• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০১৮, ০৪:৪১ পিএম

সবাই মিলে দেব কর, দেশ হবে স্বনির্ভর

সবাই মিলে দেব কর, দেশ হবে স্বনির্ভর

কর হচ্ছে রাষ্ট্রের ব্যয়নির্বাহের জন্য সরকারকে প্রদত্ত জনসাধারণের বাধ্যতামূলক অর্থ। করের বাইরে আরও বিবিধ আয়ের উৎস থাকলেও এটিই সরকারের আয়ের প্রধান অবলম্বন। এ লক্ষ্যেই প্রতিবছরের মতো এবারও শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী আয়কর মেলা। মঙ্গলবার থেকে চার দিনব্যাপী এনবিআরের আয়োজনে এ মেলা শুরু হয়েছে। প্রথম বার ২০১০ সালে ৬০ হাজার ৫১২ করদাতা মেলায় এসে সেবা নেন। ২০১৭ সালে এ সেবাগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৬৯। করদাতার সংখ্যা প্রতিবছর বাড়লেও তাতে সন্তুষ্ট নন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি চান, দেশের অন্তত ৪ কোটি মানুষ আয়কর দেয়। বর্তমানে আয়কর দিচ্ছেন ৩০ লাখ। গত ১০ বছরে এনবিআরের বার্ষিক আয় দ্বিগুণ হলেও ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ লাখ মানুষকে করদানের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। তাই নতুন করদাতা শনাক্তকরণে গ্রামাঞ্চলে জরিপ চালানো প্রয়োজন এবং এজন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। 

গবেষণা সংস্থা সিপিডি কিছুদিন আগে বলেছিল, দেশে আয়কর দেওয়ার যোগ্য এমন মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখের কম নয়। অন্য এক গবেষণায় এ সংখ্যা ১ কোটিরও বেশি উল্লেখ করা হচ্ছে। এ বিশালসংখ্যক মানুষ আয়করের বাইরে থাকায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন আর্থিক সংকট তৈরি হচ্ছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতাও বাড়ছে। 

প্রায় সব দেশেই কর আদায়ের প্রচলিত পদ্ধতি চলমান। আমেরিকা, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ জনগণ প্রদত্ত করের টাকা দিয়ে শুধু উন্নয়ন নয়, আর্থিক নির্ভরশীলতা ও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে অনেক আগেই। এশিয়ার জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং, ইন্দোনেশিয়া আয়করের সঠিক ব্যবহার করে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। সে তুলনায় কর আহরণে আমরা এখনো বেশ পিছিয়ে।

চলতি অর্থবছরে সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা গতবারের মতোই আছে। যাদের বার্ষিক আয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার কম, তাদের কোনো কর দিতে হবে না। আয়কর ও মুনাফার পের কর বাবদ চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৭১৯ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে এনবিআরকে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ৭৭ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা।

আমাদের দেশে আয়কর প্রদান নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে একসময় বড় ধরনের ভীতি ও সংশয় ছিল। আগে দেখা যেত বিশেষ শ্রেণির মানুষই কেবল আয়কর প্রদান করত। কিন্তু সেই দুরবস্থা থেকে বাংলাদেশ আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি আমরা দেখছি, আর্থিকভাবে সক্ষমদের মধ্যে কর প্রদানের সংস্কৃতি প্রসার লাভ করেছে। অর্থাৎ যারা আয়কর প্রদানের আওতায় আসছে, তারা আয়কর দিতে আগ্রহবোধ করছে। স্বউদ্যোগেই এখন মানুষ আয়কর প্রদান করছেন। সাধারণ মানুষ এটি বুঝেছে, সময়মতো আয়কর দেওয়া হলে যে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগে ভবিষ্যৎ ঝামেলা এড়ানো সহজ হয়।

খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রায় ৪৫ থেকে ৬৫ শতাংশ অর্থ করের বাইরে, অর্থাৎ কালো টাকা। প্রতিবছর বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এই কালো টাকাকে ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিয়ে সহজশর্তে সাদা করার সুযোগ করে দিলেও তার ফল তেমন আশাপ্রদ নয়। খুব কম টাকাই সাদা করা হয়েছে। অপ্রদর্শিত আয়ের এই বিশাল অংশ দেশের জিডিপিতে কোনো অবদান রাখতে পারছে না।

কর ফাঁকির সংস্কৃতি আমাদের অভ্যাসে চেপে বসেছে, যা সুনাগরিকের পরিচায়ক নয়। একজন ব্যক্তি শুধু আয়করই দেন না, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বও পালন করেন। দেশকে স্বয়ম্ভরের গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর আইনের ভাষা হতে হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বচ্ছন্দে সর্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। করদাতা যেন নিজেই আয়কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। করদাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত অধিকমাত্রায় করদাতা কর নেটের আওতায় আসবেন, কর রাজস্ব আহরণ ততটাই সুষম হবে। কর প্রশাসনকে যেতে হবে করদাতাদের দোরগোড়ায়। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে নজর দিতে হবে আমাদের। সেসব দেশ রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং এর ব্যবস্থাপনায় অধিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পেরেছে। এসব দিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। তবেই অগ্রগতির ধারা টেকসই হবে।