• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০১৯, ১০:০০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৫, ২০১৯, ১০:০১ পিএম

দলীয় এমপিদের তৎপরতায় ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি

দলীয় এমপিদের তৎপরতায় ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি
খালেদা জিয়ার (বাঁয়ে) সঙ্গে দেখা করে আসার পর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ -ছবি : জাগরণ

দেড় বছর ধরে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হঠাৎ মুক্তি প্রশ্নে সংসদ সদস্যদের ব্যাপক তৎপরতাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না বিএনপি। সংসদে যোগ দেয়ার দীর্ঘ ৯ মাস পর হঠাৎ তাদের এ তৎপরতাকে রীতিমতো সন্দেহের চোখেই দেখছেন দলটির নেতাকর্মীরা। 

নেতাকর্মীদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোন গ্রিন সিগনালে হঠাৎ করে দলীয় প্রধানের মুক্তির বিষয়ে তৎপর হলেন এই ৭ সংসদ সদস্য? যেখানে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন ও আন্দোলন করে যাচ্ছে, যাতে সরকার কোনো সাড়া দেয়া তো দূরের কথা বরং আমলে না নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করছে। সেখানে গুটিকয়েক সংসদ সদস্য কোন আশ্বাসে এ তৎপরতা শুরু করলেন? পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেরও আবেদন জানালেন, যা খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন নেত্রী’ ইমেজের জন্যও হানিকর বিষয়। তাদের বক্তব্য, ‘সরকারও যেমন খালেদা জিয়াকে চিনতে পারেনি, তেমনি এসব বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যগণও তাদের নেত্রীকে এখনও পরিপূর্ণভাবে চিনতে পারেননি।’  

নেতাকর্মীদের ক্ষোভের কারণ, এই গুটিকয়েক সংসদ সদস্য নিজেদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়ে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছেন। সরকারের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করেছেন। এরপর দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ কোন ইশারায় তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে উঠলেন? এর পেছনে সরকারেরই হাত আছে কি না, তা নিয়েও দলটিতে দেখা দিয়েছে সন্দেহ-অবিশ্বাস!  

হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন রুমিন ফারহানাসহ বিএনপির ৪ সংসদ সদস্য     - ছবি : জাগরণ


  
খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রশ্নে বিএনপির ৭ সংসদ সদস্যর এ দৌড়-ঝাঁপকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন স্বয়ং দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি শনিবার (৫ অক্টোবর) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে দলীয় প্রধানের মুক্তি নিয়ে একটি সংগঠনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্যদের এ উদ্যোগকে এদেশের মানুষের কাছে বিএনপি নেত্রীর ‘আপসহীন নেত্রী’ পরিচিতির বিলুপ্তের উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিএনপি দলীয় এমপিদের এ উদ্যোগকে তিনি ‘অতি দায়িত্বপালন’ হিসেবেও কটাক্ষ করেন।  

‘বিএনপির এমপিরা খালেদা জিয়ার আপসহীন নেত্রীর উপাধি খারিজ করতে গিয়ে ধরা খাইছেন’ বলেও মন্তব্য করেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, আমরা আলোর সন্ধান খুঁজছি। হয়তোবা কিছু একটা হবে। এটা করতে গিয়ে, আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আমাদের যে কিছু দায়িত্ববোধ আছে- সেই দায়িত্ববোধ আমরা ভুলে গেছি। আবার অতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের কিছু কিছু নেতা জেলখানায় গিয়ে নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা যে নেত্রীর মুক্তির জন্য খুব বেশি আন্তরিক, সেটা আমাদের ও জনগণের মধ্যে আশ্বস্ত করতে গিয়ে একটা জিনিস ভালো করেছেন। ম্যাডামের যে উপাধি আছে দেশের জনগণের কাছে, সেটা খারিজ করতে গিয়ে ধরা খাইছেন। যারা তার ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে চান, তারা এখনও সঠিকভাবে ম্যাডামকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন।

বিএনপির অন্যতম এ নীতিনির্ধারক বলেন, খালেদা জিয়া সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা ও আপস করবেন না। তিনি প্যারলে মুক্তি নেবেন না। আমি মনে করি, খালেদা জিয়াকে অনুকম্পা করার যোগ্যতা বাংলাদেশের কারও নেই।

একাদশ নির্বাচনের পর কারচুপি ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে নির্বাচন ও নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। দলটি ঘোষণা দেয়, নির্বাচিত সদস্যগণ সংসদে যাওয়া তো দূরের কথা, শপথও গ্রহণ করবেন না। কারণ বিএনপির এ সদস্যদের শপথ ও সংসদে যোগ দেয়ার মধ্যদিয়ে এ কারচুপির সংসদের বৈধতা দেয়া হবে। কিন্তু দলের এ সিদ্ধান্ত অমান্য করে ঠাকুরগাঁও থেকে নির্বাচিত বিএনপিদলীয় সদস্য জাহিদুর রহমান প্রথম সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণের দিনই তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরও দলের বাকি ৫ নির্বাচিত সদস্য বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে সংসদে যোগ দেয়া ও নিজেদের শপথ নেয়ার পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। তারা বলতে থাকেন, যে ছোট পরিসরে হলেও তাদের সংসদে যোগ দেয়া উচিত। সেখানে তারা কারাবন্দি দলীয় প্রধানের মুক্তি ও বর্তমান সরকারের ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে অন্তত কথা বলার সুযোগকে কাজে লাগাতে পারবেন। 

সূত্রমতে, কার্যত দলের ওই নির্বাচিতদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদের সংসদে যোগ দেয়ার অনুমতি দিতে এক পর্যায়ে বাধ্য হয় বিএনপি। বিএনপির এই দলীয় সিদ্ধান্তর প্রেক্ষিতে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের কাছে এমন একটি ‘মেসেজ’ পৌঁছায় যে, এসব সংসদ সদস্যদের সংসদে যোগ দেয়ার পেছনে দলের চেয়ারপারসনের কারামুক্তির বিষয়টি জড়িত। তারা আশান্বিত হয়। কিন্তু ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও এ সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ দেখতে না পেয়ে নেতাকর্মীরা দিন দিন ক্ষুব্ধ হতে থাকেন। তাদের সেই ক্ষুব্ধতা প্রশমিত করতেই বর্তমানে সেসব এমপি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে নতুন করে নাটক করছেন! অথবা তাদের এ উদ্যোগের পেছনে সরকারের কোনো হাত আছে। নাহলে হঠাৎ কেন তাদের এ তৎপরতা, এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সন্দেহ আছে। 
  
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়াপল্টনে কথা হয় দলের অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের বিগত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি এমপিদের এ উদ্যোগ নিয়ে দৈনিক জাগরণের কাছে সন্দেহ পোষণ করে বলেন, তারা (এমপি) যখন দলের সিদ্ধান্ত এক প্রকার অমান্য করে সংসদে যোগ দিয়েছেন, তখন আমরা কর্মীরা মনে করেছিলাম যে সংসদে তাদের যোগদানের মধ্যদিয়ে আমাদের নেত্রী হয়ত খুব দ্রুত মুক্তি পাবেন। কিন্তু গত ৯ মাসেও যখন নেত্রী কারামুক্ত হলেন না, তখন আমাদের সেই বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। এতদিন পর হঠাৎ করে তাদের এ তৎপরতার পেছনে আবার কোনো ‘কারণ’ আছে কি না, তা-ও আমাদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। 

মান্নান আরও বলেন, ম্যাডাম কি কোনোদিন আপস করেছেন? করেননি। আমরা ম্যাডামের মুক্তির জন্য লড়াই করছি। তিনি এই বয়সেও কারাগারে থেকে দেশের গণতন্ত্রের জন্য অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করছেন। কিন্তু তিনি সরকারের কাছে কখনও অনুকম্পা নেয়ার চিন্তাও করেননি। আমাদের দলের এমপিরা ম্যাডামের মুক্তির জন্য যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন তা নেতাকর্মীরা সহজভাবে নিতে পারছে না।

খালেদা জিয়ার মুক্তির উদ্দেশ্যে ৭ সংসদ সদস্যের উদ্যোগের পেছনে সরকারের কোনো হাত বা ইঙ্গিত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন বগুড়া থেকে নির্বাচিত বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন। তিনি দৈনিক জাগরণকে বলেন, আমরা তো ম্যাডামের মুক্তি প্রচেষ্টায় এ উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের আহ্বান বা আবেদনকে সরকার আন্তরিকভাবে দেখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু এখন বাকিটা প্রক্রিয়ার বিষয়। দেখা যাক কী হয়?

জাতীয় সংসদে বিএনপি দলীয় মাত্র ৭ জন এমপি থাকলেও দুই ভাগে কেন এ উদ্যোগের সঙ্গে জড়ালেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন বাবুল বলেন, এটা কারা কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কারণ একসঙ্গে ৭ জন দেখা করতে পারেন না। ঈদ বা বিশেষ কোনো দিন হলে পরিবারের লোকজন সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে যেতে পারেন। এ কারণে আমরা দুই ভাগ হয়ে উনার সঙ্গে দেখা করেছি। 

আপনাদের উদ্যোগকে দল/নেতাকর্মীরা সন্দেহের চোখে দেখছে কি না- জানতে চাইলে বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, না। আমাদের চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। দলীয়ভাবে এটাকে সন্দেহ বা অন্যভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।   

প্যারলে মুক্তিতে খালেদা জিয়ার মনোভাব সম্পর্কে সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, না, প্যারলের বিষয়ে ম্যাডামের কোনো সায় নেই। তিনি আমাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি প্যারলে মুক্তি নেবেন না। তিনি যে মামলায় সাজা খাটছেন, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি মামলা। এ মামলার আইনি কোনো ভিত্তি নেই। যে টাকা নিয়ে প্রশ্ন সেই টাকা এরইমধ্যে চার গুণেরও বেশি হয়েছে। তাই এখানে দুর্নীতির কোনো বিষয় জড়িতও নেই। এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মামলা। তিনি আরও বলেছেন, বয়স, অসুস্থতা ও তার স্ট্যাটাস বিবেচনায় নিয়ে আদালত অবশ্যই তাকে জামিনে মুক্তি দেবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। কারণ তিনি আদালতের নিরপেক্ষতার ওপর আস্থাশীল।

বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দলীয় এমপিদের উদ্যোগের বিষয়ে বলেন, শুধু আমরা (বিএনপি) নই। সারাদেশের কোটি কোটি জনতা দেশের গণতন্ত্রের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চান। কারণ তিনি কারাগারে থাকা মানে পুরো দেশ কারাবদ্ধ হয়ে থাকা। দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার ফিরে পেতে হলে অবশ্যই মানুষের আস্থার প্রতীক খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করতে হবে।

আলাল আরও বলেন, খালেদা জিয়া অতীতেও কখনও কারও সঙ্গে আপস করেননি। এখনও করবেন না। তিনি প্যারল বা সরকারের দয়ায় কখনও মুক্তি নেবেন না। আইনি লড়াই ও রাজপথের আন্দোলনে খুব শিগগিরিই নেত্রী মুক্ত পরিবেশে ফিরবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

টিএস/ এফসি

আরও পড়ুন