মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে চলছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কাষ্টমসের চোরাচালান প্রতিরোধ কার্যক্রম। নেই কাস্টমসের অত্যাধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি। ফলে শতভাগ বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান। সহজেই ধরা পড়ছে না আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন, ভেহিক্যাল স্ক্যানার, কন্টেইনার স্ক্যানার, ব্যাগেজ স্ক্যানার, হিউম্যান বডি স্ক্যানার, মোবাইল স্ক্যানার, স্পেকট্রোমিটার, রেডিয়েশন ডিটেকশন ইক্যুইপমেন্ট মেশিন, আর্চওয়ে, হ্যান্ড মেটাল ডিটেকটর, কেমিকেল ল্যাবের কাস্টমসে থাকলে চোরাচালান পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব।
কাস্টমস সূত্র জানায়, বিমান বন্দর ব্যবহার করে যাওয়া-আসা করতে হলে একজন যাত্রীকে অনেকগুলো নিরাপত্তা-তল্লাশির ধাপ পার করতে হয়। এ সব ধাপে পাসপোর্ট, ভিসা, যাত্রী সঠিক ব্যক্তি কি না, কোনো অবৈধ বস্তু বা অস্ত্র, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কোনো পণ্য পাচার হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা হয়।
সূত্র জানায়, বিদেশগামী যাত্রীকে প্রথমে এন্ট্রি গেটের চেকিং বলয় পার হতে হয়। সেখানে আর্চওয়ে ছাড়াও হ্যান্ড মেটাল ডিটেকটর দিয়ে তল্লাশি করা হয়। এই নিরাপত্তা তল্লাশিতে দেখা হয়, যাত্রীর কাছে কোনো ধরনের ধারালো অস্ত্র বা আগ্নেয়াস্ত্র অথবা দাহ্য পর্দাথ আছে কি না। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যে আর্চওয়ে এবং মেটাল ডিটেকটর রয়েছে তা আধুনিক নয়। পুরাতন মেশিন দিয়ে চলছে তাদের চেকিং কার্যক্রম।
যাত্রীর কাছ থেকে ব্যাগ ও লাগেজগুলো বুঝে নিয়ে বোডিং পাস দেয়া হয়। তবে হ্যান্ড ব্যাগ সঙ্গে নিয়েই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়। বোর্ডিং না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ওয়েটিং লাউঞ্জে। ওয়েটিং লাউঞ্জ থেকে হোল্ডিং লাউঞ্জ। সেখান থেকে যাত্রীরা ফ্লাইটে যান। এই ধাপে যাত্রীর লাগেজগুলো স্ক্যানার মেশিনে স্ক্যান করা হয়।
সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে তিনটি স্ক্যানার মেশিন রয়েছে। তবে সেগুলোতে স্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায় না। এ মেশিনগুলো কেনা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে।
বিদেশ থেকে একজন যাত্রীকে শুধু গ্রিন চ্যানেলে চেক করা হয়। সেখানে প্রথমে যাত্রীর লাগেজ স্ক্যানিং হয়, এরপর আর্চওয়ের বলয় পার হলেই বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। এখানে যে লাগেজ স্ক্যানার ও আর্চওয়ে রয়েছে, সেটা ২০১০ সালে কেনা হলেও অনেক সময় অস্বচ্ছ বা ঝাপসা ছবি দেখায়। ফলে ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরাও।
কারিগরি ত্রুটির কারণেও কাস্টমস কর্মকর্তাদের অনেক সময় লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। প্রায়ই বিকল থাকে গ্রিন চ্যানেলের আর্চওয়ে। পণ্য আমদানি রফতানির প্রক্রিয়ায় চোরাচালান রোধে এয়ারফ্রেইট, কুরিয়ার ও হ্যাঙ্গার গেটে ৩টি স্ক্যানার মেশিন থাকলেও দীর্ঘ দিন থেকে ৩টিই বিকল হয়ে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন, এ সব ত্রুটি দূর করা গেলে চোরাচালান পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হবে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, শাহজালাল বিমান বন্দরে কোনো হিউম্যান বডি স্ক্যানার মেশিন নেই। এই যন্ত্রটি থাকলে কোনো ব্যক্তির শরীরের ভেতরে লুকিয়ে অবৈধ কিছু পাচারের চেষ্টা করলে সহজেই ধরা যেতো।
চিহ্নিত অপরাধী ধরার ক্ষেত্রেও প্রযুক্তিগত অন্তরায় রয়েছে শাহজালাল বিমান বন্দরে। আন্তর্জাতিক মানের বিমান বন্দর হলেও এখানে নেই এপিআই (অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন) সিস্টেম। উন্নত বিশ্বে ফ্লাইট ল্যান্ড করার আগেই যাত্রীদের তথ্য পৌঁছে যায় সংশ্লিষ্ট বিমান বন্দরে। ফলে চিহ্নিত কোনো অপরাধী সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আগে থেকেই সতর্ক হতে পারেন।
কাস্টমসের নিজস্ব কোনো কেমিক্যাল ল্যাব নেই। ফলে শাহজালালে কোনো কেমিক্যাল পদার্থ আনা হলে বা জব্দ করা হলে তা কাস্টমস এর পক্ষে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। এর জন্য নির্ভর করতে হয় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ ও বুয়েটের ল্যাবগুলোর ওপর। তবে চট্টগ্রাম কাস্টমস ও বেনাপোল কাস্টমসের নিজস্ব ল্যাব থাকায় তারা এদিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।
এ সব বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। সংকটগুলোর সমাধানে এনবিআর কাজ করছে। আশা করছি, শিগগিরি আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে।
ঢাকা কাস্টমস হাউজের কমিশনার আবদুল মান্নান শিকদার বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতির অনেক অভাব। এরইমধ্যে এনবিআরকে অবহিত করা হয়েছে। তারা আমাদের কাছে চাহিদা জানতে চেয়েছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, রাজস্ব আদায়ে কাস্টমস কাজ করে যাচ্ছে। শাহজালাল থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ও হচ্ছে। আমরা এরইমধ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কাস্টমসকে ডিমান্ড দিতে বার্তা দিয়েছি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে বিমান বন্দর, এরপর সি-পোর্ট ও সবশেষে ল্যান্ড পোর্টগুলোর জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হবে বলে জানান তিনি।
এইচএম/এসএমএম/এএস