজকীয়। নিজের পাহারায় রেখেছিলেন ৬ ফুট উচ্চতার বিশাল শরীরের অধিকারী রক্ষীদের। এইসব বিশাল দেহধারী দেহরক্ষী জি কে শামীমের চারপাশ ঘেরাও করে রেখে পাল্টে দিত তার চলার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অস্ত্রসজ্জিত দেহরক্ষী নিয়ে শামীমের চলাচল ছিল অনেকটাই কমান্ডো স্টাইলে। গাড়ির সামনে-পেছনে মোটরসাইকেল ও জিপে চড়া রক্ষীবাহিনীর পাহারায় সাইরেন বাজিয়ে আসা-যাওয়া করতেন নিকেতনে। সঙ্গে থাকতো পুলিশ পাহারাও। যেন রাষ্ট্রীয় কোনো বড় মাপের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বেরিয়েছেন মুভমেন্টে। 

জানা যায়, নিকেতনের যে কার্যালয়ে থেকে জি কে শামীম র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন তার পুরোটাই আবাসিক এলাকা। আবাসিক ভবনগুলো প্রতিটিই ৬ থেকে ৭ তলা, একটার সঙ্গে আরেকটা লাগুয়া। শুধু শামীমের ভবনটি (জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড) চার তলা। ভবনটি থেকে অল্প দূরত্বে রয়েছে মসজিদ। এই ভবনের অফিসে কখনও সকালে, কখনও দুপুরে এমনকি গভীর রাতেও আসতেন জি কে।

জি কে শামীমের নিকেতনের ভবনটির পাশের ভবনের কেয়ারটেকার জানান, শামীম সাহেবের চালাচল ছিল পুরো রাজকীয়। সবসময় তার সঙ্গে তিনটি মোটরসাইকেলে এক ডজন দেহরক্ষী থাকতো। এ ছাড়া তার আগে-পিছে কালো রঙের আরও দুটি দামি জিপ গাড়ি চলতো। তার গাড়ি যখন এখানে আসতো, কেউ সড়কে বের হতে পারতো না। অফিসের সামনে তার গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রসহ দেহরক্ষীরা তার চারদিকে ঘিরে রাখতো। আর সিনেমার স্টাইলে গাড়ি থেকে নামতেন জি কে। একবার তার গাড়ি আসার সময় আমাদের স্যারের গাড়ি গ্যারেজ থেকে অর্ধেক রাস্তায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার দেহরক্ষীরা আমাদের সেই গাড়ি আবার গ্যারেজে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেছিল। তার গাড়ি চলে যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি বের হয়।

জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড নামের ভবনটির পাশের আরেকটি বাড়ির কেয়ারটেকার ইসমাইল বলেন, আমি দশ বছর ধরে এখানে আছি। আগে ওই বাসাটা খান সাহেব নামের একজনের ছিল। বছর খানেক আগে খান সাহেবের কাছ থেকে জি কে শামীম বাড়িটি কিনে নেন। বাড়িটা হাতবদল হওয়ার পর থেকেই সবসময় এই জায়গাটা জমজমাট থাকে। প্রতিদিনই তিনি এখানে আসেন গাড়িতে সাইরেন বাজিয়ে। দেহরক্ষীদের পাশাপাশি পুলিশের গাড়িও থাকতো। তার চলাচল দেখে মনে হতো সরকারের কোনো মস্তো বড় কেউ। রাত ২টা বা ৩টার সময়ও গুমগুম করে তার গাড়ির সাইরেন বাজতো।

জি কে শামীমের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, খান সাহেবের কাছ থেকে বাড়িটি কেনার পর নিয়মিতই কমান্ডো স্টাইলে এখানে আসতেন শামীম। তবে ফকিরাপুলের জুয়ার আসরে র‌্যাবের অভিযানের পর থেকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত ২-৩ দিন তিনি অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এই সময়টাই তিনি আগের মতো গাড়িতে সাইরেন বাজিয়ে চলাচল করতেন না। কমান্ডো স্টাইলে চলাফেরা কার্যত বন্ধই করে দেন তিনি। অফিসে আসা-যাওয়া করতেন অনেকটাই নীরবে।

রায়হান নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, রাত ২টা বা ৩টার দিকেও জি কে শামীম তার কার্যালয়ে আসতেন। গভীর রাতে তিনি যখন আসতেন তার গাড়ির আওয়াজে আশাপাশের বাড়ির সবার ঘুম ভেঙে যেত। কিন্তু কারও কিছু বলার সাহস ছিল না। এমনকি নামাজের সময়ও তিনি একই স্টাইলে চলাচল করতেন। পাশেই মসজিদ থাকায় অনেকের নামাজের সমস্যা হতো। 

প্রসঙ্গত, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর নিকেতনের কার্যালয় থেকে সাত দেহরক্ষীসহ তাকে আটক করে র‌্যাব। ওইদিন ভোর ৬টা থেকে সাদা পোশাকধারী র‌্যাব সদস্যরা অভিযান শুরু করে। বিকাল ৪টায় ৩০ মিনিটে অভিযান শেষে শামীমসহ ৮ জনকে আটক করার বিষয় জানায় র‌্যাব। অভিযানে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার বান্ডিল উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ১শ’ ৬৫ কোটি টাকার ওপরে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) পাওয়া যায়। যার মধ্যে জি কে শামীমের মায়ের নামে ১শ’ ৪০ কোটি ও ২৫ কোটি টাকা তার নিজের নামে। এছাড়া তার কাছে মার্কিন ডলার, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায়।

এইচএস/টিএফ

আরও পড়ুন